হাসান গোর্কি : ফিফার অনুমান অনুযায়ী ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনা বনাম ফ্রান্সের ফাইনাল ম্যাচ দেখেছিলেন দেড়শ’ কোটি মানুষ। যারা এই নিবন্ধটি পড়বেন তাদের মধ্যে সম্ভবত একজনও নেই যিনি এই ম্যাচটি দেখেননি। খেলার অন্তিম মুহূর্তের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। ১৯ জানুয়ারি প্রথম আলো স্মৃতিচারণ করেছে “বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই মুহূর্তের কথা মনে হলে একেকজনের একেক অবস্থা হয়।
আর্জেন্টিনার সমর্থকদের হার্টবিট মুহূর্তের জন্য হলেও বেড়ে যায়, ফ্রান্স-সমর্থকেরা আক্ষেপে পুড়তে থাকেন, আর্জেন্টাইন গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ হয়তো নিজের শরীরে চিমটি কেটে দেখেন আর ফ্রান্স স্ট্রাইকার কোলো মুয়ানির বুক ফেটে কান্না আসে।” ঘটনাক্রমটা এরকম: অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলায় নষ্ট হওয়া ৩ মিনিট যুক্ত হয়েছে। খেলা শেষ হতে ২০ সেকেন্ড বাকি। স্কোরলাইন ৩ —৩ । আর্জেন্টিনার বক্সের সামনে ফাঁকায় বল পেয়ে যান মুয়ানি। তিনি গোল করলেই ফ্রান্স জিতে যাবে। মুয়ানির সামনে চারটি অপশন ছিলো— ১. মার্তিনেজের পাশ দিয়ে জালে বল ঠেলে দেওয়া ২. বাম দিক থেকে ফাঁকায় এগিয়ে আসা এমবাপেকে বল বাড়িয়ে দেওয়া ৩. মার্তিনেজের মাথার উপর দিয়ে বল জালে ফেলা ৪. ডান দিক দিয়ে ডজ দিয়ে বক্সে ঢুকে পড়া। মুয়ানি প্রথমটি বেছে নিয়েছেন এবং ব্যর্থ হয়েছেন।
স্পোর্টস ম্যাগাজিনগুলো ঘেঁটে দেখলাম, বেশিরভাগ ফুটবল বিশেষজ্ঞের মতে এটা দ্বিতীয় সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত ছিলো। সবচেয়ে ভালো হতো দ্বিতীয়টি বেছে নিলে, কারণ মুয়ানিকে ঠেকাতে মার্তিনেজ ততক্ষণে বক্স থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছিলেন। এমবাপেকে বল দিলে তিনি ফাঁকা নেট পেয়ে যেতেন। গোলপোস্টের সামনে মাথা ঠাণ্ডা রাখা কঠিন। গত বছরের ব্যালন ডি অর জয়ী বিশ্বসেরা খেলোয়াড় করিম বেনজামা ফ্রান্স স্কোয়াডে ছিলেন। কোচ তাকে মাঠে নামালে মুয়ানির জায়গায় তিনি খেলতেন। তিনি হয়তো এই ভুলটি করতেন না। মার্তিনেজ বিস্ময়করভাবে বাম পা বাড়িয়ে মুয়ানির শট ঠেকিয়েছেন। সবাই এটাকে ‘বিশ্বকাপের ‘সেরা সেভ’ বলছেন। এরপর টাইব্রেকারে কিংসলে কোমানের শট ঠেকিয়ে মার্তিনেজ আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দেন। ক্লাব ফুটবলে মার্তিনেজ খেলেন অ্যাস্টন ভিলায়। বিশ্বকাপ শেষ হবার ঠিক দুই মাসের মাথায় (১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) আর্সেনালের সাথে এক ম্যাচে এই বিশ্বকাপ জয়ী গোলরক্ষক ৪ গোল হজম করেছেন। শুধু তা-ই নয় এর মধ্যে একটি ছিলো আত্মঘাতী- বল পোস্টে লেগে ফেরার সময় মার্তিনেজের অসতর্কতায় তাঁর মাথায় লেগে নিজের গোলপোস্টে ঢুকে যায়। তাই ভাগ্যে বিশ্বাসীরা বিশ্বেকাপের ফাইনালে মার্তিনেজের শেষ মুহূর্তের বিস্ময়কর ‘সেভ’কে আর্জেন্টিনার জন্য সৌভাগ্য ও ফ্রান্সের জন্য দুর্ভাগ্য মনে করছেন। তাহলে কি আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ে ভাগ্যের ছোঁয়া ছিলো?
