মণিজিঞ্জির সান্যাল : ছোট ছোট মুহূর্তগুলো নিয়েই আমাদের জীবন, আমাদের ভালো থাকা, আমাদের ভালো লাগা। একটা করে দিন চলে যায় আর আমরা যেন এই পৃথিবীর কাছে ঋণী হয়ে পড়ছি প্রতিনিয়ত। ঋণী হয়ে পড়ছি কিছু মানুষের কাছে। মাঝে মাঝে সময় পেলেই ছুটে চলে যাই ঐ দূর পাহাড়ে বা গভীর জঙ্গলে। যাই এ কারণেই জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখব বলে। জীবনকে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করব বলে।

সময় সুযোগ পেলে বা ভ্রমণের নেশায় অনেকেই হয়তো চলে যায় প্রকৃতির মনোরম শোভা উপলব্ধি করতে। কিন্তু হৃদয় দিয়ে কতজন আমরা সেখানকার মানুষের জীবনকে বুঝতে পারি। আদৌ বোঝার চেষ্টা করি কি?

পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে কতো স্থানীয় মানুষের সাথে পরিচয় হয়। পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ কিভাবে জীবন অতিবাহিত করছে। কাছে পিঠে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, নেই যানবাহনের ঠিকঠিক ব্যবস্থা। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা অপেক্ষা করে থাকে কখন গাড়ি আসবে কিম্বা সেই গাড়ির দেখা মিললেও দাঁড়াবে কি? তাই পা দুটোই একমাত্র শেষ ভরসা। তাই তারা সেই পা দুটোর ওপর ভরসা করেই আর মনের সমস্ত জোরকে অবলম্বন করে চলতে থাকে আপনমনে, আপন খেয়ালে বয়ে যাওয়া নদীর মতো। পাহাড়ের মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ মুখের হাসি। সমস্ত ব্যথা যন্ত্রণাকে অনায়াসেই একপাশে সরিয়ে রেখে, জীবনকে অন্য রঙে-অন্য ছন্দে কাটাতে চেয়েছে আজীবন। জীবন মানেই যে টাকা পয়সার লেনদেনের খেলা তা নয় বরং জীবন মানে তাদের কাছে একটা মুক্ত আকাশ, মুক্ত বাতাস; সবাই মিলে মিশে একসাথে থাকার অঙ্গীকার। জীবনকে কতো রূপে তাই দেখতে চেয়েছে।
মাঝে মাঝে মন অনেক কিছু বলতে চায় কিন্তু সেটা কি? সে তো নিজেই জানে না। জানা আর না জানার মাঝামাঝি কতো নদী, কত পাহাড়, কত পাহাড়ী ঝরণা, বুনো ফুল, হাতির দংগল, আর ওই সেই শান্ত ঘিস নদী। এই নদীটি আমার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝেই ছুটে যাই আমার প্রিয় এই নদীটির কাছে। আচ্ছা মাটি কি মানুষের প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে? করে তো বটেই, ঐ যে বলে নরম মাটি। আসলে এই মাটিতে থাকা মানুষগুলো মনের দিক থেকেও বেশ নরম, মোলায়েম, যার সাথে দু দন্ড কথা বলা যায়। পাহাড়ের মানুষের অনাবিল মুখের হাসি মানুষগুলোকে অনেক কাছে এনে দেয়, মনে হয় যেন একেবারে এক অন্য গ্রহের বাসিন্দা। এতো অভাবের মধ্যেও কি সুন্দর তার মুখের হাসি যেন বলতে চায় ঈশ্বর যা দিয়েছেন তাতেই আমি খুব সুখী। আসলে প্রকৃতিই মানুষকে গড়েছে তার মতো করে। রু² মাটিতে থাকতে থাকতে অনেক সময় মানুষ যেন বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল মারে, সে নিজেও বোঝে না তার আদিম ভয়ানক প্রচ্ছন্ন রুপটাকে, কি বিশ্রী আর কি ভয়ানক সেই রুপ। একদিন আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই চমকে ওঠে। নিজের মনকে নিজেই চিনতে পারে না। তারপর কোনো একদিন মনের মধ্যে জন্মায় এক হতাশার বীজ, জীবন তাকে এই ভাবেই শিক্ষা দেয়।

