হাসান গোর্কি : জীব জড়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে, প্রত্যক্ষণযোগ্য ব্যবধান আছে। ব্যবধানটা কি অলঙ্ঘনীয়? জীববিজ্ঞানীরা বলছেন, “না”। তাঁদের ধারণা, জড় থেকে জীবে রূপান্তর একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। পদার্থের আপাত ক্ষুদ্রতম কণিকা হলো পরমাণু যা মূলত ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে গঠিত। এগুলো স্থায়ী মূল কণিকা। শুধু হাইড্রোজেনের পরমাণুতে নিউট্রন থাকে না। এছাড়া সব পরমাণুতে ১০০-র মতো অস্থায়ী মূল কণিকা (নিউট্রিনো, এন্টি- নিউট্রিনো, পজিট্রন, মেসন) এবং কিছু সংখ্যক কম্পোজিট কণিকা (আলফা, ডিউটেরন) থাকে। আমরা জানি, জৈব বা অজৈব উভয় ধরণের পদার্থ পরমাণু নামক এই জড় উপাদানে গঠিত। পাথর, সাপের বিষ, গরুর দুধ, কোকাকোলা, সেলফোন, স্যাম্পেন, লোহা— সবকিছু তৈরি হয় একই উপাদান দিয়ে। শুধু আনবিক বিন্যাসে ভিন্নতার কারণে মধু ও বিষ পান ভিন্ন ফল দেয়। একটা পান করলে আমরা স্বাস্থ্যবান হই অন্যটা পান করলে মরে যাই। পাথর ও পাতার পরমাণুকে ভাঙলে আমরা কিছু অজৈব কণিকা পাবো; কারণ সকল কণিকা-ই অজৈব, প্রাণহীন বা মৃত। নিষ্ক্রিয়, কুঁড়ে, শ্রমবিমুখ, গেঁতো লোকদের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র সাহেবি ভাষায় গালি আবিস্কার করেছিলেন- ধীরূজ বা খট্বারুঢ়। কিন্তু এই নিষ্কর্মা কণিকাদের গালি দেওয়া অন্যায্য ও অবিধেয় হবে; কারণ তারা-ই মহাজতে প্রাণ প্রবাহ সচল রেখেছে। জড় থেকে জীবকে আলাদা করে বুঝতে পারার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রাণ বলতে আমরা কী বুঝি তা বুঝতে পারা। প্রাণের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: কোষের উপস্থিতি, বিপাক, বৃদ্ধি, অভিযোজন, প্রজনন, উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া দেখানো ও হোমিওস্ট্যাটিস (অভ্যন্তরীণ অবস্থা অপরিবর্তিত রাখার কৌশল; যেমন, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তা কমানোর জন্য ঘামা)।
কিন্তু প্রাণের সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। এব্যাপারে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে বিস্তর মতানৈক্য আছে; এমনকি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যেও ভিন্নতা আছে এবং বেশিরভাগ সংজ্ঞাই বিবৃতিমূলক। পদার্থবিদ্যা মনে করে অবধান, অভিরতি বা আসক্তি (affinity) আছে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে থাকা এরকম মৌলসমূহের সংগঠন জৈব যৌগ তৈরি করে এবং তাদের সুসংবদ্ধ আণবিক গঠন স্বতঃপ্রবৃত্তভাবে প্রাণের জন্ম দিতে পারে, প্রজননে অংশ নিতে এবং অন্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ২০১২-র মার্চে পদার্থবিজ্ঞানী লুটারমোজার, ডোনাল্ড