শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।
৬.
শুক্রবার সকালে মাসিমা এসে মনে করিয়ে দিলেন যে আজ অরুণ আসবে, দেখলাম জর্জ আছে সাথে। বুঝলাম জর্জ মাসিমার গার্ডিয়ান এঞ্জেলে পরিণত হয়েছে। জর্জ এখন রোজ সকালে, বিকেলে, রাতে এসে মাসিমার রুমে হানা দিয়ে সাথে করে খাবার রুমে নিয়ে যায়। এটা দেখে আমার বুক থেকে একটা পাষাণ ভার নামে গিয়েছিল। মাসিমাও অনেক উৎফুল্ল আগের থেকে কিন্তু রুম থেকে বেরোতে চান না খুব একটা এবং শুনলাম ওষুধ খাওয়া নিয়েও ঝামেলা করেন। মাসিমা কেমোথেরাপি নিয়েছিলেন শুরুতে কিন্তু তিনি এর ধকল সামলাতে পারেননি তাই কেমোথেরাপি বন্ধ করে ডাক্তার বিভিন্ন রকমের ওষুধ দিয়েছে বাকি দিনগুলো মাসিমাকে সচল এবং স্বাভাবিক রাখবার জন্য। মাসিমার সাথে কথা বললে বুঝতে পারি তিনি যেন অধীর আগ্রহে মৃত্যুর দিন গুনছেন। শুকিয়ে একেবারে একমুঠো হয়ে গিয়েছেন। বেঁচে থাকার উপরে এত বীতশ্রদ্ধ হতে এর আগে কাউকে দেখিনি।
মাসিমা পুরনো দিনের বাংলা গান শুনতে খুব ভালবাসেন, একটা ছোট্ট ক্যাসেট প্লেয়ার চেয়ে নিতে হবে অরুনের কাছ থেকে। গতকাল খুব বৃষ্টি ছিল সারাদিন আজও ঝরছে অঝোর ধারায়। আমি হাতের কাজ সেরে আমার সিনিয়র সহকর্মীকে জানিয়ে গেলাম মাসিমার রুমে। ভাবলাম মাসিমার সাথে একটু গল্প করি আর সেই সাথে অরুণের জন্যও অপেক্ষা করি। গিয়ে দেখি সেই জানলার ধারে চেয়ারে বসে বাইরে বৃষ্টির তান্ডবের দিকে চেয়ে আছেন মাসিমা, কি আনমনা! আমি পাশে গিয়ে দাড়ালাম। সাড়া পেয়ে আমার হাতটা ধরলেন, অনুরোধ করলেন বসার জন্য। আমি চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলাম। আমার কথা জানতে চাইলেন। হোমের পলিসি মেনে যতটুকু বলা যায় বললাম যা দুলাইনে শেষ হয়ে গেল। মাসিমা জানতে চাইলেন আমি সুচিত্রা সেন আর উত্তম কুমার কে চিনি কিনা। আমি হেসে বললাম যে বিলক্ষণ চিনি।
মাসিমা একটা গুনগুন করে একটা গান ধরলেন আমিও গুনগুন গলা মেলালাম। কি যে খুশি হলেন, বাচ্চাদের মত উচ্ছসিত হলেন শুনে। তাঁর শেষ সময়ে আমার সাথে দেখা হওয়াটা নাকি বিধাতার আশীর্বাদ। আমি নাকি তাঁর এখানে থাকাটা সহনীয় করে দিয়েছি, সাহস দিয়েছি। শুনে ভাল লাগল যে কারো জীবনে এতটুকু রেখাপাত করতে পেরেছি বা কারো কাজে এসেছি একটুখানি। মাসিমা চা খেতে চাইলেন। বললেন কোলকাতার জীবনে বৃষ্টির দিনগুলো কত মধুর ছিল, বৃষ্টির বিকেলবেলাগুলো কেমন চা আর তেলেভাজা খেয়ে অম্বল বানিয়ে ফেলতেন। উঠে গিয়ে এককাপ চা করে নিয়ে এলাম মাসিমার জন্য।
মাসিমার যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স সতেরো আর মেসোর বয়স তখন পঁচিশ। মেসো নাকি খুব রোমান্টিক ছিলেন। কাকাদেরকে নিয়ে যৌথ পরিবারে ছিল তাঁদের বসবাস। কারো নজর এড়িয়ে কিছু করাটা ছিল তাদের জন্য অসম্ভব। বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় মেসো মাসিমা কে নিয়ে গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যাবার কথা বলে সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ম্যাটিনিতে যেতে পারেননি কারন ভর দুপুরে কেউ বউ নিয়ে গঙ্গায় হাওয়া খেতে