শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’-এ বের হবে।

শারমীন শরীফ : মনিরা আজ একটু সকাল সকাল কাজে এসেছে। কিছু শিফট খালি ছিল সেগুলো ফিল আপ করা হয়নি। আজ ওর ৮ তলায় কাজ পড়েছে। কাজের জায়গাটা মনিরার খুব ভাল লাগে, একটা নার্সিংহোমে কাজ করে সে। কতগুলো অসহায় বৃদ্ধ মানুষ কি অস্থির হয়েই না অপেক্ষা করে ওদের সাহাযের জন্য। শীত আসি আসি করছে; এরকম সকালগুলোয় মনিরার মনটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো কেমন হুহু করে ওঠে বুকের ভেতর। মনে হয় কি যেন থাকবার কথা ছিল, কি যেন নেই। এখন ফল চলছে, বাংলায় মনে হয় ফল কে হেমন্ত বলে, চারিদিকে গাছের পাতায় শুরু হয়েছে লাল – হলুদের খেলা; ভীষণ ভীষণ সুন্দর এই সময়টা। একটু একটু করে শুরু হয়েছে পাতা ঝরা। খুব সকালে বাস থেকে নেমে মনিরা যখন সেই পাতার উপরে কুড়মুড়ে শব্দ তুলে হাটে আর, সাথে শীতের ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া আর হাতে ধোঁয়া ওঠা কফি, আহা তখন কি যে ভাল লাগে। এই একাকী সময়টা সে দারুণ উপভোগ করে।

বৃদ্ধদের সাথে কাজ করার আইডিয়াটাও পেয়েছিল ওর এক ঊঝখ সহপাঠীর কাছ থেকে। ওদের বাড়ি যাবার পথ একই দিকে কিন্তু প্রতিদিন স্কুলের শেষে ডোনিয়া অন্যদিকের বাস ধরত। ডোনিয়া রোমানিয়ান। কৌতুহল রাখতে না পেরে একদিন মনিরা জিজ্ঞেস করে ফেলল রোজ ক্লাসের পরে সে কোথায় যায়? ডোনিয়া বলল, সে ভলান্টিয়ার করে এক সিনিয়র হোমে। মনিরা যেতে চাইল ওর সাথে, ডোনিয়া রাজি হয়ে গেল। হ্যামিল্টন পাহাড়ের উপরে এক বৃদ্ধনিবাস। ভেতরে ঢুকে মনিরার মনটা ভাল হয়ে গেল। কি পরিষ্কার ঝকঝকে, তকতকে করে সাজানো সব কিছু। ডোনিয়া মনিরাকে হায়ারিং ম্যানেজারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। মনিরা ভলান্টিয়ারের দরখাস্ত করল এবং পরদিন থেকে ভলান্টিয়ার শুরু করল। সেই থেকে শুরু। এরপরে সবকিছু কেমন দ্রুত ঘটে গেল। এই ক্ষেত্রে কি কি কাজ পাওয়া যায় এইনিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করে বের করল যে ক্যানাডাতে হেলথ কেয়ারে কাজের কোন অভাব নেই। ভর্তি হয়ে গেল কোর্সে এবং শুরু হল জীবনের আরেকটি অধ্যায়। ২ বছরের কোর্স শেষে মনিরা চলে এল টরন্টো আর এসে কাজ পেয়ে গেল সাথে সাথে। তারপরে আর খুব একটা পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বৃদ্ধদের সাথে কাজ করার নেশায় পেয়ে বসল। কি অল্পতেই না ওরা খুশী হয়। কি অল্পতেই না ফোকলা মুখে হাসি ফোটানো যায়।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছিল মনিরা জীবন কি করে তাঁর মত করে গড়িয়ে চলে যায়। লিয়ার ডাকে সম্বিত ফিরে পেল মনিরা। লিয়া হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানাল ৮০২ নাম্বার রুমে এক নতুন মহিলা রেসিডেন্ট এসেছে এবং তিনি সম্ভবত ইন্ডিয়ান। তাঁর কথা সে কিছুই বুজছে না এবং মহিলা সব রকম সেবায় বাঁধা দিচ্ছে। যেহেতু মনিরা ইন্ডিয়ান সেহেতু তার সাহায্য প্রয়োজন। মনিরা গেল লিয়ার সাথে। ৮০২ নাম্বার রুমে, ঢুকে সে দেখল এ অতি শীর্ণকায় মহিলা বিছানার কোনে জড়সড় হয়ে বসে আছে। মনিরা কাছে এগিয়ে তার পাশে বসে তার হাত ধরল এবং জিজ্ঞেস করল – ইন্ডিয়ান? মহিলা মাথা ঝাঁকালো। মনিরা আবার জিজ্ঞেস করল – স্পিক