মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
উনিশ.
অপরাজিত ছবির বাজেট ঠিক হয়েছিল এক লক্ষ ছয় হাজার টাকা। সিদ্ধান্ত হয় চিত্রনাট্য রচনা ও চিত্র পরিচালনার জন্য সত্যজিৎ রায় অর্থ পাবেন যেটা তিনি ‘পথের পাঁচালী’ করার সময় পাননি। কাহিনীর চিত্রস্বত্ব কিনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অগ্রিম টাকা দেওয়া হয়। তিনি শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন। ‘আমার স্বামী দেখে যেতে পারলেন না তাঁর উপন্যাস থেকে কি সুন্দর ছবি হতে পারে।’
‘অপরাজিত’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পূর্বে চলচ্চিত্র জগৎ ও দর্শক মহলে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। ১৯৫৬ সালের অক্টোবরে অমৃত বাজার পত্রিকার এক সংবাদে প্রকাশ হয়, ‘এ স্পেশাল শোয়িং অফ দ্য ফিল্ম উইল বি হেল্ড অ্যাট রাষ্ট্রপতি ভবন, নিউ দিল্লী, অন দ্য টেন্থ ইনস্টেন্ট। প্রাইম মিনিস্টার নেহেরু এন্ড শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধি আর লাইকলি টু গ্রেস অকেশন বাই দেয়ার প্রেজেন্স।…’ সেই সুবাদে পরের দিন সকালে সত্যজিৎ রায় এবং এপিক ফিল্মসের অমিয় মুখার্জি দিলী যান।
সেই বছরই ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অপরাজিত’ পাঠান হয়। কুরোসাওয়া, ভিসকান্তি, জিনেমান, নিকোলাস রে আর আঁদ্রে কায়াতের মত পরিচালকদের ছবির সাথে ‘অপরাজিত’ও প্রদর্শিত হয়। বিষয়টি সত্যজিৎ রায়ের জন্য খুবই উত্তেজনার একটি বিষয় ছিল। উৎসবের সেরা ছবি বাছাইয়ে তাঁর ছবি প্রতিযোগিতা করবে কুরোসাওয়া বা ভিসকান্তির মত পরিচালকদের ছবির সাথে। ভেনিস উৎসবে উপস্থিত দর্শক সমালোচক এবং জুরীর সদস্যরা সত্যজিৎ রায়ের ছবিটির ভূঁয়সী প্রশংসা করেন। ‘অপরাজিত’ ছবিটি এই ফেস্টিভ্যাল হিস্ট্রিতে প্রথম বারের মত একই ছবি গ্র্যান্ড প্রাইজ আর ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড পায়।
বলা যেতে পারে, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’ এবং দ্বিতীয় ছবি ‘অপরাজিত’ তাঁর জীবনের দুই বড় মাইলস্টোন। এই ছবি দুটি নির্মাণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ একই সঙ্গে সংগ্রাম, ব্যর্থতা, ধৈর্য-হতাশ, নিষ্ঠা, সাফল্য জনপ্রিয়তা ও আক্রমণের স্বাদ পেয়েছেন।
‘অপরাজিত’র শ্যুটিং এর সময় কাশীর ঘাটে দুর্ঘটনার জন্য তিন মাসের জন্য সত্যজিৎ রায়কে শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। তখনই তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জলসা ঘর’ গল্পটির সাথে তাঁর নতুন করে পরিচয় হয়। সত্যজিৎ বরাবর উনিশ শতকী বাংলার সামাজিক ইতিহাসে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ‘জলসা ঘর’ হচ্ছে তাঁর প্রথম ছবি সেখানে সেই উনিশ শতকী সংস্কৃতি আর স্বভাবের সমন্বয় দেখা যায়- যার শেষ পর্ব রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণে। ‘জলসাঘর’ সত্যজিতের নিজস্ব স্বভাবধর্ম প্রতিচিত্রণের আদি চলচ্চিত্র।
মুর্শিদাবাদের নিমতিতার জমিদার রায় চৌধুরীদের ভগ্ন প্রায় প্রাসাদোপম অট্টালিকাতে হয় লোকেশন শ্যুটিং। পরে সত্যজিৎ রায় জানতে পারেন এই বংশের উপেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী হলেন গল্পের বিশ্বম্ভর রায়ের চরিত্র চিত্রণের প্রেরণা।
জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের ভূমিকায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। সত্যজিতের কথায় ‘ছবি বাবুর মত অভিনেতা না থাকলে ‘জলসাঘর’ এর মতো কাহিনীর চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। ছবির শ্যুটিং চলাকালীন ছবি বিশ্বাস অভিনীত তপন সিনহার ছবি ‘কাবুলিওয়ালা’ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে মনোনয়ন পায়। ফলে ছবি বিশ্বাস বার্লিন যাওয়ায় তাঁর অনুপস্থিতে ছবি শ্যুটিং কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকে। সেই মুহূর্তে সত্যজিৎ একেবারে হাত পা গুঁটিয়ে বসে থাকতে চাইছিলেন না, ফলে তিনি রাজশেখর বসুর কমেডি, ফ্যান্টাসি, স্যাটায়ার, ফার্স আর প্যাথসের এক ধরনের সমন্বয়ে তৈরি গল্প ‘পরশ পাথর’ নিয়ে নতুন ছবিতে হাত দিলেন। গল্পের সময়টা ছিল ১৯৪৮ সালের কোলকাতা। একটি পরশ পাথর একজন কেরানীর ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে কি প্রভাব ফেলে এরই চমৎকার কৌতুকধর্মী উপস্থাপনা আছে এই ছবিটিতে। মূল চরিত্রে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় অনন্য।
‘জলসা ঘর’ এর আগেই ‘পরশ পাথর’ মুক্তি পায়। প্রথমটি ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে, পরেরটি অক্টোবরে। ‘জলসা ঘর’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক বিশ্বখ্যাত সেতার বাদক ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ। এরই মধ্যে ১৯৫৮ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সাধারণতন্ত্র দিবসে সত্যজিৎ রায়কে পদ্মশ্রী উপাধিতে সম্মানীত করা হয়। ভাবতেই অবাক লাগে যে সত্যজিতকে তিন চার বছর আগে তাঁর প্রথম ছবি বানানোর জন্য কি বিশাল সব বাঁধা পেরুতে হয়েছে, সেই সত্যজিৎ একেবারে রাষ্ট্রের সম্মানীত সম্মানে ভূষিত হলেন।
‘অপরাজিত’র দ্বিতীয় পর্ব ছবি করার সময় সত্যজিৎ তার নাম দিলেন ‘অপুর সংসার’। আগের দুটো ছবি, ‘পরশ পাথর’ এবং ‘জলসাঘর’ এ সত্যজিৎ পরিচিত আর পেশাদার অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন। সেখানে প্রথম কাহিনী নির্বাচনের প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল তুলসী চক্রবর্তীকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করা। সত্যজিৎ এ ব্যাপারে বলেছিলেন, ‘আই ওয়ান্টেড টু মেক এ ফিল্ম উইথ তুলসী চক্রবর্তী, ভীষণভাবে নেগলেক্টেড ছিলেন’। দ্বিতীয় ছবি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ন্যাচারলি এক ধরনের থিয়াট্রিক্যাল প্রফেশনাল অভিনয়ে ছবি বিশ্বাস খুব পাকা ও দক্ষ ছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, ‘জলসাঘর’-এ বিশ্বম্ভর রায়ের যে চরিত্র, তাতে হয়ত খাইয়ে যাবে।’
‘অপুর সংসার’ করার সময় সত্যজিৎ ঠিক করেছিলেন প্রধানত নতুন মুখ নিবেন। তাঁর ফিল্ম ইউনিটের এক কর্মী নিয়ে এসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। সৌমিত্র তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ কাসের ছাত্র। মঞ্চে কাজ করেন আর আকাশ বাণী’র কলকাতায় ঘোষকের কাজ করছেন। অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য অভিনেত্রীর খোঁজে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। অনেক আবেদন আসার পরও কাউকে সত্যজিতের চরিত্রটার সাথে যোগ্য মনে হয়নি। তবে খোঁজ পাওয়া গেল চিলড্রেনস লিটল থিয়েটারে এক বালিকাকে নৃত্যাভিনয়ে দেখা গেছে; তার সঙ্গে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সম্পর্ক আছে। তাঁর ছোট বোন ঐন্দ্রিলা বা টিংকু ঠাকুর তপন সিংহ-র ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে অভিনয় করেছেন। মেয়েটির বাবা গীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মা ইরা ঠাকুর সত্যজিতের পরিচিত। সত্যজিতের লেক অ্যাভিনিউর বাড়ীতে ঠাকুর দম্পতি তাঁদের কন্যা শর্মিলাকে নিয়ে এসেছিলেন। সেদিন তাঁর পরনে ছিল হলুদ রঙের ফ্রক আর মাথায় বব-ছাঁট চুল। বিজয়া রায় মেয়েটাকে শাড়ী পরিয়ে গ্রামীণ অপর্ণার সাজে সাজাতেই শর্মিলা হয়ে গেল আদ্যন্ত অপর্ণা। ‘অপুর সংসার’-এর শ্যুটিং শুরু হল ১৯৫৮ সালের ৯ আগস্ট।