যায় না তাই ইভিনিং শো তে যেতে হয়েছিল। মেসো তেলেভাজা, চপ এবং কোকাকোলা খাইয়েছিলেন মাসিমাকে। তারপরে সিনেমা দেখতে ঢুকেছিলেন। স্বামীর পাশে বসে তাঁর হাত ধরে উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখতে দেখতে মাসিমা বিয়ের পরে প্রথমবারের মত মেসোর প্রেমে পড়েছিলেন। ছবি দেখে বেরোতেই মেসোর বড় কাকার সামনে পড়েছিলেন ওরা। কাকা ওদের দেখে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। ওরা তখন কুকড়ে কাকার সামনে দাঁড়িয়ে। কাকা একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলেছিলেন যে অনেক রাত হয়েছে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবার জন্য আর খুব মিনমিন করে বলেছিলেন সেদিনের সন্ধ্যার কথা কাউকে বলবার দরকার নেই। মেসোরও সেই মত। সবাই চেপে গিয়েছিল সেদিনের সন্ধ্যার কথা কিন্তু সুযোগ পেলেই এই নিয়ে ওরা দুজন হাসাহাসি করত। যৌথ সংসার বলে মাসিমাকে খুব খাটতে হত। রাত ১০টার আগে ছুটি মিলত না আর এই নিয়ে মেসো তাঁর মায়ের কাছে অনেক অনুযোগ করত। মেসোর বউ প্রতির কথাটা চাউর হয়ে যাওয়াতে দেবর, ননদদের কাছে উপহাসের পাত্রি হয়েছিলেন মাসিমা। কিন্তু এই নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র ক্ষোভ ছিল না কারণ রাতে বন্ধ দরজার ওপারে মেসোর ভালবাসা সেটা পুষিয়ে দিত। স্নো, পাউডার, চুড়ি, কাজল কিছুনা কিছু তার পকেটে নিয়ে বাড়ি ফিরত প্রতিদিন। মেসো ঘরে ঢুকে জামাটা চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখতেন, রাতে মাসিমা ঘরে ঢুকলেই বলতেন “বেলারানী জামার পকেটে হাত ঢোকাও তো!”…… মাসিমা অনেক বলেছেন এই বাজে খরচ না করবার জন্য কিন্তু মেসো শুনতেন না। ধীরে ধীরে চুড়ি, স্নোর বদলে একটা চাটনি, হজমি বা লজেন্স; কিছু না কিছু থাকত মেসোর পকেটে। বিবাহ বার্ষিকী তে প্রথম দিকে আনতেন শাড়ি বা শাল, কয়েক বছর যাবার পরে থাকত একটা বেলফুলের মালা। মাসিমা বলেলেন যে মেসো না বলা পর্যন্ত কিছুতেই পকেটে হাত দিতেন না মাসিমা, যাতে মেসো মনে না করেন তিনি লোভী হয়ে গেছেন। কিন্তু মেসো জানতেন না যে মাসিমার কি ভীষণ আগ্রহ ছিল জানবার জন্য আজ পকেট থেকে কি বেরোয়। একবার লাল কাপড়ে মুড়ে নিয়ে এলেন একজোড়া রুপোর মল। হাটলে ঝুম ঝুম শব্দ হয়। ভীষণ পছন্দ হল মাসিমার, সেদিন রাতভর নুপূরের ছন্দে ভরে থাকল তাঁদের ছোট্ট রুম। পরদিন সকালে শাশুড়ি জানতে চেয়েছিলেন শব্দের উৎসর কথা এবং জানবার পরে আর পরতে বারণ করেছিলেন। বললেন বাকিরা জানতে পারলে বলবে বাড়িটা বাইজী বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। রাতের বেলা মলজোড়া মেসোর হাতে ফেরত দিয়েছিলেন মাসিমা। মেসো মন খারাপ করে বলেছিলেন “পরজন্মে আবার মল এনে দেবেন, যখন পৃথিবী আরো একটু আধুনিক হবে।” শুনে মাসিমা হেসে ফেলেছিলেন।
