শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
৮.
অরুণ চলে যাবার ঠিক আগখানে মাসিমা এসে হাজির জর্জের সাথে। আমি জর্জের সাথে অরুণের পরিচয় করিয়ে দিলাম। অরুণ,জর্জের সাথে হ্যান্ডসেক করে জানাল যে সে তার মায়ের কাছে জর্জের কথা অনেক শুনেছে এবং জর্জের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই। জর্জ বলল “don’t you worry my boy, your mother is in good hands, আমাকে দেখিয়ে বলল -this young ladz keeps an Eagle eye towards her”. জর্জ চলে গেলে আমি অরুণকে বললাম একটা ছোট ক্যাসেট প্লেয়ার জোগার করে দেয়া সম্ভব কিনা? কেন সেটা চাইছি সেটা আমি অরুণকে খুলে বললাম এবং আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে বাংলা গানের ক্যাসেট আমার কাছে আছে ওকে দিতে হবে না। অরুণ বলল যে ও ক্যাসেট প্লেয়ার এনে দেবে খুব শিঘ্রই। অরুণ বিদায় নিতে চাইল। আমাকে বাই বলে মাকে নিয়ে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম মাসিমা চোখ মুছতে মুছতে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছেন ধীর পায়ে। মাসিমার শরীরটা আরো অনেক খারাপ হয়েছে, একটু কুঁজিয়ে হাটেন এখন। হোম থেকে মাসিমাকে একটা ওয়াকার দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি সেটা ব্যাবহার করতে চান না। দেয়াল ধরে ধরে ধীর গতিতে হাটেন। মাসিমাকে দেখে মনে পড়ে গেল “ও গান ওয়ালা এরেকটা গান গাও, আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই।”
আমারও বাড়ি যাবার সময় হয়ে এল। ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিলাম সব। যাবার আগে মাসিমার রুমে ঢুকলাম বাই বলবার জন্য। তিনি সেই কর্নারের চেয়ারে বসে বাইরে তাকিয়ে। মাসিমা আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন অরুণ একটু ভাত আনতে রাজি হয়েছে কিনা। আমি বললাম অরুণ কি বলেছে। মাসিমা খুব মন খারাপ করে বললেন “মনিরা, মরে যাবার আগে একটু ভাত মাছ আর খেতে পাব না?” আমার কলজেটা ব্যাথা করে উঠিল। মাসিমাকে জানালাম যে আমি ভাত এনে মাসিমাকে খাওয়াতে পারব না কারণ এটা পলসির বাইরে। ওই খাবার খেয়ে মাসিমার কিছু হলে তখন আমি বিপদে পড়ব। মাসিমা বললেন “তাহলে?” আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে একটা কিছু ব্যাবস্থা আমি করব। বললাম… আজ যাই মাসিমা, কাল আবার দেখা হবে। মাসিমা ঘাড় নেড়ে সম্বতি জানালেন। আমি নিঃশব্দে বেড়িয়ে এলাম। বাসে বসে ভাবছিলাম মাসিমার মত অগুনিত মা, বাবার কথা যারা এখানে এসেছেন সন্তানের কাছে নিরুপায় হয়ে, দেশে যাদের কিছুই নেই। অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে গেলে কি হয় তাদের অবস্থা? এখানেকার সামাজিক ব্যাবস্থা তৈরি হয়েছে এদের মানসিকতার সাথে মিলিয়ে, নার্সিংহোমে থাকাটাকে এরা খারাপ কিছু