পাহাড়ী মন উড়ে যায় অনেক দূর, যেখানে নেই কোনো বিষাক্ত প্রতিযোগিতার খেলা, নেই কোনো দ্ব›দ্ব, বিদ্বেষ, নেই কোনো হিংসা, আছে শুধু নরম মাটির খেলা, যে মাটিতে ভর দিয়ে অনেকটা পথ চলা যায়।

শুকনা জঙ্গল ছাড়িয়ে রংটং একটা ছোট্ট গ্রাম। আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোতেই পরিচয় হল ছোট্ট ছেলে রণিতের সঙ্গে, ক্লাস ফাইভে পড়ে। ঠাকুমা দাদুর সাথে যাচ্ছিল গোটা চল্লিশ ছাগল নিয়ে। জানতে পারলাম এগুলো তাদেরই; পরে অনুষ্ঠানে বিক্রি করে দেওয়া হয়; এই হল জীবিকা। মুখে অ¤øান হাসিটুকু কিন্তু রয়ে গেছে, জীবন সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক কথা তো নেইই বরং জীবনকে ভালোবেসে কতো কথা শোনালো।

গিয়েছিলাম দার্জিলিং জেলার একটি ছোট্ট গ্রাম তাকদা। আমি এই গ্রামটিতে গিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম জীবন কি; জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি-ই বা কি। শুধু মাত্র নির্জনে নিজের সুখের জন্য বা একটু বিশ্রামের জন্যে যে সেখানে ছোটা তা কিন্তু নয়, বরং পৃথিবীর কিছু কিছু মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখতে চেয়েছিলাম। বাঁচার জন্যে খুব বেশি কিছুর দরকার নেই। দরকার শুধু একটা বিরাট হৃদয়।

নির্মল প্রধান

আসলে মানুষের চাওয়া পাওয়ার উপরেই তো নির্ভর করে আমাদের জীবনের সুখ। আসলে এই সুখ নামক অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয় আমাদের মন নামক চালকের মাধ্যমে। ভাল আছি, ভাল থাকব এই বোধটা তো আমাদের হৃদয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

পাহাড়ে, জঙ্গলে বেড়াতে তো সবাই যায় , যায় ছুটি কাটাতে। কিন্তু দুর্গম সেই জায়গার মানুষ যে কিভাবে জীবন কাটায় খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না কিছুতেই। জীবন মানে যে শুধুই গাড়ি বাড়ি আর রেস্তোরাঁ নয় ; জীবন মানেই যে শুধু আভিজাত্যের মোড়ক নিজেকে আবদ্ধ রাখা নয় বরং জীবন মানে যে সবাই মিলে মিশে একসাথে অনেকটা পথ কাটানো। একসাথে সুখে দুঃখে একে অপরের সঙ্গী হওয়া, পর্বতের চড়াই উৎরাই পথ বেয়ে অনেকটা পথ হাঁটা…
এমনই কিছু জায়গায় যেতে যেতে আবিষ্কার করেছিলাম পাহাড়ের একটি নির্জন গ্রামকে। অসাধারণ নির্জন তাকদা এবং চমকে দেওয়া উপহার; সঙ্গীহিসেবে মনোরম কুয়াশা ঘেরা এক সন্ধ্যা …
একটা শুধু একটাই ছবি তুললাম অবশেষে; সে প্রকৃতির পাশে নিজের ছবি তুলতে বড় লজ্জা করে, খুব তুচ্ছ মনে হয় নিজেকে। চারপাশে প্রকৃতির এতো সৌন্দর্যের পাশে প্রাণভরে শুধু অক্সিজেনটুকুই নেওয়া যায়।