১৯৫৯ এর ১ মে ‘অপুর সংসার’ মুক্তি পেল। ১৯৫৯ সালের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে এটি রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক পেল। তা ছাড়া বছরের সবচেয়ে মৌলিক চলচ্চিত্র হিসেবে ছবিটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সাদারল্যান্ড ট্রফি পায়। ছবিটি বক্স অফিসের বিরাট সাফল্য পেয়েছিল।
১৯৫৯-এ প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এর গল্প ‘দেবী’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র করার সিদ্ধান্ত নেন সত্যজিৎ রায়। হিন্দু সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কারকে কুঠারাঘাত করেছেন তিনি চল”িচত্রের মাধ্যমে। সম্ভবত তিনি যেহেতু কুসংস্কারে একেবারে বিশ্বাসী ছিলেন না সে জন্য হিন্দু সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার সম্পর্কে মানুষের চেতনা খুলে দেওয়ার জন্যেই তিনি এই ছবিটি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। জীবন বিমুখ ভক্তিতত্তে¡র দ্বারা আচ্ছন্ন মন যে কি নিদারুণ ট্রাজেডির কারণ হতে পারে সেই কথাটাই মূলত এই কাহিনীতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘দেবী’র লেখক প্রভাত কুমার তাঁর কাহিনীর পটভূমিরূপে গ্রহণ করেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের বাংলাদেশ। সে বাংলাদেশে একদিকে যেমন ছিল প্রাচীন ধর্মীয় গোঁড়ামির অজ্ঞতা, তেমনি অন্যদিকে ছিল ইংরেজী শিার প্রভাবে নবোন্নীলিত, সংস্কারমুক্ত নব্য যুব স¤প্রদায়। ‘দেবী’ সেই যুগেরই একটি জমিদার গৃহের কাহিনী। যেখানে এই দুই বিপরীতমুখী ধারার সংঘাতে ট্রাজেডির উদ্ভব হয়। ১৯৬০ সালে ‘দেবী’ শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পায়।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষ পালনের জন্য ভারত সরকারের উদ্যোগে এক কমিটি তৈরি হল ১৯৫৮ সালে। সেই কমিটি থেকে সত্যজিৎকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের ভার দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনের মূল অনুষ্ঠানে ছবিটি দেখানো হবে। তবে কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য সত্যজিৎকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনের ওপর তথ্যচিত্রের বিরোধিতা করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, সত্যজিৎ রায় একজন মূলত চলচ্চিত্রকার, তিনি ইতিহাসবিদ নয়। ফলে তাঁর দ্বারা এমন একটা কাজ যথার্থভাবে করা সম্ভব নয়। শতবার্ষিক কমিটির সভায় চেয়ারম্যান ছিলেন তদানিন্তন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের ঐতিহাসিকের দরকার নেই, আমাদের দরকার একজন শিল্পীর। নেহেরু আরো বলেছিলেন, ‘সত্যজিৎ রায় সেই মানুষ, কোন ইতিহাসবেত্তার তাঁর কাজে হস্তপে করার দরকার হবে না।’ বড় বেশি ভালোবাসতেন জওহরলাল নেহেরু সত্যজিৎ রায়কে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর যে শোকযাত্রা বেরিয়েছিল তা দিয়েই তথ্য চিত্রের শুরু। তারপর ধীরে ধীরে কবির বংশ, পরিবার, বাল্যকাল, যৌবন, বার্ধক্যে তাঁর বিচিত্র প্রতিভার তথ্যাদি উপস্থাপিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রে সংগীত, দৃশ্য, ভাষা ছাড়াও তার আকর্ষণীয় দিক হল, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাংকন; পান্ডুলিপির কাটাকুটি থেকে শিল্পী হিসেবে উত্তরণ এবং শেষ দৃশ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে সভ্যতার সংকট ভাষণটির স্থাপনা।