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে একটা হিসেব দেখা যেতে পারে- আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে এসেছে ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে। এটা ছিলো ইতালির সাথে যৌথভাবে বিশ্ব রেকর্ড। ফাইনাল ম্যাচের আগে ফিফা র্যাংকিং- এ ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার অবস্থান ছিলো কাছাকাছি (যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ)। ফাইনাল ম্যাচে প্রথমার্ধে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করে খেলে ২-০ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। আঁতোয়া গ্রিজমান ও উসমান ডেম্বেলের মতো তারকা খেলোয়ারদের উঠিয়ে নিয়ে কোচ দিদিয়ের দেশম মুয়ানি আর মার্কোস থুরামকে নামিয়ে খেলার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটতে পারতো বিপরীত কিছুও। আক্রমন বাড়াতে গিয়ে উল্টো আরও গোল খেয়ে বসতে পারতো ফ্রান্স। ইতিহাসে মার্তিনেজ একাই যে এরকম সেভ করেছেন ব্যাপারটা সেরকম নয়। ২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের এরিয়েন রোবেন স্পেনের গোলরক্ষক ইকার ক্যাসিয়াসকে একইভাবে দুইবার একা পেয়ে গোল করতে পারেননি। এর একটিতে ক্যাসিয়াস মার্তিনেজের মতো মাটিতে শুয়ে পড়ে পা দিয়ে গোল ঠেকিয়েছিলেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের গোলরক্ষক বার্থেজ ৭ ম্যাচে মাত্র ২ টি গোল হজম করেছিলেন। সবচেয়ে কম গোল হজম করে বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড এটি। মার্তিনেজের সেভটিকে যেভাবে অবিশ্বাস্য বলা হচ্ছে আসলে হয়তো সেটা ততখানি ছিল না। ফিল্ড ক্যামেরার পাশাপাশি গ্যালারি থেকে কোনো এক দর্শকের নেওয়া এই ভিডিও ক্লিপ দেখলে বোঝা যায় মুয়ানি ভলি তুলতে গেলে বল মার্তিনেজের হাতের নাগালে থাকতো; এমবাপেকে বাড়াতে গেলে বল মাটিতে রিসিভ করার পর তা করতে হতো। ততক্ষণে তাকে তাড়া করতে থাকা ওতামেন্দি, রোমেরো, নায়ুয়েল বা রদ্রিগো গ্যাপ পূরণ করে ফেলতেন। (ভিডিয়ো দেখুন: https://www.facebook.com/reel/956921941941406)। এই ভিডিয়ো ক্লিপ দেখলে মনে হয় মুয়ানি সবচেয়ে ভালো বিকল্পটি-ই বেছে নিয়েছিলেন এবং মার্তিনেজ বুদ্ধি ও দক্ষতা দিয়ে সেটি ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
১৯৯২ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে পাকিস্তান গ্রুপ পর্বের প্রথম পাঁচ খেলায় কেবলমাত্র একটিতে জয়ী হয়। বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭৪ রানে অল-আউট হয়েও বৃষ্টি আইনে ১ পয়েন্ট সংগ্রহ করে এবং পরের তিন ম্যাচ জিতে গ্রুপ পর্বের চতুর্থ দল হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠে। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড ও ফাইনালে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান। পাকিস্তানের সাথে খেলায় ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য যখন ৫০ রান দরকার ছিল তখন বৃষ্টিতে খেলা পণ্ড হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের হাতে ছিল ৪২ ওভার ও ৯ উইকেট। ধরে নেওয়া যায় যে বৃষ্টি না হলে পাকিস্তান গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে যেতো। এটাকে কি আমরা পাকিস্তানের সৌভাগ্য হিসেবে ধরে নেবো? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে এই হিসাবটা দেখা যাক: নিউজিল্যান্ড পুরো টুর্নামেন্টে ম্যাচ খেলেছে ৯টি। এর মধ্যে তারা ৭টিতে জয়লাভ করেছে। ২ টি ম্যাচ হেরেছে। তাদের এই দুই পরাজয়-ই পাকিস্তানের কাছে- গ্রুপ পর্বে এবং সেমিফাইনালে। সে সময়ের অন্য দুই পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডকে যথাক্রমে গ্রæপ পর্ব এবং ফাইনালে হারিয়েছে পাকিস্তান। এখনও কি মনে হচ্ছে ১৯৯২-র ক্রিকেট বিশ্বকাপ পাকিস্তান ভাগ্যের জোরে জিতেছিল?