মনে করে না বা এটাই ওদের জন্য স্বাভাবিক কিন্তু আমরা যে সমাজ ব্যাবস্থা থেকে এসেছি সেখানে বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গ ভাবে ভিন্ন একটি দেশে এভাবে হোমে থাকার কথা আমরা ভাবতেই পারি না। অনেকে অবশ্য জানেইনা CCAC (community care access centre) বা LHIN (Local health integration network) এর কথা। কেউ চাইলে এদের সাহায্যে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা করে বৃদ্ধ মা, বাবাকে নিজের বাড়িতে রাখা যেতে পারে। CCAC বা LHIN around the clock free seevice দেয় কমিউনিটিতে।
বেরিয়ে আসার সময় দেখলাম জর্জ একা একা বাগানে হাটছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চেয়েছিলাম সে ঠিক আছে কিনা। ক্লান্ত একটি হাসি হেসে বলল যে সে ভাল নেই। জর্জ বলল, “মুনিরা আমি ভাল নেই বললেই তুমি অস্থির হয়ে যাবে, ডাক্তারকে কল করবে, নার্সকে জানাবে। কিন্তু ভেবে দেখ একজন সুস্থ মানুষও কি সব সময়ে ভাল থাকতে পারে? আমারও অধিকার আছে কখন কখন খারাপ থাকার। আমি প্রাণপণ চেস্টা করি ভাল থাকার কিন্তু পারি কই? আমি তোমাকে সত্যি কথা বলছি, এই মূহুর্তে আমি ভাল নেই! এত লম্বা অহেতুন জীবন আর ভাল লাগছে না আমার।” আমি মনে মনে প্রমোদ গুনলাম, ডিপ্রেশনে শুরুর সিম্পটম এটা। কোন ভাবেই একে পাত্তা দেয়া যাবে না। আমি জর্জের কথায় সায় দিয়ে বললাম- “একদম ঠিক কথা বলেছ জর্জ। সারাক্ষন ভাল থাকা সম্ভব না। আমিও ভাল থাকি না সব সময়! তুমি কি জান প্রতিদিন সময় করে নিয়ম মেনে আমি একটা বিশেষ সময়ে মন খারাপ করি?” জর্জ খুব অবাক হল আমার কথা শুনে… জানতে চাইল সে আবার হয় নাকি? আমি বললাম “খুব হয়, প্রতিদিন সকাল,বিকেল কাজে আসা যাওয়ার জন্য আমি যখন বাসে উঠে জানলার ধারে বসি তখন বাইরের দিকে চেয়ে আমি আমার বুকের মাঝে জমে থাকা কষ্টের দলাটা আলগা করে দেই। কত না পাওয়ার বেদনা, কত জমে থাকা অভিমান সব এসে আমার মনে ভিড় করতে থাকে তখন, আমি বাঁধা দেই না। কান্না এলে একটুখানি কেঁদেও ফেলি কখনো কখনো। আবার অনেক সময় আমি মনোযোগ দিয়ে আমার সহযাত্রিদেরকে দেখি। ওদের চোখে খুঁজি ওদের আনন্দ বেদনার গল্প। কেউ কাজে যাচ্ছে, কেউ বাড়ি যাচ্ছে কেউবা হসপিটালে যাচ্ছে। সবার একটা গল্প আছে জর্জ, সেই গল্পে সব সময়ে আনন্দ থাকা সম্ভব না। কিন্তু যে মুহুর্তে আমি বাস থেকে নামি, আমার সব দুঃখের বোঝা আমি বাসে রেখে নেমে যাই।”
জর্জ মাথা ঝাঁকাল, বলল, “মনিরা তোমার ভেতরে এক গভীর সমুদ্র আছে। তোমাকে সবাই বুঝতে পারবে না। তুমি খুব ভাল একটি মেয়ে।”
ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, “মন খারাপের কাছে হেরে যেও না জর্জ। মন খারাপকে উপভোগ কর কিন্তু আস্কারা দিও না, যেমন এখন ঝড়া পাতার পাশে তোমার মন খারাপের বোঝাটা রেখে তুমি ভেতরে যাও, দেখ দিয়ে বেলা কাঁদছে।” একটু অস্থির হয়ে বলল- সেকি! কাঁদছে কেন? হেসে ফেলল জর্জ, বলল… “তোমার মনবিজ্ঞানি হওয়া উচিৎ, এখনো সময় আছে চাইলেই আমি পারবে”। ওর হাতটা ধরে একটা ঝাকুনি দিয়ে আমি বিদায় নিলাম, বললাম “ভিতরে যাও, ঠান্ডা লাগবে।” শীতের বিকেলগুলো ভীষণ সংক্ষিপ্ত, ঝড়ের গতিতে রাত হয়ে যায়। আমি জোড় পায়ে হাঁটলাম বাস স্টপের দিকে।
বাসে উঠে আজ আমি জর্জের কথাই ভাবছিলাম। সেও একজন ভেটেরান। জর্জের ছিল বর্ণাঢ্য এক জীবন। জর্জের বাবার ছিল ব্যাবসা। অঢেল টাকার মালিক। কলেজ শেষ করে জর্জ পারিবারিক ব্যাবসায় যোগ দিয়েছিল। জর্জের হাইস্কুল সুইটহার্ট ছিল স্যারা। এর মধ্যে জর্জকে যুদ্ধে যোগ দিতে হয়েছিল এবং যাবার আগে স্যারাকে বলে গিয়েছিল যে যুদ্ধ থেকে জর্জ ফিরে এলে ওরা বিয়ে করবে। জর্জ যুদ্ধে চলে যাবার পরে স্যারাও যুদ্ধে যায় তবে সেটা ভিন্ন ভাবে। অসংখ্য নার্সের প্রয়োজন ছিল তখন। স্যারা নার্স হিসেবে আর্মিতে যোগ দেয়। যুদ্ধ শেষে ওরা দু’জনেই ফিরে আসে কিন্তু ভিন্ন মানুষ হয়ে। স্যারা সুইডিস ছিল, যুদ্ধের পরে একটি সুইডিস মেডিকেল টিমে যোগ দিয়ে ইথিওপিয়া চলে যায়। যাবার আগে সে জর্জের কাছে মাফ চেয়ে নেয়, স্যারা বলেছিল যুদ্ধ ওকে শিখিয়েছে কি করে অন্যের জন্য বাঁচতে হয়, নিজের জন্য বাঁচার অনুভূতিটা মরে গিয়েছিল। জর্জ অনেক চেস্টা করেছিল স্যারার মত ফেরাবার জন্য কিন্তু পারেনি। স্যারা চলে যাবার পরে সদ্য যুদ্ধ ফেরত জর্জ মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল। জর্জ নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বাবার ব্যাবসায় মন দিয়েছিল। ভাই, বোনরা বিয়ে করে সংসারী হল কিন্তু জর্জ বিয়ের নাম করল না। বার কয়েক স্যারা এসেছিল ছুটিতে এবং জর্জও নিয়ম করে দেখতে যেত স্যারাকে সে যেখানেই তার পোস্টিং হোক না কেন। স্যারা ফুরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দু’টি জীবন সমান্তরাল বয়ে চলেছিল কিন্তু এক হয়ে যাওয়া হয়নি কোনদিন। জর্জ বহুবার স্যারাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু স্যারা এরিয়ে গিয়েছে বলেছে “এভাবেই ভাল”। ৫৫তে স্যারার ডেমেনশিয়া ধরা পড়ে, চাকরি থেকে আর্লি রিটায়ারমেন্টে চলে যেতে হয় ওকে। অবশেষে জর্জের কাছে বাড়ি ফিরে এসেছিল স্যারা যেখানে কেউ ছিলনা ওকে দেখাশোনা করবার জন্য। জর্জ হাসি মুখে সে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে। এর পরে যতদিন স্যারা বেঁচেছিল জর্জই ওর সেবা করেছে, এক সময়ে স্যারা আর জর্জকে চিনতে না কিন্তু পরম নির্ভরশীলতা ছিল জর্জের উপরে। কি অদ্ভুত জীবন, অবশেষে জর্জ স্যারাকে পেয়েছিল! পেয়েছিল কি?
তবু তোমাকে ভালবেসে,
মুহুর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে যেখানেই রাখি এ হ্রদয়। জীবনানন্দ দাশ। (ক্রমাগত)
– টরন্টো, কানাডা