হাসান গোর্কি : “I believe in Spinoza’s god, who reveals Himself in the lawful harmony of the world, not in a god who concerns himself with the fate and the doings of mankind.”
— Albert Einstein
আইনস্টাইনকে ঈশ্বর বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতেন যে তিনি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। বারুখ স্পিনোজা ছিলেন বর্তমান সভ্যতার সবচেয়ে মৌলিক দার্শনিকদের একজন। তাঁর পিতৃপুরুষের আদি নিবাস ছিলো স্পেন। রোমান ক্যাথলিকদের পীড়ন থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা পর্তুগালে চলে যান। ১৪৯৮ সালে ক্যাথলিকরাই তাদের খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। স্পিনোজার পিতামহ আইজাক ডি স্পিনোজা বাস করতেন লিসবনে। স্পিনোজার বাবার জন্মের পর তাঁরা সপরিবার ফ্রান্সে চলে যান। এরপর ১৬১৫ সালে ফ্রান্স থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেন নেদারল্যান্ডসের রটারডামে। বৈরী পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্য স্পিনোজার বাবা ডি স্পিনোজা, তার দুই ভাই মিগুয়েল স্পিনোজা ও ম্যানুয়েল স্পিনোজাকে নিয়ে আমস্টারডামে পাড়ি জমান। সবাই আবার ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন। ডি স্পিনোজা বিয়ে করেন সেফার্ডীয় ইহুদি বংশের আনা ডিবোরাকে। ১৬৩২ সালে আমস্টারডামে প্রায় শত বছর ধরে আশ্রয়হীন এক পরিবারে জন্ম হয় বারুখ স্পিনোজার। তবে তাঁর জন্মের আগে থেকেই বাবা ডি স্পিনোজা সফল ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। ফলে শৈশব থেকেই প্রয়োজনীয় সব সুবিধাসহ বেড়ে ওঠেন তিনি। পড়াশোনা করেন ইহুদিদের ধর্মীয় স্কুলে। এ’সময় তিনি ইবন এজরা ও মাইমোনাইড্সসহ বেশ কিছু অতিন্দ্রীয়বাদী দার্শনিকের রচনার সাথে পরিচিত হন। কিন্তু তাঁর জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে ফ্রান্সিসকাস ফান ডেন এন্ডেন নামক একজন পণ্ডিত যার কাছে তিনি লাতিন ভাষা পড়তেন।
এন্ডেন পেশায় ছিলেন একজন চিকিসক। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিলো। ভাষা শিক্ষা উদ্দেশ্য হলেও স্পিনোজা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এন্ডেনের কাছে যে জ্ঞান লাভ করেন তা-ই তাঁর দার্শনিকতার ভিত্তি তৈরি করে। এন্ডেন-ই তাকে জর্দানো ব্রুনো ও রনে দেকার্তের রচনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৬৭৪ সালে সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এন্ডেনকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়। এতে স্পিনোজা গভীরভাবে মর্মাহত হন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন খুব-ই কোমল হৃদয়ের মানুষ। ধর্মীয় শিক্ষা লাভের পাশাপাশি স্পিনোজা ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদী দর্শন ‘কাব্বালাহ’-র সাথে পরিচিত হন। এই দর্শনের উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবীর সৃষ্টি ও