জি. ইস্ট টেনেসি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক বক্তৃতায় দাবি করেছিলেন যে জৈব যৌগের আনবিক সংশ্লেষণ (নতুন মৌল যুক্ত হওয়া সাপেক্ষে) জটিলতর হওয়ার ধাপে ধাপে প্রাণ সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী হৃৎপিণ্ড চালু হওয়ার সময়কে প্রাণের সূচনা লগ্ন মনে করা হয়। কিন্তু জীব বিজ্ঞান বলছে, প্রাণ সৃষ্টি হয় ধারাবাহিকভাবে পর্যায়ক্রমিক কিছু জৈবিক সক্রিয়তা যুক্ত হবার মাধ্যমে। যেমন শুক্রাণু ও ডিম্বাণু স্বাধীনভাবে প্রাণ বা প্রাণের একক (যেমন দেহকোষ) না হলেও এদের মধ্যে প্রাণের লক্ষণ থাকে। জাইগোটে এবং ভ্রূণে সেই লক্ষণ আরও স্পষ্ট হয়। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার পর শ্বাস-প্রশ্বাস ও রেচন-নিঃসরণ শুরু হলে তখন সে একটা প্রাণির সকল শর্ত পূরণ করে। ভ্রূণে সেটা প্রায় পূর্ণ প্রাণের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত “What makes a planet habitable? শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে এইচ. ল্যামার ব্রিডিহফট দাবি করেছেন, তাপগতিবিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জীবন হলো একটি উন্মুক্ত ‘পদ্ধতি’ (শব্দটি মনে রাখুন) যা এর পারিপার্শ্বিকতা থেকে তার নিজের পূর্ণ অনুলিপি তৈরি করে থাকে।” এই দাবির সাথে প্রকৃতিবাদী জীববিজ্ঞানীদের প্রাকৃতিক উপগমন প্রবণতা তত্তে¡র মিল আছে। এই তত্তে¡র মূল কথা হলো, যৌগ (জৈব বা অজৈব) গঠনের ক্ষেত্রে পদার্থকণা এবং প্রাণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে জৈব যৌগ সমূহের মধ্যে পারস্পরিক আসক্তি কাজ করে। আনবিক রসায়নের বাইরেও পদার্থবিদ্যা জীবনের নানাবিধ সংজ্ঞা দিয়েছে। এসবের মূল কথা হলো, জীবন এমন একটি বস্তু সমষ্টির সুসংগঠিত ও স্ব-সংগঠিত (নিজে গঠিত হতে পারে এমন) ও সচল সমাহার যা ও স্ব-গঠনে (স্ব-প্রজনন) সক্ষম। এই সংজ্ঞাগুলো অনুযায়ী ‘প্রাণ’ পারিপার্শ্বিকতা থেকে তার নিজের পূর্ণ অনুলিপি তৈরি করতে পারে।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত The RNA world: life before DNA and protein গ্রন্থে জেরাল্ড এফ. জয়েস প্রাণ সৃষ্টির পেছনে প্রাকৃতিক উপাদান কেনো ও কীভাবে কাজ করে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এই পুস্তকে তাঁর দেওয়া সংজ্ঞাও ক্ষুদ্র (সম্ভবত ক্ষুদ্রতম) ও সোজা সাপ্টা- “জীবন হলো আত্মনির্ভরশীল রাসায়নিক পদ্ধতি যা এর পারিপার্শ্বিকতা থেকে তার নিজের পূর্ণ অনুলিপি তৈরি করে থাকে।” ভাইরাস জৈব কণা নাকি অণুজীব তা নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। এরা জৈব-রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে গঠিত হলেও অকোষীয় এবং বিপাক প্রক্রিয়া বিবর্জিত। ভাইরাসের দেহে