রবীন্দ্রনাথের জয় পরাজয় গল্পের অংশবিশেষ এরকম: “রাজা হাসিয়া প্রশ্ন করিতেন, “ভ্রমর কি কেবল বসন্তের রাজসভায় গান গায়।”
কবি উত্তর দিতেন, “না, পুষ্পমঞ্জরীর মধুও খাইয়া থাকে।”
এমনি করিয়া সকলেই হাসিত, আমোদ করিত; বোধ করি অন্তঃপুরে রাজকন্যা অপরাজিতাও মঞ্জরীকে লইয়া মাঝে মাঝে উপহাস করিয়া থাকিবেন। মঞ্জরী তাহাতে অসন্তুষ্ট হইত না। এমনি করিয়া সত্য মিথ্যায় মিশাইয়া মানুষের জীবন একরকম করিয়া কাটিয়া যায়- খানিকটা বিধাতা গড়েন, খানিকটা আপনি গড়ে, খানিকটা পাঁচজনে গড়িয়া দেয়। জীবনটা একটা পাঁচমিশালি রকমের জোড়াতাড়া, প্রকৃত এবং অপ্রকৃত, কাল্পনিক এবং বাস্তবিক।”
জীবনের খানিকটা ‘বিধাতা গড়েন’ কিনা সে বিষয়ে বিজ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যার সাথে ভাববাদী দর্শনের কিছুটা ভিন্নতা আছে। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি ইংরেজিতে ‘Luck’ শব্দটি এসেছে জার্মান ভাষার Geluck বা Luc থেকে যা মূলত জুয়া খেলায় জেতার সম্ভাবনাকে নির্দেশ করতো। পরবর্তীতে এটি ব্যক্তিগত ঘটনার সম্ভাবনাসূচক একটি শব্দতে রূপান্তরিত হয় যার উপকরণ আসে ধর্ম ও মিস্টিসিজম থেকে। কোনকিছু আমাদের অভিপ্রায় বা প্রত্যাশিত ফলাফলের বিপরীতে গেলে আমরা তাকে দুর্ভাগ্য বলি, পক্ষে এলে সৌভাগ্য বলি। ভাগ্যের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বাস থেকে এসেছে; কখনও আবার তা এসেছে কুসংস্কার অথবা ধর্ম থেকে। যেমন ‘১৩’ সংখ্যাটিকে অপয়া মনে করা হয়। যাঁরা ১৩-কে ভয় পান, তাঁদের এই ভীতিকে বলে ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া। বাইবেলে বলা হয়েছে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে যীশু যখন ‘লাস্ট সাপার’-এ বসেছিলেন তখন তাঁর সাথে ছিলেন ১২ জন অনুসারী। তাঁকে নিয়ে ১৩ জন। সেই থেকে শুরু। এর পরের কিছু অপয়া ‘১৩’কে এর সাথে মিলিয়ে ‘আনলাকি থার্টিন’ বানানো হয়েছে। আড়াই হাজার বছরের পুরনো হলেও ‘আনলাকি থার্টিন’ মুখে মুখে চালু হয়েছে মাত্র ৫২ বছর আগে- এপোলো -১৩-র চন্দ্র অভিযান ব্যর্থ হবার পর। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সব ১৩-তেই আমরা অপয়া খুঁজতে থাকি। ১৯১৯ সালের মে মাসের ১৩ তারিখ, মঙ্গলবার কোপা আমেরিকার লড়াইয়ে উরুগুয়ের কাছে ২-৩ গোলে হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৮০ সালের ১৩ মে তারা ইংল্যান্ডের কাছে হেরেছিল ১-৩ গোলে। ২০২২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হয় ১৩ ডিসেম্বর (আবার মঙ্গলবার)। আর্জেন্টিনার পত্রিকাগুলোতে একশ’ বছর আগের সেই ইতিহাস টেনে আনা হয়েছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনার জন্য আনলাকি কিছু ঘটেনি। আসলে এরকম করে কিছু ঘটেও না। আমরা যদি আমাদের জীবনের সবগুলো ভালো ও খারাপ ঘটনার তালিকা তৈরি করি তাহলে দেখবো মাসের সবগুলো তারিখে সেগুলো মোটামুটি সমানভাবে ঘটেছে।