ঈশ্বরের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা, পরম সত্যের রূপক উপস্থাপন, ধর্মীয় জীবনের অলৌকিকতা অনুসন্ধান এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের প্রকৃতি অনুমান। এটা ছিলো অনেকটা মুতাজিলা মতবাদের মতো, যা তোরাহ্-র দর্শনের সাথে অনেকাংশে-ই সাংঘর্ষিক। ইসলামের সূফী মতবাদের সাথেও এর মিল আছে। ‘কাব্বালাহ’ দর্শনে প্রথম দিকে কিছুটা প্রভাবিত হলেও পরে তিনি পদ্ধতিবদ্ধ ও যৌক্তিক দর্শন চর্চার পথ বেছে নেন এবং এই প্রস্তাবে স্থির হন যে, “ঈশ্বরের অস্তিত্ব শুধুই দর্শনতাত্তি¡ক”। তিনি দেকার্তে, ইউক্লিড, থমাস হবস এবং ইহুদি ধর্মতাত্তি¡ক মাইমনিডস্ কর্তৃক কিছু মাত্রায় প্রভাবিত ছিলেন। তবুও তার দর্শন, বিশেষ করে ঈশ্বর দর্শনকে পুরোপুরি মৌলিক মনে করা হয়। পল গ্যঁগা এটাকে শূন্য থেকে অভিধান তৈরি করা’র সাথে তুলনা করেছিলেন।
স্পিনোজার ঈশ্বর চিন্তার দুটি মূল বিষয়ের একটি হলো সাবটেন্স (সারপদার্থ)। তিনি ভেবেছিলেন সবকিছুর সারবস্তু একটাই। তিনি বলেন, “সাবস্টেন্স’ বলতে আমি বুঝি যা নিজের মধ্যে পরিব্যাপ্ত এবং যার ধারণা সয়ংসম্পূর্ণ; অথবা অন্যভাবে বললে, যা থেকে অন্য কোনো ধারণার সাহায্য ছাড়াই একটি ধারণার জন্ম হতে পারে।” “Etext of The Ethics, by Benedict de Spinoza”। The Project Gutenberg| Translated by R. H. M. Elwes (1883)। আর তাঁর দর্শনের ঘাটনিক উপাদান হলো কার্যকারণ। তাঁর ধারণা ছিলো প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা কারণ আছে এবং কারণ না থাকলে কোনো প্রতিক্রিয়া থাকবে না। স্পিনোজার বর্ণনায় এই মহাজগৎ হচ্ছে বিলিয়ার্ড বোর্ডের মতো কার্যকরণ সূত্রে আবদ্ধ প্রান্তহীন-অসীম একটা ক্ষেত্র, যেখানে একটা গতিশীল বল অপরটিকে আঘাত করছে এবং সেই আঘাতের ফলে অন্য বলটিও গতি লাভ করছে। এখানে কারণ বা ক্রিয়া হলো প্রথম বলের আঘাত এবং এই আঘাতের ফলে দ্বিতীয় বলের যে সরণ ঘটছে সেটা হচ্ছে প্রতিক্রিয়া।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায় ‘কারণ’ বা ‘ক্রিয়া’টি ঘটছে কেনো? আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, প্রথম ‘কারণ’ বা ‘ক্রিয়া’টি ঘটেছিল কেনো? এই প্রশ্নের জবাবে অ্যারিস্টটল একজন সচেতন-বুদ্ধিমান ও ইচ্ছা সম্পন্ন অথবা অন্ধ-চৈতন্যসম্পন্ন, ইচ্ছা-নিরপেক্ষ প্রাইম মুভারের (অ্যারিস্টটলের ভাষায় আনমুভড মুভার) অটল অস্তিত্ত¡ কল্পনা করেছিলেন। অ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্যাল ব্যাখ্যাকে নসটিকদের অনেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্তে¡র স্বপক্ষে সমর্থন হিসেবে দেখেছেন। যেমন আল-কিন্দি প্রাইম মুভারের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটলের যুক্তি ব্যবহার করে বলেছেন যে এই প্রথম নীতি-ই অপরিবর্তনীয়, নিখুঁত ও অবিনশ্বর সত্তা স্বয়ং এবং তিনি-ই শূন্য (এক্স নিহিলো) হতে সবকিছু সৃষ্টি করেন।