কোনো নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম নেই, ফলে তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা নাই। তাই তাদের ‘প্রাণ’ মানতে রাজি নন বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগ অংশ। আবার অন্যরা মনে করেন তারা যেহেতু জিন ধারণ করে এবং নিজেদের অনুলিপি তৈরি করতে পারে তাই তারা ‘জীব’। তবে ভাইরাস জীব অথবা জড় যা-ই হোক জৈব অণুর স্ব-সন্নিবেশ যে প্রাণের জন্ম দিতে পারে জীব বিজ্ঞানীদের এই অনুসিদ্ধান্তের আধাআধি সমর্থন পাওয়া যায় প্রকৃতিকে তাদের উপস্থিতি থেকে।
আগেই বলেছি জীবনের একক ও ভালো কোনো সংজ্ঞা নেই। বরং সেগুলো অনেকটা বৈশিষ্ট্য বর্ণনার মতো। যেমন আমাকে কেউ যদি ভালবাসার সংজ্ঞা জিজ্ঞেস করে তাহলে হুমায়ুন আহমেদের আজ রবিবার নাটকের কাদেরের দেওয়া সংজ্ঞা ছাড়া আমার মাথায় কিছু আসবে না। সেক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে আমি সর্বোচ্চ যা করতে পারি তা হলো শিরি-ফরহাদের প্রেম কাহিনি পুরোটা শুনিয়ে বলতে পারি ‘এটাই হলো ভালবাসা’। জীবনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিজ্ঞানীরাও বাধ্য হয়ে একই কাজ করেছেন। কিছু বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়ে বলছেন, “এটাই জীবন”। জীবপদার্থবিজ্ঞানের দেওয়া সংজ্ঞা একটা অনুচ্ছেদের মতো, যা আমাদের কাছে অনেকটা দুর্বোধ্যও। সহজ কথায় ‘জীবিত বস্তু’ (এই শব্দ দুটিও মনে রাখুন) নেতিবাচক এনট্রপির উপর ভিত্তি করে কাজ করে। এনট্রপি হলো একটি থার্মোডাইনামিক পরিমাণ যা যান্ত্রিক কাজে রূপান্তরের জন্য একটি সিস্টেমের তাপীয় শক্তির অনুপলব্ধতার প্রতিনিধিত্ব করে। সেরহি এ. সকোলভ তাঁর “Why Is the Definition of Life So Elusive? Epistemological Considerations” গ্রন্থে লিখেছেন, “জৈবিক প্রক্রিয়াগুলোকে দেখা যেতে পারে জৈব অণুর অভ্যন্তরীণ শক্তির বিলম্বিত স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তার কিংবা বিচ্ছুরণ হিসাবে, যার মাধ্যমে এটি আরও সম্ভাব্য স্থায়ী একটি মাইক্রোস্টেটে পৌছায়।” এরভিন শ্রোডিঙারের ধারণা, “জীবন হলো এমন শ্রেণিভুক্ত ‘ঘটনা’গুলির (শব্দটি মনে রাখুন) সদস্য যা উন্মুক্ত কিংবা চলমান সিস্টেমগুলির অভ্যন্তরীণ এনট্রপি হ্রাস করতে সক্ষম, তবে সেটির বিনিময়ে সিস্টেমগুলি পরিবেশ থেকে বিনামূল্যে শক্তি কিংবা পদার্থ গ্রহণ করে যা পরবর্তীতে একটি অবনমিত রূপে পরিবেশে প্রত্যাখ্যান করে।” আমাদের প্রাণের মূলে রয়েছে ছয়টি মৌলিক পদার্থ- কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস ও সালফার। এগুলোর মধ্যে কার্বনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি; কারণ কার্বন নিজের সাথে নিজেকে যুক্ত করে যৌগিক অণু তৈরি করতে পারে। প্রাণের আরও মৌলিক উপাদান হয়তো ফসফরাস। কারণ এটি আমাদের ডি এন এ গঠন করে।
