সাজ্জাদ আলী : তার “আনন্দ” যেন আজ খরস্রোতা নদীর বাঁধ ভেঙেছে। ফোনের অপর প্রান্তে সে খুশিতে একেবারে বাকবাকুম! এমনিতে কম কথা বলে, পাঁচটা জানতে চাইলে দুটোর জবাব মেলে। কষ্টের কথা তো বলবেই না, আনন্দ বলায়ও বেজায় কৃপণ। বিদ্যাধরি মেয়ে, নিজের যোগ্যতায় একাই কানাডায় এসেছে, মোটা বেতনের চাকরিও জুটিয়েছে। বিদ্যা-বুদ্ধির ঠেকা পড়লে আমি ওর দ্বারস্থ হই।
আজ আমার ভারি খুশি লাগছে ভাইয়া, ফোনের মধ্যে বললো তামান্না।
সে আর বলতে! তোমার গলা শুনেই বেশ বুঝতে পারছি। তা খুশির কারণটি বলে ফেল দিকি এবার? রাজীবের ভিসা হয়েছে বুঝি?

আরে না, কী যে বলেন আপনি! ওর ভিসা ওর খুশির কারণ। তখন সে কানাডা আসতে পারবে, আমার মতো একটা বউকে কাছে পাবে! আরো কত কী! রাজীবের সব খুশির বিবরণী কি আর ভেঙ্গে বলা যায়! আর ওর ভিসা লাগলে যদিও বা আমি নিভৃতে খুশি হই, সে কি আর আপনাকে ফোন করে বলতে যাবো? শরমে মরে যাবো না তাহলে! আপনি আজকের নিউজ হেডলাইন দেখেননি? হেলথ কানাডা করোনার ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দিলো যে!

হাঁ রে তামান্না, খবরটি দেখার পর থেকে আমিও বিপুল আনন্দে আছি। মনে বড় জোর পাচ্ছি গো। সেই ফেব্রæয়ারী থেকে ভীতুর মতো জীবন কাটাচ্ছি। মহা জরুরী ছাড়া কোথাও যাই না, হাতে গøভস, মুখে মাক্স, পকেটে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, -কী যে এক আতঙ্কের মধ্যে বসবাস, কী আর বলি তোমায়! শুধু আমি কেন, পুরো জগৎ সংসারইতো এক মহা শঙ্কার মধ্যে আছে। এবার এই ভ্যাকসিনটি বুঝি আমাদের আনন্দলোকে আবারও মঙ্গলআলো জ্বালবে।
কি জানেন ভাইয়া, গত ৮/৯ মাস ঘরে বসেই অফিস করছি। কোথাও বের হবার উপায় নাই। এত্তগুলান টাকা ঢেলে গাড়িখানা কিনলাম, শুধুমাত্র আপনাদের নিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াবো বলে। নইলে আমার বাসা থেকে অফিস তো হাঁটা দূরত্বে, একা মানুষ আমি গাড়ির তো কোনো প্রয়োজনই ছিলো না। পুরো গ্রীস্মকালটা আমার মতোই গাড়িখানাও বাড়িতে বসে কাটালো। না গেলাম আমি কারো কাছে, না এলো আমার কাছে কেউ। আসছে গ্রীস্মের আগে নিশ্চয়ই আমি ভ্যাকসিন নিতে পারবো। আর আমাকে আটকায় কে?

আমাদের তামান্নার মুখে ফুল-চন্দন পড়–ক। ওর এই আনন্দ-আশা যেন পূর্ণ হয়। আসছে গ্রীস্মের আগেই যেন কানাডার ঘরে ঘরে ভ্যাকসিন পৌঁছে যায়। ২০২১ সালের মধ্যে ধরিত্রীর প্রান্ত থেকে প্রান্তে যেন ভ্যাকসিনের জয়গান শুনতে পাই। এ জয় জ্ঞানের, এ বিজয় বিজ্ঞানের, এ অর্জন মানুষের! যাদের মেধার কল্যাণে এ যাত্রা ধরণী হেসে উঠলো, বিনম্র শ্রদ্ধা তাদের প্রতি। একা তামান্নাই নয়, করোনা ভ্যাকসিনের এই সুখবরে বন্ধু, স্বজন, পরিজন সবাই উদ্বেলিত। অন্ধকার সুড়ঙ্গের দূর প্রান্তে মঙ্গলআলো দেখছি যেন আমরা।
গত এপ্রিলে টরন্টোতে বন্ধু-শিল্পী সুপ্তির একটি একক চিত্র প্রদর্শনী হবার দিনক্ষণ ঠিক ছিলো। কিন্তু করোনার তাণ্ডবে শিল্পীর বেঁচে থাকাই তো দায়, তার আবার শিল্প প্রদর্শনী? সব ভণ্ডুল হয়ে গেল। গ্যালারীর দুয়ার বন্ধ, শিল্পীর তুলি রংয়ের ছোঁয়া পায় না। শিল্প রসিকদের দুঃসহ অপেক্ষা। আজকে টেলিভিশনে ভ্যাকসিনের সুখবর দেখেই সুপ্তি গদগদ। ফোন করে বলে,
এবার তাহলে আমার এক্সিবিশনটা করা যাবে, বলো? গ্যালারীওয়ালাদের সাথে তুমি কিন্তু কথা বলে রেখ, যেন প্রথম সুযোগেই আমরা ওদের হলটি পেতে পারি। জান, এই লক-ডাউনের মধ্যে ঘরে বসে প্রদর্শনীর জন্য নতুন ২১খানা ছবি একেছি।