স্পিনোজা ক্রিয়ার পেছনে কোনো প্রাইম মুভারের কল্পনায় সায় দেননি। প্রথম বলে কিছু থাকার দরকার আছে বলে তিনি মনে করেননি। কল্পিত বিলিয়ার্ড বোর্ডের কথাই ধরুন। এমন কি হতে পারে যে এখানে কোনো বল-ই প্রথমে নড়তে শুরু করেনি বা দ্বিতীয় বলকে আঘাত করেনি? হ্যাঁ, হতে পারে।
প্রথম যে বলটি নড়তে শুরু করেছিল সেটা আসলে এর আগের কোনো একটা বলের আঘাতে নড়তে শুরু করেছিল।
সেই আগের বলটিকেও আরও আগের একটা বল আঘাত করেছিল। তাহলে ‘প্রথম বল’ বলা হলো কেনো? এটা আমাদের কল্পনার ভুল। আমরা চারপাশে যা দেখি সেসবের একটা শুরুর বিন্দু আছে। যেমন ১২ ইঞ্চি একটা স্কেলের শুরুর বিন্দু শূন্য চিহ্নিত রেখা, রেলপথের শুরুর বিন্দু কোনো একটা জংশন, মানুষের শুরুর বিন্দু ভ‚মিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্ত। স্পিনোজা বলছেন এই ঘটনাগুলো আলাদাভাবে সত্য নয়; কারণ তারা বৃহত্তর বা অসীম ঘটনাবলীর অন্বয়, অনুবর্তিতা ও ফলাফল। ফলে এখানে শুরু এবং শেষ বলে কিছু থাকার সুযোগ নেই। যখন একটা শুরুর বিন্দু কল্পনা করা হয় তখন আসলে এর আগের সংখ্যাতীত কারণ ও ঘটনাকে অস্বীকার করা হয়। কার্যকারণের এই অসীম বিস্তার সম্পর্ক বুঝতে গেলে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে সাবস্টেন্স বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন।
ছবির এই ব্যালেন্সিং বোল্ডার বা ‘ব্যালেন্সড রক’টি যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো স্প্রিংস গার্ডেন অব গডস পার্কে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি একটা ‘সাবস্টেন্স’? আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এই পাথর খণ্ডটি আমাদের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আছে। আমরা এই কঠিন বস্তুটিকে স্পর্শ করতে পারি, স্থানান্তর করতে পারি, বহন করে নিয়ে লোকালয়ে স্থাপন করতে পারি। ধরা যাক, পাথরের পাশে দাঁড়ানো ঐ দুই ব্যক্তি একটা বড় লিভারের সাহায্যে এটিকে নিচের খাদে ফেলে দিলেন। পাথরটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। এই দুই ব্যক্তি কী করছেন তার ওপর এতক্ষণ এই পাথরের অস্তিত্ত¡ নির্ভর করছিল। তার অর্থ পাথরটির নিজের অস্তিত্তে¡র সংজ্ঞায় এই দুই ব্যক্তির ভ‚মিকা আছে। আবার এই দুই ব্যক্তির অস্তিত্বের সংজ্ঞায় তাদের বহন করে নিয়ে যাওয়া গাধা, তাদের বেড়ে ওঠার বাড়ি, পিতামাতা, প্রপিতামহ, বৃক্ষ, ফল, শস্য, জল, সূর্য, বায়ু- সবকিছুর অংশ আছে। এভাবে হিসাব করলে আমরা দেখবো সৌরজগৎ, গ্যালাক্সি, এমনকি আমাদের জানা মহাবিশ্বের সবগুলো বস্তুর প্রভাব-ই কলোরাডোর এই ব্যালেন্সিং বোল্ডারের ওপর এবং ছবির ঐ দুই ব্যক্তির ওপর আছে। বিপরীতভাবে এদের প্রভাবও আছে গোটা মহাজগতের ওপর। ছবির ঐ দুই ব্যক্তি যেমন পাথরটিকে ভেঙে ফেলতে পারেন, একইভাবে পাথরটিও তাদের চাপা দিতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা স্বাধীন নন/নয়। যেমন পাথরটিকে নড়তে গেলে একটা ভ‚মিকম্প বা মেক্সিকো উপসাগর থেকে বয়ে আসা একটা সাইক্লোনের ওপর নির্ভর করতে হবে। ঐ লোকদের নির্ভর করতে হবে আগে গ্রহণ করা প্রাণিজ বা উদ্ভিদজাত খাদ্যের ওপর, যা এসেছে প্রকৃতি থেকে। এরকম কিছু ব্যাখ্যার ভিত্তিতে স্পিনোজা মনে করেছেন পাথর ও মানুষ আসলে একই সাবস্টেন্সের (সারবস্তুর) অংশ, যা মহাজগৎময় ব্যাপ্ত হয়ে আছে। এই সারবস্তুকে ক্রীয়াশীল রাখতে বস্তুসমূহের পারস্পারিকতা-ই যথেষ্ট।