এবার মনে রাখতে বলা শব্দগুলো দেখুন- ‘পদ্ধতি’, ‘জীবিত বস্তু’, ‘ঘটনাগুলি’। শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে ‘প্রাণ’কে বুঝাবার জন্য। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা প্রাণকে ‘পদ্ধতি’, ‘জীবিত বস্তু’ বা ‘ঘটনা’ বলে মনে করেন। প্রাণ বলতে আমরা যে অতীন্দ্রিয় সচল অনুভূতি বুঝি বিজ্ঞানীরা সেরকম কিছুর অস্তিত্ত¡ আছে বলে মনে করেন না। তাদের অবিশ্বাসকে অবজ্ঞা করাও কঠিন। এতদিন আমরা জেনে এসেছি হৃৎপিণ্ডের সচলতা থেকে জীবনের শুরু। এক দল মার্কিন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ২০১০ সালে ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে মানুষের ত্বকের কোষ ব্যবহার করে হৃৎপিণ্ড তৈরি করেছেন। এবার রূহ সম্পর্কিত আমাদের জানা গল্পটার সাথে এই তথ্যটা মিলিয়ে দেখুন। খুব বড় ধরণের ধাক্কা মনে হচ্ছে? তাহলে আপনার জন্য আরও বড় ‘ধাক্কা’ অপেক্ষা করছে। হৃৎপিণ্ডটি তৈরি প্রক্রিয়ার মাঝের অংশ বাদ দিয়ে সচল হবার অংশ বলি- মানবদেহে স্থাপনের পর দুই সপ্তাহ সেটা কোষ বৃদ্ধি করে। যখন পূর্ণ আকৃতি পায় তখন এতে মৃদু বৈদ্যুতিক স্পন্দন সৃষ্টি করলেই সেটা চালু হয়ে যায়। এবার মাতৃগর্ভে হৃৎপিণ্ড চালু হওয়া সংক্রান্ত এতদিন আপনার জানা গল্পটার সাথে এই ঘটনা মেলান এবং এখানে অতীন্দ্রিয় কোনো শক্তির অংশগ্রহণের বিষয়ে আপনার বিবেচনায় ধারণা তৈরি করুন।
আত্মার ধারণা তৈরি হয়েছে সম্ভবত আমাদের চৈতন্যপ্রবাহকে বিশ্লেষণ করতে না পারার কারণে। আমাদের মস্তিকের নিউরোন সেলে থাকা তথ্যগুলোর সন্মিলিত মিথস্ক্রিয়া আমাদের চেতনার জন্ম দেয়। সেলগুলো নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করে জৈব বৈদ্যুতিক প্রক্রিয়ায়। মস্তিষ্কের দুই দূরতম প্রান্তে থাকা দুটি কোষ যোগাযোগ করতে চাইলে তা ঘটে এক ন্যানো সেকেন্ডের বিলিয়ন ভাগের একভাগ সময়ে। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে মস্তিস্ক যদি এক মিলিয়ন সেলেরও সহায়তা নেয় তাহলেও সেটা ঘটে ন্যানো সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। সেলগুলোর তথ্যের এই আদান প্রদান এতো দ্রুত ঘটে যে আমরা সেটাকে স্থির একটা কিছু বলে মনে করি। একটা ফ্যানকে খুব জোরে চালিয়ে দিলে তার বেøডগুলোকে আমরা আলাদাভাবে দেখতে পাই না; ফ্যানটাকে তখন একটা অস্পষ্ট স্থির বৃত্তের মতো দেখায়— বিষয়টা অনেকটা সেরকম। এর অন্য আর একটা উদাহরণ হলো শব্দ তরঙ্গ। ২০ কিলো হার্জের উপরের শব্দ তরঙ্গগুলি শ্রবণাতীত (আল্ট্রাসাউন্ড), আর ২০ হার্জ এর নিচের শব্দ তরঙ্গগুলি অবশ্রাব্য (ইনফ্রাসাউন্ড)। অর্থাৎ যদি কোনো বস্তু প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ২০ বার কাঁপে তবে সেই বস্তু থেকে উৎপন্ন শব্দ শোনা যাবে। এর কম হলে শোনা যাবে না।