ঘরে ফেরার পথে মনটা কেমন করে। আসলে বেড়াতে গেলে হৃদয় দিয়ে অনুভব করি জীবনকেও। যেখানেই যাই মনটাকে মিশিয়ে দিই সেখানকার মাটি আর মানুষগুলোর সাথে।
অদ্ভুত ভালোবাসা পাই প্রতিবার-ই। এবারেও একটা ঘটনা ঘটল সন্ধ্যাবেলা ঘন কুয়াশায় অসাধারণ মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া ছেড়েছে তখন। আমরা হাঁটছিলাম ধীরপায়ে। এক দোকানে চকলেট, চিপস এসব কিনতে গিয়ে গল্প শুরু হল। নেপালি সেই বিক্রেতা দাদার অমায়িক ব্যবহার কখনো ভোলার নয়। নাম নির্মল প্রধান। তাঁর দোকানের নাম নির্মল স্টোর। অনেকটা সময় কাটালাম, কতো গল্প, কতো আড্ডা হলো। ওখানকার ইতিহাস শুনলাম প্রাণ ভরে। শোনালেন নিজের জীবনের কথা। কতো সংগ্রাম করে ছোট্ট থেকে ধীরে ধীরে একটা বড় স্টেশনারি দোকান করেছেন কিন্তু মনে কোনো যন্ত্রণা নেই, অমলিন হাসি। কারো প্রতি কোনো অভিযোগ নেই, অভিমান নেই। রাজনীতির কোনো আলোচনা নেই। দুই মেয়ে ঐ প্রতিক‚ল পরিবেশেও উচ্চ শিক্ষিত। সহজ সরল জীবনের বার্তা দিলেন মুখের হাসি দিয়ে। ওখানে সবাই হাসে, মনটা হালকা হয়ে যায় তাই। জীবনের ভারী মেঘগুলো কেটে যায় অনায়াসেই।
আবারও একমুখ হাসি নিয়ে বিদায় জানাবার সময় বললেন, “আবার আসবেন কিন্তু …”
মনে হচ্ছিল বহু বছরের চেনা কোনোজন। বহু যুগ ধরে তার গল্পই যেন শুনে এসেছি। নিজেরই লেখা একটি কবিতা মনে পড়ে গেল…
এক একটা সময়কে
খুব চেনা মনে হয়
মনে হয় বহু যুগ ধরে ওরা মিশে আছে
আমার সমস্ত অনুভূতির ভেতর
এক একটা অনুভূতিকে
আমার খুব চেনা মনে হয়
মনে হয় ওরা বহু যুগ ধরে মিশে আছে
আমার সমস্ত অস্তিত্বের কাছাকাছি

কিছু শব্দ ভিড় করে আজকাল
চেনা অচেনার মাঝামাঝি বিলাসী দুপুর
ফুটে ওঠে কতো ছবি
ভেসে ওঠে পদাবলী সুর
অদ্ভুত হৃদয় দিয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলছিলেন। কতো গল্প -কতো কথা। বেশ কিছু জিনিস কিনেছিলাম তাঁর দোকান থেকে। ফেরার পথে তিনি নিজেও দোকান ছেড়ে আমাদের সঙ্গে কিছু পথ হাঁটলেন।
পরে ফিরে প্যাকেট খুলতেই আবিষ্কার হল আরো একটা বিশাল বাদামি রং-এর প্যাকেট। আমাদের কথার ফাঁকে কখন যে এই বিরাট বড়সড় প্যাকেটটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে খেয়ালই করিনি।
বাদামি রংএর প্যাকেটটা খুলতেই চমকে উঠলাম। অসাধারণ দার্জিলিং চা!
সখী ভালোবাসা কারে কয়!
এ ঋণ শোধ করি কিভাবে …
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, ভারত