‘সারবস্তু’ শব্দটির মধ্যে ‘বস্তু’ আছে। তাই আমাদের অল্প বিভ্রান্ত হবার সুযোগও আছে। আসলে ‘সাবস্টেন্স’ শব্দটিকে স্পিনোজা essence বা নির্যাস অর্থে ব্যবহার করেছেন; এটি পদার্থবিদ্যার সাবস্টেন্স নয়। ধারণা ও বাস্তবতা আসলে একটি একক, অসীম, অবিভাজ্য, (সময়ের বিবেচনায়) অগ্র-পশ্চাৎহীন সাবস্টেন্সের দুইটি গুণ। আর স্পিনোজার ধারণায় এই সাবস্টেন্স-ই ঈশ্বর। সহজ করে বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ধরা যাক জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থটির একটা ছাপানো কপি একটা মহাবিশ্ব। কাগজ-কালি এর অবয়ব তৈরি করেছে। অক্ষরগুলো যে ভাব তৈরি করেছে সেটাও ধারণ করছে এই কাঠামো। এর মধ্যে বাস করেন ‘মুখোমুখি বসিবার’ বনলতা সেন এবং ‘পাড়াগাঁ’র অরুণিমা স্যান্যাল।” জীবনানন্দ দাশ কি এই বইটির স্রষ্টা? তিনি কি এই অদৃশ্য মানবীদের ঈশ্বর? স্পিনোজার তত্তে¡ বিশ্বাস করলে তিনি স্রষ্টা নন। এটা আসলে কিছু কার্যকারণের ফসল যার উৎস ‘সাবস্টেন্স’। এই পুস্তকে ব্যবহৃত কাগজ-কালি, বাঁধাইয়ের সুতা এসেছে কারখানা (বা মূলত প্রকৃতি) থেকে। ভাব এসেছে কবির মস্তিস্ক ((বা মূলত প্রকৃতি)) থেকে। প্রকৃতির রয়েছে অন্তহীন পশ্চাৎমুখী সংযোগ।
তার অর্থ প্রকৃতি বা মহাবিশ্ব-ই চূড়ান্ত সারবস্তু (আলটিমেট সাবস্টেন্স) যা একই সাথে পদার্থ ও ভাবের সমন্বয়ে গঠিত। স্পিনোজার এই ধারণা সে’সময় অনেকের কাছে-ই অস্পষ্ট ছিলো। তাঁর মূল গ্রন্থ কিছুটা জটিল ব্যাখ্যা সহ কঠোর গাণিতিক সংগঠন ইউক্লিডিয় জ্যামিতির আদলে লেখা। গ্যাটে বলেছিলেন, “বেশিরভাগ সময় স্পিনোজা কী বোঝাতে চাচ্ছেন সেটা আমি নিজেও ঠিক অনুধাবন করতে পারিনি।” মূল সমস্যা ছিলো বস্তু ও ভাবের একীভবন। সেসময় কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কৃত হয়ে থাকলে স্পিনোজার ধারণা ব্যাখ্যা করা হয়তো সহজ হতো। কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলছে বস্তুর অতি পারমাণবিক কণা একই সাথে অনেকগুলো বিন্দুতে থাকে। এটকে বলা হয় কোয়ান্টাম সুপার পজিশন, যা প্রমাণ করে যে বিভাজনের শেষ পর্যায়ে বস্তু তরঙ্গের রূপ নেয় অথবা তরঙ্গ-ই (যা ভাবের সমার্থক) বস্তু কণা বা ভৌত জগত তৈরি করে। স্পিনোজা মনে করতেন, মহাবিশ্বের বাইরে প্রচলিত ধারণার অতিপ্রাকৃত ঈশ্বর যদি থেকে থাকেন তাহলে তাঁর পক্ষে মহাবিশ্বের ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ, তিনি যদি মহাবিশ্বের ওপর ক্ষমতাবান হয়ে থাকেন তাহলে তিনি পৃথক সাবস্টেন্স হতে পারেন না। এভাবে তিনি মহাবিশ্ব ও ঈশ্বরকে অভিন্ন সত্তা বলে মনে করেছেন। তাঁর ভাষায়, “সাবস্টেন্স চিরায়ত অস্তিত্বশীল। অন্য কোনো উৎস থেকে এর সৃষ্টি হতে পারে না। এর জন্ম, জীবন বা মৃত্য নেই। এর শুরু ছিল না; শেষও থাকবে না। সাবস্টেন্স যদি মানুষ বা অন্য কোনো সসীম বস্তুর মত আচরণ করে তাহলে সাবস্টেন্স এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ধারণা ভেঙ্গে পড়ে” (History of Philosophy As I See It, Kelley L. Ross)। যুক্তি, তত্ত¡ ও কিছুটা বিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করার কারণে স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদ দর্শন শাস্ত্রে যুগান্তকারী প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু সর্বৈববাদী ধারণা বা সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism) আসলে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতিতে বহু প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো। সর্বেশ্বরবাদীরা কোনো স্বতন্ত্র ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো না। অদ্বৈতবাদী দর্শন (বৈদিক দর্শনের সর্বেশ্বরবাদী ধর্মীয় অনুশীলন বা সাধনার পদ্ধতিগত ধারা) অনুসারে, মানুষের আসল সত্তা হলো আত্মা এবং ব্রহ্ম হলো শুদ্ধ চৈতন্য।
স্রষ্টা ও সৃষ্টি যে অভিন্ন সেরকম ধারণা পোষণ করা হয় শিখধর্ম, শিন্তৌ ধর্ম (জাপানের আচারনির্ভর ধর্ম), সানামাহিজম (মৈতেই ধর্ম যা কঙ্গেলি ধর্ম নামেও পরিচিত), কনফুসিয়ানিজম, তাওবাদ (একটি ঐতিহ্যবাহী চীনা ধর্ম। ঘটনার স্বাভাবিক গতি, নিয়মিত বিবর্তন ও স্বাভাবিক পরিণতি তাওবাদের মূল বিষয়) ও তাসাউউফ (সুফিবাদ)-এ। স্পিনোজার সর্বেশ্বরবাদের সাথে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির সর্বেশ্বরবাদের কিছুটা পার্থক্য আছে। স্পিনোজার ঈশ্বর অন্ধ, উদাসীন, উদ্দেশ্যশূন্য, নির্বিকার ও ইচ্ছাহীন। আর ধর্মীয় সংস্কৃতির ঈশ্বরগণ সৃষ্টির সাথে একীভ‚ত থেকেও কখনও কখনও ইচ্ছাময় যদিও সে ইচ্ছা সৃষ্টি থেকে পৃথক নয়। ধর্মীয় সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠা সর্বেশ্বরবাদ, লাইবনিৎস (জার্মান দার্শনিক ও গণিতবিদ যাকে ক্যালকুলাসের আবিষ্কর্তা হিসেবে সম্মান দেয়া হয়) ভলতেয়ারের দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। তবে স্পিনোজা এসব ধারণার সাথে পরিচিত ছিলেন কিনা অথবা পরিচিত থাকলে প্রভাবিত হয়েছিলেন কিনা সেটা বুঝতে পারা যায় না। তবে ভারতে জার্মান রাষ্ট্রদূত হিসেবে দীর্ঘদিন বসবাস করার কারণে হেরম্যান হেস অদ্বৈতবাদী দর্শন (এবং কিছুটা চার্বাক দর্শন) দিয়ে প্রভাবিত হয়ে তাঁর অমর গ্রন্থ সিদ্ধার্থ রচনা করেন। এই উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই সিদ্ধার্থ কীভাবে প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বরের সন্ধান পান।