বিপরীতপক্ষে কম্পন যদি প্রতি সেকেন্ডে ২০,০০০ বারের বেশি হয় তাহলেও কোনো শব্দ শোনা যাবে না (তবে প্রাণি ভেদে শ্রবণ মাত্রায় তারতম্য হয়)। আমাদের চিন্তন প্রক্রিয়াও অনেকটা সেরকম। এটা এতো দ্রুত গতিতে ঘটে যে তা আমাদের কাছে একটা প্রবাহের মতো অনুভূত হয়। চিন্তন প্রক্রিয়াটা যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত, মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান কম হবার কারণে সেটা আমরা বুঝতে পারি না। ফলে সেটাকে প্রথমত অনুভূতি এবং আত্মা বলে মনে করি। ‘আমি’ বলতে আসলে আলাদা কিছু নাই। আমাদের চৈতন্যপ্রবাহের সচলতা-ই ‘আমি’ নামের একটা সত্তার ধারণা তৈরি করে।
আত্মা যদি প্রাণের উৎস হয়ে থাকে তাহলে দেহের বাইরে এনে দেহকোষকে জীবিত রাখা যায় কীভাবে? মৃতদেহ থেকে সংগৃহীত হাড়, দাঁত, কর্নিয়া, কিডনি, হার্ট, ফুস্ফুস সহ আরও কিছু অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ জীবিত মানুষের শরীরে সংযোজনের আগে কিছু সময় সংরক্ষণ করা যায়। এসময় ঐ অঙ্গগুলির কোষ জীবিত থাকে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যায়। শরীরের বাইরে থাকা অবস্থায় তাদের এই কাজকর্মকে ‘রাসায়নিক’ মনে হয়। কিন্তু একই কাজ যখন তারা শরীরের মধ্যে থেকে করে তখন তাকে আমরা জৈবিক বলতে পছন্দ করি। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি বেশিরভাগ ডাক্তার ঈশ্বর বিশ্বাসী হন, কারণ মানব শরীরের বিস্ময়কর জটিল সংগঠন দেখে তারা উপলব্ধি করেন যে কোনো ইচ্ছাময়, বুদ্ধিমান মহাশক্তির নিখুঁত পরিকল্পনা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। ইচ্ছাময় মহাশক্তি যদি প্রাণবান কিছু তৈরি করতে ইচ্ছা করেন তাহলে তিনি এতো জটিল সংগঠন তৈরি না করেও সেটা করতে পারেন। শুধু মাংস-পেশী দিয়ে মানুষ (বা অন্য প্রাণি) তৈরি করেও তিনি তাদের একইরকম ক্ষমতা দান করতে পারতেন। বুদ্ধির জন্য মাথা, খাদ্য পরিপাকের জন্য পাকস্থলির দরকার হতো না। প্রাণি ও উদ্ভিদের এই জটিল অঙ্গ সংগঠন বরং এটা ধারণা করতে অনুপ্রাণিত করে যে তারা প্রাকৃতিক কারণে উদ্ভূত ও বিবর্তিত হয়ে এই পর্যায়ে এসেছে।
মানুষের শরীরের রক্তকণিকা শরীরে থাকা অবস্থায় মস্তিস্ক থেকে পাওয়া আদেশ (নাকি প্রত্যাদেশ?) অক্ষরে অক্ষরে পালন করে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রবাহিত হয়। তখন আমরা তাকে প্রাণের একটা একক মনে করি যা ‘আমি’ নামক কল্পিত আধিদৈবিক সত্তার ইচ্ছার অনুগমন করে। কিন্তু বøাড ব্যাংকে সংরক্ষিত থাকা অবস্থায় আমরা তাকে রাসায়নিক পদার্থ ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না। এরকম ঘটে মূলত একারণে যে ‘প্রাণে’ আমরা অতীন্দ্রিয় সত্তার একটা