বিয়ের ৫ বছরের মাথায় অরুণ এসেছিল ওদের কোল জুড়ে আর ততদিনে যৌথ সংসার একটু একটু করে আলগা হচ্ছিল। ৫ বছর সন্তান না হওয়াতে মাসিমাকে শুনতে হয়েছিল অনেক খারাপ খারাপ কথা, মেসোকে আবার বিয়ে দেবার জন্য বলছিল সবাই। মেসোর বাবার এক সন্তান – মেসো নিজে। সবাই বংশধর বংশধর বলে খাবি খেয়ে মরে যাচ্ছিল তখন। কিন্তু মাসিমার শাশুড়ি অবিচল ছিলেন এসব কথায়, কানেই তুলতেন না কিছু। আড়ালে আবডালে সবাইকে রাক্ষসের জাত বলে গালি দিতেন আর বউ কে বলেছিলেন কারো কথায় কান না দিতে। মাসিমা মেসোকে বলেছিলেন তাঁকে ডাক্তার দেখনোর জন্য কিন্তু মেসো বলেছিলেন যে এত অল্প বয়সে বাচ্চা না হওয়াই ভাল, তাতে করে মাসিমার শরীর ভেঙ্গে যাবে। যখন হবার তখন হবে। এর পরে এই নিয়ে মাসিমা আর ভাবেননি। তাঁর শাশুড়ি স্বামীর যখন এই নিয়ে কোন অসুবিধা নেই তখন তিনিও এই নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাননি। সব আলোকিত করে, সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে অরুণ এসেছিল তাঁদের জীবনে। মাসিমা হেসে বলছিলেন যে “আমি যখন আতুর ঘরে তখন কয়েকদিন অরুণের বাবা আমাকে কাছে পায়নি। আমি আতুর ঘর ছেড়ে যখন নিজের ঘরে ফিরে এলাম দেখি একটা ছোট্ট কাঠের বাক্সের মধ্যে চুড়ি, ফিতা কতকি’র সাথে চকচকে সাদা পাথর বসানো সোনার একটা নাকফুল।” মেসো বলেছিলেন সাদা পাথরটা হল হিরা। পুত্র সন্তান দেবার জন্য এটা মাসিমার উপহার। আনন্দে মাসিমা কেঁদে ফেলেছিলান, মেসোর মৃত্যু পর্যন্ত সেই নাকফুল আর খোলেননি। মেসোর চলে যাবার পরে খুলে সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন অরুণের বউকে দেবেন বলে।
তারপরে একসময়ে যৌথ সংসার ভেঙ্গে শ্বশুড়, শাশুড়ি নিয়ে মেসোরা আলাদা হলেন। জীবনটা আরো থিতু হল। আরো একটা বাচ্চার জন্য চেস্টা করেছিলেন মাসিমা কিন্তু কিছুতেই আর হল না। বললেন জীবনে তাঁর কোন আক্ষেপ নেই। মেসোর মত স্বামী পেয়ে তিনি ভাগ্যবতী হয়েছিলেন এবং তাঁর শাশুড়ি ভাগ্যও খুব ভাল ছিল, প্রকাশ ছিল না কিন্তু পুত্র বঁধুকে কন্যাসম জ্ঞান করতেন। সময়ের নিয়ম মেনে এক সময়ে সবাই চলে গেল। অরুণ স্ক্ললারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে আসার কয়েক বছর পরে মেসোও ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন হার্ট এটাক করে। ভীষণ একা হয়ে গেলেন মাসিমা। তাঁর জীবনের ভরসা তাঁকে ছেড়ে পরপারে আর সন্তান অনেক অনেক দূরে। অরুণের চিঠির জন্য অপেক্ষা হয়েছিল তাঁর জীবনের নতুন সঙ্গী। খুব চাইতেন অরুণ ফিরে এসে মিষ্টি একটা মেয়েকে বিয়ে করে থিতু হোক। বিয়ের প্রসংগ অরুণ সযতেœ এড়িয়ে যেত, বলত আগে সেটেল হয়ে নিক তারপরে হবে। এর মাঝে অরুণ আমেরিকা ছেড়ে ক্যানাডায় চলে এসেছিল চাকরি নিয়ে এবং এসে মায়ের জন্য এপ্লাই করেছিল। নতুন আশায় বুক বেঁধে শুরু হয়েছিল মাসিমার নতুন অপেক্ষা। মেসো মৃত্যুও কয়েকদিন আগে মাসিমাকে নাকি বলেছিলেন-” বেলা, আমি জানি আমি তোমার আগে চলে যাব, এও জানি আমি যাবার পরে তুমি খুব কষ্টের মধ্যে পড়বে, একটু সহ্য করে নিও। আমাদের আবার দেখা হবে খুব শিঘ্রই।” শুনে আমার বুকের ভেতরটা ব্যাথায় ভরে গেল, বুঝলাম ওপারে যাবার জন্য মাসিমার কেন এত তাড়া। মনে মনে ভাবলাম, “মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান। তুঁহু মাধব, তুঁহু মম দোসর, তুঁহু মম তাপ ঘুচাও। মরণ, তু আও রে আও।” (ক্রমাগত)
– টরন্টো, কানাডা