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু হলো একজন তরুণ ব্রাহ্মণ, সিদ্ধার্থের আত্ম-উপলব্ধির সন্ধান। ব্রাহ্মণের পুত্র হিসাবে, সিদ্ধার্থ তার বাড়িতে বিচ্ছিন্ন থাকার সময় বিপুল বিলাস, ঐশ্বর্য ও আয়েশ ভোগ করেন। তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার হৃদয় প্রজ্ঞা এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করার এক গভীর ইচ্ছা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। বাস্তবতা এবং তাকে যা শেখানো হয়েছে তার মধ্যে দ্ব›দ্ব উপলব্ধি করে সে তার বিলাসময় জীবন পরিত্যাগ করে গৃহত্যাগী হয়। তার বাবাকে তার উদ্দেশ্যের কথা জানিয়ে সিদ্ধার্থ এবং তার বাল্যবন্ধু, গোবিন্দ, বাড়ি থেকে অজানার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। তাদের লক্ষ্য, প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যা তাদের ভয়কে পরাস্ত করতে এবং আনন্দ, দুঃখ, মৃত্যুসহ জীবনের বৈপরীত্যগুলিকে সমতার সাথে অনুভব করতে সক্ষম করবে। উপবাসসহ তপস্যা করে, মরুভ‚মি- জঙ্গল, বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে বাস করে তারা নিজেদের শরীর ও আত্মার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। তাতে তারা ব্যর্থ হয়। সিদ্ধার্থ একজন সুন্দরী গণিকার সাথে কিছুকাল বসবাস করে এবং এক পুত্র সন্তানের জনক হয়। কিন্তু সেখানেও তার মন টেকেনা। সে আবার গৃহত্যাগী হয়ে বিচরণকারী তপস্বীদের একটি দল ‘সামনা’তে যোগ দেয়। তারা গৌতম বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার আস্তানায় নির্বাণ লাভের সাধনা করে ব্যর্থ হয়। পরিপূর্ণতা খুঁজে পেতে হতাশ হয়ে সিদ্ধার্থ নদীর কাছে যায়। ঘাটের মাঝি তাকে প্রকৃতির নির্জনতার ধ্বনি থেকে, নদীর নিরবধি বয়ে চলা থেকে, পাথরের স্থবির মগ্নতা থেকে শিক্ষা নিতে বলে।
সেখানে সে নৈঃশব্দ্যের ধ্বনি শুনতে শেখে, চোখ বন্ধ করে দেখতে শেখে, অচৈতন্যে প্রজ্ঞাময় চেতন অনুভবের স্তরে বিচরণ করতে শেখে। সে বৃক্ষ, পাখি, আকাশ, নদী, চাঁদ, বায়ু, প্রজাপতি, ধূলিকণার মধ্যে একটা ঐক্যের ধ্বনি (ওঁ) শুনতে পায়। সে উপলব্ধি করে এই মহাজগৎ এক অভিন্ন ঐক্যের সুরে বাঁধা। সে নিজের মধ্যে প্রেমের চেতনা আবিষ্কার করে এবং মানুষের ক্ষণস্থায়িত্ব ও বিচ্ছিন্নতাকে মেনে নিতে শেখে। শেষ পর্যন্ত, সিদ্ধার্থ জীবনের সমগ্রতাকে উপলব্ধি করে এবং পরমানন্দ এবং সর্বোচ্চ জ্ঞানের অবস্থা অর্জন করে যা তাকে উপলব্ধি করতে শেখায় পূর্ণতা-ই ঈশ্বর।
অনুমান করা চলে যে স্পিনোজার প্যান্থেইজমকে আইনস্টাইন তার জীবনাচারের পাথেয় হিসেবে নিয়েছিলেন।
আইনস্টাইন বলেছেন, “একজন মানুষ একটা সমগ্রতা — যাকে আমরা ব্রহ্মাণ্ড বলি, তার অংশ, যা সময় ও পরিসরে সীমিত। আমরা নিজেদের চিন্তা ও অনুভ‚তিকে বাকিদের থেকে আলাদা কিছু হিসাবে অনুভব করি; এটা আমাদের মানস চোখের এক ধরণের অপটিক্যাল বিভ্রম। এই অধ্যাস (মায়াজাল) আমাদের জন্য এক ধরনের কারাগার, যা আমাদের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা এবং আমাদের কাছের কিছু ব্যক্তির প্রতি স্নেহ- ভালবাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। আমাদের কাজ হতে হবে এই কারাগার থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করা, আমাদের করুণার বৃত্ত প্রসারিত করা এবং সমস্ত জীবিত প্রাণি ও সমগ্র প্রকৃতিকে এর সৌন্দর্যে আলিঙ্গন করা।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।