৫৪ মিনিটের এই তথ্যচিত্রের দৈর্ঘ্য নিয়ে ভারত সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সমস্যায় পড়েছিল। ঠিক হয়, এই রাজ্যে সত্যজিতের কণ্ঠে ভাষ্যসহ পূর্ণাঙ্গ ছবিটি দেখানো হবে; অন্যত্র ২০ মিনিটের সম্পাদিত তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হবে। ১৯৬১ সালে ৫ মে দিলীতে ছবির মুক্তির সময়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘আই ডিড অ্যাজ সাচ ওয়ার্ক অন ইট অ্যাজ অন থ্রি ফিচার ফিল্মস। মাই অ্যাপ্রোচ টু দ্য বায়োগ্রাফি ওয়াজ টু স্ট্রেস টেগোর অ্যাজ এ হিউম্যান বিইং এন্ড পেট্রিয়ট।’ রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রটি এ দেশে এবং বিদেশে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছিল। মুক্তির পর ছবিটি দিলীতে সরকার এবং বিদেশী মিশনের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রদর্শিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সত্যজিতকে একটি রৌপ্য ফলক উপহার দেন। ছয় রিল এবং ৪,৮৪৪ ফুটের তথ্যচিত্র এমনই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, ছবিটি শেষ হবার পরও নেহেরু এবং ড. রাধাকৃষ্ণন বেশ কিছুক্ষণ নীরবে বসেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রের শুরুর এক বছর আগে সত্যজিৎ ১৯৬০-এর আগস্ট এ ‘তিন কন্যা’র শ্যুটিং শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিনটি ছোট গল্প; মনিহারা, পোস্ট মাষ্টার এবং সমাপ্তি নিয়ে এই ছবিটি তৈরি হয়।
পোস্ট মাস্টার গল্পটির শ্যুটিং আগে শেষ হয়। এখানে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় এবং রতনের চরিত্রে চন্দনা বন্দ্যোপাধ্যায়, এক নৃত্য শিার স্কুল থেকে তাকে নির্বাচন করা হয়েছিল। তার অভিনয় এত বেশি সুন্দর ও প্রাণবন্ত ছিল যে, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মত অভিজ্ঞ অভিনেতার অভিনয়ও ম্লান হয়ে গিয়েছিল। ‘তিনকন্যা’ ছবির স্মরণযোগ্য প্রসঙ্গ হল যে, এই ছবিতে সত্যজিৎ রায় প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
‘তিনকন্যা’ ছবির ‘পোস্ট মাস্টার’ এর পর ‘সমাপ্তি’-র শ্যুটিং হয়। এখানে মূল ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অপর্ণা দাশগুপ্ত। অপর্ণাকে নির্বাচনে সাহায্য করেছিলেন বিজয়া রায়। অপর্ণা ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম প্রধান সংগঠক চিদানন্দ দাশগুপ্তের কন্যা। এই ছবিতে অপর্ণার অভিনয় সম্বন্ধে সত্যজিৎ একটু অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দ্য ওনলি ট্রাবল ওয়াজ হার অ্যাকসেন্ট ইন বেঙ্গলি হুইচ ওয়াজ রাদার সোফিসটিকেটেড।’ তুবও অপর্ণার চেহারা ও অভিনয় ‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ীকে জনপ্রিয় করেছিল।
‘মনিহারা’য় অভিনয় করেছেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কণিকা মজুমদার। ‘মনিহারা’-র উলেখযোগ্য অংশ হল এর সঙ্গীতের ব্যবহার। সত্যজিৎ তাঁর চলিশ বছর বয়সের জন্মদিনের পর দিন ‘তিনকন্যা‘ ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরীতে দেখালেন। ‘তিনকন্যা‘ ছবিটিও প্রচুর দর্শকপ্রিয়তা পেল কিন্তু বিদেশে ছবিটি দৈর্ঘ্যরে কারণে পুরো দেখানো সম্ভব হয়নি। ‘মনিহারা’-কে বাদ দিয়ে ছবিটির নাম টু ডটারস্ করে ছবিটি প্রদর্শিত হয়। (চলবে)