বললাম, আচ্ছা সে হবেক্ষণ, ভেবো না তুমি। তবে এখনও তো সব কিছুই দূরাগত। এই অবসরে তুমি বরং আরো খানদশেক ছবি আঁকো। দেখ, প্যানডামিক নিয়ন্ত্রণে আসতে অন্তত অর্ধেক কানাডিয়ানের ভ্যাকসিনেট হওয়া দরকার। কিন্তু পর্যাপ্ত ডোজ তো এ মুহুর্তে সরকারের হাতে নেই। প্রথমে বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসরত নাগরিকেরা ভ্যাকসিন পাবেন। তারপরে ফ্রন্ট লাইনের স্বাস্থ্যকর্মী এবং তারও পরে জ্যেষ্ঠ থেকে শুরু করে কনিষ্ঠরা ভ্যাকসিন পেতে থাকবে। সে হিসেবে তোমার বাহুতে ভ্যাকসিন ঢুকতে আরো ক’মাস সময় তো লাগবেই। তুমি তো এখনও ছুড়িগোছের, বুড়ি হলে আগে আগেই পেয়ে যেতে।

করোনা প্যানডামিকের মধ্যে আমাদের স্নিগ্ধার বাবা আর রত্নার আম্মা চলে গেলেন। ট্রাভেল নিষেধাজ্ঞার কারণে ওরা কেউই টরন্টো থেকে দেশে যেতে পারেনি। মা-বাবার শেষ সময়ে পাশে থাকা বা শেষকৃত্যে যোগ দেওয়া; কোনোটাই ওদের কপালে জোটেনি। মাতাহারা সন্তানের করুণ আহাজারি ঘরের এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে আছড়ে পড়তে দেখেছি আমি। এবারে ভ্যাকসিন এলো, আশাকরি ২/৩ মাসের মধ্যেই আমাদের স্নিগ্ধাদের মতো হতভাগা সন্তানেরা দেশে ফিরে মা-বাবার শেষ চিহ্ন ছুঁয়ে দেখতে পারবে!

কানাডায় চেনাজানাদের মধ্যে সব বন্ধুরাই যে করোনা নির্মুল-সম্ভাবনায় খুশি হবেন, তা মনে হয় না। আমি দুপাঁচজন উচ্চশিক্ষিত সুপণ্ডিতকে জানি যারা গত ১০/১২ বছর কানাডায় থেকেও কোনোদিন রোজগার করেননি। যেন তেন কোনো চাকুরী করা অবশ্য তাদের সাজেও না। গভর্নর জেনারেল বা মন্ত্রী-মিনিস্টার, অগত্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যাঞ্চেলারের নিচে কোন চেয়ারে তো তাদের মানায়ও না। কত্তবড় পণ্ডিত না ওরা!

এই শ্রেণী নানা কলাকৌশলে তাদের পণ্ডিতি খাটিয়ে সরকারি দান-দক্ষিণায় বছরের পর বছর সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। করোনা লক ডাউনের ক্ষতি পোষাতে কেন্দ্রীয় সরকার খোটাবাছা না করে প্রাপ্ত বয়স্ক প্রত্যেককে (যারা ঘরে বসে কাজ করতে পারছেন তারা বাদে) ২,০০০.০০ ডলার করে মাসোহারা দিয়েছে। আমাদের ওই কর্মবিমুখ পণ্ডিতরাও স্বামী-স্ত্রী মিলে বাড়তি ৪,০০০.০০ ডলার মাসে মাসে পেয়েছে। তাদের দু:শ্চিন্তা হলো, ভ্যাকসিন যদি করোনাকে হটিয়ে দেয় তবে তো ওই বাড়তি মাসোহারাটিও হটে যাবে!

এই করোনা-ঝাপটা কিছু সত্যও প্রকাশ করেছে বটে। বিপন্ন মানব সভ্যতার রক্ষাকর্তা যে একমাত্র জ্ঞান এবং বিজ্ঞান, করোনা তা আমাদের চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেখিয়েছে। এ জগতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী একই কাতারে; সবাই জির্নশীর্ণ, নিরুপায়। তবে ধনিকেরা দুই শ্রেণীভুক্ত। মূর্খ ধনি আর জ্ঞানি ধনি। পৃথিবীর মানচিত্র মেলে ধরলেই দেখবেন যে মধ্যপ্রাচ্যের ধনকুবের আর ধনভাণ্ডার কিন্তু এই করোনা-সংকটে মানুষের কাজে লাগলো না। সভ্যতার ত্রাণকর্তা এবারেও কিন্তু পাশ্চাত্যের সেই তথাকথিত বিধর্মীরাই! এখন অপেক্ষায় আছি কতদিনে শুনবো সেই অমঘবাণী,
“ওরা তো আমাদের মহাগ্রন্থখানা রিসার্স করে তবেই ভ্যাকসিনটি আবিস্কার করলো!”
বন্ধুরা, আবার হেসে উঠবো আমরা, কর্মচঞ্চল হবে পৃথিবী, কলতানে মুখরিত হবে ধরা, সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে মানবতার জয়গান শুনতে পাবে নীলাকাশ! এ লেখার শুরুতেই শিরোনাম ধার করেছিলাম রবিবাবুর থেকে। সে দেনা আরো একটু বাড়িয়ে শেষ করি তবে,
সদা থাকো আনন্দে, সংসারে নির্ভয়ে নির্মলপ্রাণে ।।
জাগো প্রাতে আনন্দে, করো কর্ম আনন্দে,
সন্ধ্যায় গৃহে চলো হে আনন্দগানে ।।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)