রোমানরা তাদের ঘরে কাঠের তৈরি পবিত্র একটা কিউব রাখতো। তাতে লুডুর গুটির মতো ১ থেকে ৬ পর্যন্ত সংখ্যা লেখা থাকতো। দিনের শুরুতে কিউবটি তারা ঘরে রাখা ভাগ্য দেবী ফরটোনার পায়ের বেদিতে ফেলে দিয়ে দেখতো তিনি সারাদিন তাদের জন্য কতটা সৌভাগ্য জমা রেখেছেন: ১ হলে সর্বনি¤œ, ৬ হলে সর্বোচ্চ। এরকম বিশ্বাস থেকে শান্তি বা অশান্তি পাওয়ার প্রবণতা আমাদেরও আছে। আমি ছোটবেলায় বলতে শুনেছি আমার এক কাজিনের লুডু ভাগ্য খুব খারাপ। উপর্যুপরি কয়েকবার পরাজিত হবার কারণে হয়তো তার সম্পর্কে এরকম কথা চালু হয়েছিল। প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেট অধিনায়ক এম এস ধনি আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচে উপর্যুপরি ১১টি টস হেরেছিলেন। ২০১৭-১৮ সালে বিরাট কোহলিও পর পর ৮টি টস হেরেছিলেন। এটা কি তাদের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত? বিষয়টা এভাবে দেখা যেতে পারে: প্রত্যেকবার আলাদাভাবে তাঁদের হারার সম্ভাবনা ছিল ৫০%। সেটা ঘটেছে। জেতার যে ৫০% সম্ভাবনা ছিলো সেটা ঘটেনি। এখানে বিকল্প মাত্র দুটি। প্রত্যেকবার-ই হারার যে ৫০% সম্ভাবনা ছিলো সেটা কাকতালীয়ভাবে ঘটে গেছে, যা আমাদের বিস্ময় উৎপাদন করছে এবং ভাগ্যে বিশ্বাস জোরালো করছে।
আমাদের প্রত্যাশা/আশংকার বাইরে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটে গেলে সেটাকে আমরা ভাগ্য বলি। কেউ ট্রেনে কাটা পড়লে বলি সে দুর্ভাগা। অল্পের জন্য বেঁচে গেলে তাকে সৌভাগ্যবান বলি। আব্রাহিমিক ধর্মগুলোর দাবি অনুযায়ী এই ঘটনা দুটি পূর্ব নির্ধারিত। ঐ দুই ব্যক্তির জন্য এর বাইরে আর কিছু ঘটতে পারতো না। বিজ্ঞান (যেমন পদার্থবিদ্যা) এই দুটি ঘটনার ভৌত কারণ ব্যাখ্যার বাইরে কিছু করতে পারে না, কারণ এটা তাদের অধ্যয়নের বিষয় নয়। ট্রেনের গতি, ঐ লোকদের ট্রেন লাইন অতিক্রম করার গতি, ট্রেন ও লোকদের তুলনামূলক ভর— এরকম কিছু উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রথম ব্যক্তির কাটা পড়া এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির বেঁচে যাওয়ার কারণ নির্ণয় করা সম্ভব। যেমন প্রথম ব্যক্তি কতো গতিতে ট্রেন লাইন অতিক্রম করলে কাটা পড়ার হাত থেকে বেঁচে যেতো এবং দ্বিতীয় ব্যক্তি কতো গতিতে হাঁটলে কাটা পড়তো সেটা অঙ্ক কষে বের করা যায়। আবার ট্রেনের ভর যদি ১০ কেজি হয় তাহলে ঐ দুই জনের এক জনেরও কাটা পড়ার সম্ভাবনা থাকবে না। ভাগ্য বলে কিছু একটা আছে সেটা বিজ্ঞানের কোনো শাখায় মানা হয় না। ভাগ্য গণনায় জ্যোতিষীরা যে সংখ্যাতাত্তি¡ক পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বিষয়ে নিউমেরিক্যাল মিরাকলের যে দাবি করা হয় সেগুলো প্রায় শতভাগ মিথ্যা। অতি নগণ্য কিছু কাকতালীয় হিসাব বাদ দিলে এর বেশিরভাগ-ই জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা। যে কেউ ইচ্ছা করলে এরকম গাণিতিক মিরাকল তৈরি করতে পারে, বস্তুত যার কোনো অতীন্দ্রিয় উৎস নেই।
নমুনা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ৫ সংখ্যার প্রভাব সম্পর্কে আমার তৈরি করা একটা নিউমেরিক্যাল মিরাকলের উদাহরণ দেখুন: বঙ্গবন্ধু মীন রাশির জাতক ছিলেন। এই রাশির উজ্জ্বলতম নক্ষত্র-মৎস্যমুখ (৫ অক্ষর)। তাই মীন রাশির নির্বাণ সংখ্যা ৫। বঙ্গবন্ধুর মূল নাম-শেখ মুজিবুর রহমান (১০ অক্ষর, যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। তাঁর পিতার নাম-শেখ লুৎফুর রহমান (১০ অক্ষর, ৫ দিয়ে বিভাজ্য), মাতার নাম-মোসাম্মাৎ সায়েরা খাতুন (১০ অক্ষর, ৫ দিয়ে বিভাজ্য), জন্ম জেলা— ফরিদপুর (৫ অক্ষর), পুত্র কন্যার সংখ্যা— ৫। পুত্রদের নাম-শেখ কামাল (৫ অক্ষর), শেখ জামাল (৫ অক্ষর), শেখ রাসেল (৫ অক্ষর); কন্যাদের নাম-শেখ হাসিনা (৫ অক্ষর) — শেখ রেহেনা (৫ অক্ষর)। বঙ্গবন্ধু জন্ম-১৭ মার্চ, ১৯২০ (১৭+৩+১৯২০= ১৯৪০, যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য), মৃত্যু-১৫ই আগস্ট (১৫, ৫ দিয়ে বিভাজ্য), ১৯৭৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য )। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৫৫ বছর (৫ দিয়ে বিভাজ্য )। তিনি নিহত হন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় (৩+২=৫)। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি। ইধহমষধফবংয- এ অক্ষর সংখ্যা ১০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য)। বাংলায় ‘বাংলাদেশ’ এর অক্ষর সংখ্যা ৫। তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব (সরাসরি) পালন করেন ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫-১৫ আগস্ট ১৯৭৫ (এর সবগুলো সংখ্যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য)।
তিনি ১৯৪০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর ১১ মার্চ থেকে ৫ দিন জেলে থাকার পর তিনি ১৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) মার্চ মুক্তি পান। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ২ অক্টোবর থেকে ১২ অক্টোবর (১০ দিন) পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যোগ দেন (১০ ও ৩০, ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। তিনি ১৯৫৪-র যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক সরকারে কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন ১৫ই মে তারিখে (১৫, ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। আবার ‘মে’ বছরের ৫ম মাস। ১৯৫৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালের ৫ই জুন বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গণপরিষদের সদস্য হন। ১৯৫৫-র অক্টোবরে (বছরের ১০ম মাস) বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন (১৯৫৫ ও ১০, ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ১৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) জানুয়ারি পাক-ভারত বাণিজ্য চুক্তি সম্মেলনে যোগদান করার জন্য নয়াদিল্লি যান। ১৯৫৭ সালের ৩০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) মে (বছরের ৫ম মাস) মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৬৪ (১+৯+৬+৪=২০, ৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালের ২৫(৫ দিয়ে বিভাজ্য) জানুয়ারি আওয়ামীলীগের মহাসচিব নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনে ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন ৫ ফেব্রæয়ারি তারিখে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু সহ আসামী সংখ্যা ছিল ৩৫, অনুচ্ছেদ ছিল ১০০ টি (৩৫ ও ১০০, ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। ‘আগরতলা’র অক্ষর সংখ্যা ৫। ‘মুজিবনগর সরকার’ (১০ অক্ষর, ৫ দিয়ে বিভাজ্য) গঠিত হয় মেহেরপুরে (অক্ষর সংখ্যা ৫)। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় ১০ এপ্রিল তারিখে যার প্রথম বাক্যের শব্দ সংখ্যা ২৬৫ (১০ ও ২৬৫, ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। ১৯৬৯ (১+৯+৬+৯= ২৫, ৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে “বাংলাদেশ” নামকরণের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন ৭ মার্চ (বছরের ৩য় মাস) (৭+৩=১০, যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। ১৯৭১-র ১০ মার্চ ইয়াহিয়া খান বৈঠকের আমন্ত্রণ জানালে বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং ১৫ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের জন্য সুনির্দিষ্ট ৩৫টি নির্দেশনা জারি করেন (১০, ১৫ ও ৩৫, ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। এরপর ১৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ২৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) মার্চ গনহত্যা ঘটে। ২৬ মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন (২৬+৩+১৯৭১= ২০০০, যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। ১৯৭১-র ৫ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজউইক পত্রিকা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপে।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে (১+৬+১+৯+৭+১= ২৫ যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন ১০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের আমলে কারাভোগ করেন ৪৬৭৫ দিন (৫ দিয়ে বিভাজ্য)। তিনি ২৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন ৩০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) নভেম্বর। ১৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের ঘোষণা দেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় পদ্ধতির স্থলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন (১৯৭৫ ও ২৫, ৫ দিয়ে বিভাজ্য)। একই বছরের ২৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৭৩ (১+৯+৭+৩=১০, যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালের ২৩ (২+৩=৫) মে (বছরের ৫ম মাস) ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় শান্তি ও নিরাপত্তা সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও ক্যুরি’ (৫ অক্ষর) শান্তি পুরস্কারে ভ‚ষিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয় ২০১০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালে। ১৯৯৮ সালে প্রথম রায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে ১৫ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালের ২৮ (২+৮=১০, ৫ দিয়ে বিভাজ্য) জানুয়ারি ৫ জন আসামীকে এক সাথে ফাঁসি দেওয়া হয়। ২০১৭-র (২+০+১+৭=১০, যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য) ৩০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) অক্টোবর (বছরের ১০ মাস, ১০, ৫ দিয়ে বিভাজ্য) ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০২০ (৫ দিয়ে বিভাজ্য) সালে তিনি গান্ধী শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। [খেয়াল করে দেখুন, লেখকের নাম (হাসান গোর্কি) ও নিবন্ধের শিরোনাম (ভাগ্যলিপি ও সংখ্যাতত্ত¡) যথাক্রমে ৫ ও ১০ অক্ষরের, যা ৫ দিয়ে বিভাজ্য]।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।