অনলাইন ডেস্ক : করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে ১৪ মাস পর ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর এ শীর্ষ সম্মেলনে ৩৯টি বিষয়ে বক্তব্য আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে গণভবন থেকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লি থেকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।

দুই দেশের সম্পর্ক একটি ‘যুগান্তকারী মুহূর্ত’ অতিক্রম করছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ এবং ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাও ৫০তম বছরে পা রেখেছে।’

‘প্রতিবেশীর অগ্রাধিকার’ নীতিতে তার দেশ ভারত বিশ্বাসী উল্লেখ করে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারত সবসময়ই বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার প্রদান করে এসেছে। মোদি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করার এই নীতি দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই আমার অগ্রাধিকারে রয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে সহযোগিতামূলক ঐকমত্য রয়েছে তার সুযোগ নিয়ে দুই দেশই নিজ নিজ অর্থনীতিকে আরও সংহত করতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরতাকে আমরা আনন্দের সঙ্গে স্বীকৃতি দিই।’

এ বৈঠকের আগে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি, সামাজিক উন্নয়ন, কৃষিসহ সাতটি বিষয়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে সাতটি কাঠামো চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। আর ভার্চুয়াল বৈঠকে ৫৫ বছর পর বাংলাদেশের চিলাহাটি ও ভারতের হলদিবাড়ীর মধ্যে রেল করিডোরের উদ্বোধন করেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৬৫ সালে

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ওই রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, উভয় দেশ বিদ্যমান সহযোগিতামূলক ঐকমত্যের সুযোগ নিয়ে আমাদের অর্থনীতিকে আরও সংহত করে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ভ্যালু-চেইন সমৃদ্ধ করতে পারে। আমাদের চলমান যোগাযোগের উদ্যোগগুলো এ ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। এর অন্যতম উদাহরণ হলো ‘চিলাহাটি-হলদিবাড়ী’ রেল সংযোগ পুনরায় চালু করা।’ এ অনুষ্ঠানেই মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘এটা গর্বের যে, আমি মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর ডিজিটাল প্রদর্শনীর উদ্বোধন করতে পারছি। তারা আমাদের তরুণদের সবসময়ই উদ্বুদ্ধ করে যাবেন।’

চলতি বছর মার্চে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। তবে করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে মূল আয়োজন বাতিল হওয়ায় তার আর আসা হয়নি। আগামী বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এ বছর নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সংকটের এ সময়ে স্বাস্থ্য, কভিড-১৯, টিকার মতো বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কভিড-১৯ মহামারীতে বিশ্ব মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন এবং মানবজাতি কীভাবে এ অজানা শত্রুর মোকাবিলা করে তার পরীক্ষার মুখোমুখি। সম্ভবত কভিড-১৯ মহামারীর সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা। এ বছরের গোড়ার দিকে ঢাকায় আপনাকে স্বাগত জানানোর ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে। তবুও আমাদের গত শীর্ষ সম্মেলনের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী, এ ক্রান্তিকালীন উভয়পক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ যেভাবে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এগিয়ে নিয়েছে, তা প্রশংসাযোগ্য।’

শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের মাসে এ বৈঠক করতে পেরে তিনি আনন্দিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের কথা স্মরণ করে তার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

এ বছর মহামারীর মধ্যেও দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এ বছর জুড়ে রেলরুট দিয়ে বাণিজ্য, উচ্চপর্যায়ের পরিদর্শন ও সভা, সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারতীয় পণ্যসামগ্রীর প্রথম পরীক্ষামূলক চালান প্রেরণ এবং অবশ্যই কভিড-১৯ বিষয়ে সহযোগিতার ন্যায় বিভিন্ন উদ্যোগ আমরা গ্রহণ করেছি।’ বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত ও জনবহুল অঞ্চলে ভারত সরকার যেভাবে কভিড-১৯ মোকাবিলা করেছে সেজন্য মোদির সরকারের প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজগুলো ছাড়াও, “আত্মনির্ভর ভারত”-এর উদ্যোগে প্রবর্তিত অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলো প্রশংসনীয়। আমরা বিশ্বাস করি, আপনার গৃহীত নীতিমালার মাধ্যমে ভারত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’ ভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশেও আমরা এ মহামারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব উপশম করতে ১৪ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি। মার্চের গোড়ার দিকে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পর আমরা আড়াই কোটির বেশি মানুষকে সহায়তা প্রদানের জন্য সামাজিক সুরক্ষার আওতা সম্প্রসারিত করেছি। মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে ব্যাপক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ফলে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটা এবং ভোক্তাদের চাহিদা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে। তার কয়েক মাস আগে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশত জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশে উদযাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে বাপুজির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে একটি বিশেষ ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়েছে। আজ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাক বিভাগ একটি স্ট্যাম্পের উদ্বোধন করবে।’ এ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো যৌথভাবে উদযাপনের জন্য আগ্রহী হওয়ায় ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র স্মরণে আমরা বিশ্বব্যাপী বাছাই করা কিছু শহরে আগামী বছর জুড়ে যৌথ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় আপনার উপস্থিতি আমাদের যৌথ উদযাপনের গৌরবময় স্মৃতি স্মরণীয় করে রাখবে।’

সাত চুক্তি-সমঝোতা সই : জ্বালানি, সামাজিক উন্নয়ন, কৃষিসহ সাতটি বিষয়ে সহযোগিতার লক্ষ্যে সাতটি কাঠামো চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারকে সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল শীর্ষ বৈঠকের আগে গতকাল সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

হাইড্রোকার্বন খাতে সহযোগিতা এবং হাই-ইম্প্যাক্ট কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প চালুর বিষয়ে দুটি কাঠামো চুক্তি হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। হাতি সুরক্ষায় আন্তঃসীমান্ত অভয়ারণ্য তৈরি করতে একটি প্রটোকলে সই করেছেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। কৃষি খাতে সহযোগিতা, বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং নয়াদিল্লি জাদুঘরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সহযোগিতার বিষয়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে তিনটি সমঝোতা স্মারক। এছাড়া বাংলাদেশ-ভারত সিইও ফোরামের টার্মস অব রেফারেন্সও স্বাক্ষরিত হয়েছে।

বাংলাদেশের পক্ষে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কর্মকর্তারা এবং ভারতের পক্ষে ঢাকায় দেশটির হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এতে সই করেন। কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী খালিদ হোসেন ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শীর্ষ বৈঠকে এসব নথি স্বাক্ষরিত হওয়ার বিষয়টি জানানো হয়।