হিন্দি? মহিলা মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল এবং সাথে যোগ করল – বাংলা। মনিরা একটু অবাক হল, বাংলা? এখন পর্যন্ত সে বাংলা ভাষী কাউকে নার্সিংহোমে দেখেনি। মনিরা খুব আস্তে জিজ্ঞেস করল – আপনি বাঙালি? মহিলার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল; দুহাতে মনিরাকে জড়িয়ে ধরে বলল – তুমি বাংলা বলতে পার? মনিরা বলল- হ্যাঁ পারি তো। তার আনন্দ দেখে কে, হড় হড় করে এক গাদা কথা বলতে শুরু করল এর মধ্যে মনিরা যেটা বুঝলো যে উনি কলকাতা থেকে এসেছেন। মনিরা দেখল লিয়ার করুণ মুখটি। লিয়া জানে সকালে ১টা ঘন্টা অমানবিক দ্রুত কাজ করতে হয় সবার। ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে সবাইকে নাস্তার টেবিলে থাকতে হবে। বিল্ডিংটার দুটো উইংস আছে দুপাশে ১৬ জন করে রেসিডেন্ড থাকে এবং সকালে ৪ জন সেবিকার মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয় ৩২ জন রেসিডেন্টকে। একেকজনের দায়িত্ব ৮ জন রেসিডেন্টকে রেডি করে ডাইনিং রুমে নিয়ে যাওয়া। রেসিডেন্টসদের প্রয়োজনও ভিন্ন। যারা হাঁটা চলায় সক্ষম তাঁদের খুব একটা সাহায্য লাগে না কিন্তু যারা সম্পূর্ণভাবে শয্যাশায়ী তাঁরা দিন শুরু প্রস্তুতির জন্য পুরোটাই নির্ভরশীল। ৭.৩০ বাজে এবং লিয়ার কাজ তখনো অনেকটাই বাকি। মনিরা তাড়া দিল মহিলাকে বলল – আপনাকে আমি মাসিমা ডাকব কেমন? এখন ঝটপট রেডি হয়ে নিন, লিয়া আপনাকে সাহায্য করবে রেডি হতে আর তারপরে আপনাকে ডাইনিংরুমে নিয়ে যাবে নাস্তার জন্য, বলে আমি যেতে উদ্যত হলে উনি আমার হাত টেনে ধরলেন এবং বললেন – আমি ডাইনিং রুমে যেতে চাই না। আমি একটু থমকে গেলাম কিন্তু লিয়াকে আমার যেতে দিতে হবে। আমি দ্রুত বললাম আপনি রেডি হয়ে নিন মাসিমা, যেতে হবে না কোথাও, আমি আসছি। উনি রাজি হলেন। আমি লিয়াকে বললাম ওনাকে ডাইনিং রুমে না নিতে, রেডি করে রুমে রেখে যেতে। রুম থেকে দ্রুত বের হয়ে আমার অফিস ঘরে ঢুকলাম। রুম ৮০২ এর ফাইলটা টেনে নিয়ে টেবিলে বসলাম। দেখলাম ওনার ছেলে অরুণ (কাল্পনিক নাম, প্রাইভেসির জন্য আসল নাম দেয়া হল না) ওনাকে গতকাল ভর্তি করে রেখে গিয়েছেন। মহিলার বয়স ৬৮ এবং উনি Chronic Lymphocytic Leukemia তে ভুগছেন। এটা একরকম ব্লাড ক্যান্সার, খুব ধীরে ধীরে এই রোগের বিস্তার হয় বলে উপসর্গ ধরা পড়তে সময় লাগে আর ততদিনে এই রোগটা বেশ পাকাপোক্ত ভাবে গেঁড়ে বসে। আরো জানলাম ওঁনার হাতে সময় আছে মাত্র ৬ মাস অথবা তারও কম। ছেলে অরুন ছাড়া আর কারো নাম নেই ফাইলে। একটু অবাক হলাম এই ভেবে যে আমাদের কন্টিনেন্টের মানুষরা সাধারণত মা-বাবাকে ঘরছাড়া করে না এবং সেই সাথে এমন অসুস্থ মানুষকে বিদেশে বিভূঁয়ে। বুঝলাম এখানে আমাকে বেশ সময় দিতে হবে।

দ্রুত হাতে শিফটের শিডিউল খুললাম কম্পিউটারে, ৩টা থেকে ১১টা এবং ১১টা থেকে পরদিন সকাল ৭টার ২ শিফট আমাকে ফিলাপ করতে হবে। আজকে এবং কাল কাজ নেই শিফট মিলিয়ে এমন কয়েকজন কে দ্রুত কয়েকটা কল করে খালি শিফট অফার করলাম এবং পেয়েও গেলাম ২ জন কে কাজ করবার জন্য। প্রসঙ্গান্তরে বলে রাখি নার্সিংহোমগুলোতে সেবক সেবিকাদের ফুলটাইম হায়ার করতে চায় না কারণ ফুল টাইমারদের হেলথ বেনিফিট দিতে হয়। ধারাবাহিক ভাবে সপ্তায় ২৪ ঘন্টার বেশী কাজ করলেই তাকে ফুল্টাইমার হিসেবে গণ্য করা হয়না আর তাই ২০/২১ ঘন্টার বেশী কেউ আওয়ার পায় না। ওদের কে ফুলটাইম আওয়ার পোষানোর জন্য একাধিক যায়গায় কাজ করতে হয়। প্রতি শিফিটে দুজন ফুলটাইমার ৮ ঘন্টা কাজ করে যারা এই হোমে ৫ বছরেরও বেশী সময় কাজ করে ফুলটাইমে হয়েছে আর বাকিরা পার্টটাইমার। এই কারনে শিফট কাভার করা তেমন কোন ব্যাপার নয়, সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এক্সট্রা শিফটের জন্য। সিনিয়রিটি ধরে কল করতে হবে শিফট দেবার জন্য এটাই নিয়ম। হাতের কাজ শেষ করে আবার চললাম ৮০২ নাম্বার রুমের দিকে। গিয়ে দেখি রুম ফিটফাট গোছানো, জানলার পর্দা সরানো। শীতের সকালের আলো ঢুকছে ঘরে। মাসিমা রেডি হয়ে জানলার ধারে একটা চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম – কি খাবেন মাসিমা? উনি বললেন – একটা টোষ্ট জ্যাম দিয়ে আর এক কাপ দুধ চা এক চামচ চিনি দিয়ে। আমি বললাম এত অল্প খেলে হবে? সাথে একটু ডিম আনি? উনি বললেন মুখে কিছু রোচে না। নিয়ম হল যারা হাটা চলা করতে পারেন তাদের অবশ্যই ডাইনিং রুমে যেতে হবে। একমাত্র যারা সম্পূর্নভাবে শয্যাশায়ী শুধু তাদের জন্য রুমে খাবার আনা হবে এবং প্রয়োজনে খাইয়ে দেয়া হবে। এই নিয়ম মেনে মাসিমাকে ডাইনিং রুমে যেতে হয় কিন্তু উনি একেবারেই নতুন তাই এডজাস্ট করার জন্য এবং নিয়ম বোঝার জন্য ওঁনাকে একটু সময় দেয়া যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে আমাকেই এখন সেবকের ভূমিকা নিতে হবে। আমি ডাইনিংরুমে গিয়ে মাসিমার জন্য ২টা টোস্ট বাটার আর জ্যাম দিয়ে মাখিয়ে সাথে এক কাপ চা উনি যেমন করে চেয়েছেন তেমনি করে একটা ট্রেতে করে রুমে নিয়ে এলাম। মাসিমার সামনে খাবারটা রাখতেই উনি বেশ আগ্রহ নিয়ে খেতে শুরু করলেন, দেখে মনে হল বেশ ক্ষুধার্ত। নিজেই বললেন – কাল ছেলে রেখে গিয়েছে সকাল ১০টার দিকে, সেই থেকে জল ছাড়া কিছুই খাননি। আমি বললাম – মাসিমা একটা ডিম অমলেট এনে দেই? সম্বতি দিয়ে মাথা নাড়লেন। আমি গেলাম ডিম আনবার জন্য।

মাসিমাকে খাইয়ে শেষ করতেই RPN (registered Practical Nurses) এল সকালের ওষুধ নিয়ে। যাবার সময় বলে গেল ১১টায় হোমের ডাক্তার আসবে এসেসমেন্টের জন্য। মাসিমার মুখ শুকিয়ে গেল। আমাকে কানে কানে বলতে চাইলেন কিছু, আমি বললাম – মাসিমা এরা বাংলা বোঝে না আপনি জোরেই বলতে পারেন। মাসিমা বললেন উনি ইংলিশ ভাল বোঝেন না এবং বলতেও পারেন না। তখন আমি ওনাকে বুঝিয়ে বললাম নার্স কি বলেছে। মাসিমা বললেন – যথেষ্ট ডাক্তার দেখানো হয়েছে আবার প্রয়োজন কি? উনি কোন ডাক্তার দেখাতে চান না, দিনগুনছেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার জন্য, দেখলাম ওনার চোখে জল। আমার বুকের মধ্যে চিনচিন করে উঠল; বললাম – মাসিমা এটা হোমের নিয়ম, ডাক্তার দেখাতেই হবে এবং ওষুধও খেতেই হবে। উনি আমাকে অনুরোধ করলেন আমি যেন উপস্থিত থাকি যখন ডাক্তার আসবেন। আমি সম্মতি দিলাম এবং বুঝালাম যে ভাল ঝামেলায় জড়িয়েছি। সকাল থেকে নিজের কাজকম্ম কিছুই হয়নি। মাসিমাকে গুছিয়ে রেখে দ্রুত নিজের রুমে ফিরে এলাম। অনেকগুলো কাজ শেষ করতে হবে দুপুরের আগে। (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংকৃতিক কর্মী এবং সোশ্যাল ওয়ার্কার, জেরোন্টোলজী। টরন্টো