উপস্থিতি ও ভূমিকার কথা ভাবতে পছন্দ করি। মাতৃগর্ভে শিশুর উদ্ভব ও বেড়ে ওঠার আলোচনায় আমরা দেখেছি যে প্রাণ ধারাবাহিকভাবে বিকশিত হয়। আরও একটু পেছনে গেলে আমরা দেখবো নারী ও পুরুষদের শরীরে থাকা অবস্থায় যথাক্রমে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু প্রাণবান থাকে। জীব বিজ্ঞানীরা বলছেন, জৈব যৌগ থেকে পূর্ণাঙ্গ প্রাণিতে রূপান্তরিত হবার প্রক্রিয়াটা সাক্ষ্যমূলকভাবে পুরোপুরি প্রাকৃতিক। তাদের এই দাবির সাথে দ্বিমত পোষণ করার জন্য আমাদের হাতে কোনো উপাত্ত নাই। যা আছে তা একটা স্বর্গীয় বিশ্বাস। বাকি থাকে অজৈব যৌগ থেকে জৈব যৌগে রূপান্তর। এর জন্য যে রাসায়নিক আসক্তির কথা বলা হচ্ছে সেটা আসে কোথা থেকে? দার্শনিকদের একটা অংশ মনে করেন মহাজগতে, অ-সংজ্ঞায়িত ও সর্বব্যাপ্ত একগুচ্ছ প্রাকৃতিক বিধি বিরাজ করে মহাজগতের ওপর যাদের নিয়ন্ত্রণ অন্ধ কিন্তু অবশ্যম্ভাবী।
ধরা যাক আমি ১০ তলা বিল্ডিঙের ছাদ থেকে একটা পাথর নিচে ফেলে দিলাম। মাধ্যাকর্ষণের কারণে সেটা নিচে কোনো শিশুর মাথায় পড়ল এবং শিশুটা মারা গেলো। এখানে যে বিধিগুলো কাজ করেছে তা প্রত্যাহার বা সংশোধনের ক্ষমতা প্রকৃতির নাই। তাহলে বলুন, প্রকৃতি আছে কেনো এবং একগুচ্ছ বিধিই তাতে আছে কেনো? স্টিফেন হকিং এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, “বিধিগুলো আছে বলে আমরা আছি। আর আমরা আছি বলেই প্রশ্নটা করতে পারছি।“ আসলে মহাজগৎ থাকলে অবধারিতভাবে তার একটা বিধি থাকবে। হতে পারে সেটা সুশৃঙ্খল বা বিশৃঙ্খল। বর্তমান বিধিটাকে আমরা সুশৃঙ্খল মনে করছি। এটাকে বিশৃঙ্খল ভাবারও সুযোগ আছে (প্রান্তরে তেপান্তরে- ০৩)। বিধিবিহীন কোনো মহাবিশ্বের অস্তিত্বে থাকা সম্ভব নয়। ধরুন আমরা এমন একটা জগতে বাস করি যেখানে আপেল গাছ থেকে মাটিতে না পড়ে আকাশে উড়ে যায়; ১০০ ডিগ্রী তাপে পানি মাঝে মাঝে বাষ্প হয়, আবার মাঝে মাঝে বরফ হয়ে যায়, চাঁদ মাঝে মাঝে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা বন্ধ করে দেয়, আকাশে দুটি সূর্য পালাক্রমে আলো দেয়, জাম্বুরার মতো একটা ফলের মধ্যে মানব শিশুর জন্ম হয়। এরকম ক্ষেত্রে এই বিধিগুলোকে আমাদের কাছে বিশৃঙ্খল মনে হবে না; এখন যেমন মৃত্যু, শরতের শেষে বৃক্ষের পাতা ঝরা, সাইক্লোন, বার্ধক্য, মাধ্যাকর্ষণ, ঘুম, অভিমান— সবকিছুকে-ই নিয়মের অধীন এক আশীর্বাদপূর্ণ সুশৃঙ্খল অভিযাত্রার অংশ মনে হয়:
‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের
কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়।
তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে
মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’
(চার্বাক প্রভৃতি, জীবনানন্দ দাশ)
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।