শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

৫.
আজকে কাজের খুব একটা চাপ নেই। সোম, মঙ্গল আর শুত্রবার হল সপ্তাহের ব্যস্ততম দিন, অন্য দিনগুলে যেন একটু নিঃশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যায়। টেবিলে ফিরে গিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে আরাম করে কফিতে একটা চুমুক দিল মনিরা। কাজ করতে করতে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল আজ। ভাবছিল জীবনটা কি আজব! কোথার কোন একটা দেশে জন্মে মানুষ কি করে সম্পূর্ণ একটা অজানা দেশে গিয়ে কি দারুণ আস্তানা গেড়ে বসে, দিন যাপন করে, সংসার, সন্তান পালন করে, দিন যায় কি নির্বিকার ভাবে; যেন আজন্ম সে এই দেশেই ছিল। মনিরা ভাবে এই ভিন দেশের মাটিতে পরদেশীরা যতদিন সন্তান ধারণ না করে ততদিন নতুন জায়গার সাথে যেন সম্পর্কটা আলগাই থেকে যায় কিন্তু যেই সন্তানের আগমন হয় সংসারে সাথে সাথেই যেন শিকড় গজিয়ে যায়, নিশিডাক ভুলে গিয়ে সংসারী হয়ে যায় অন্য দেশে, অন্য মানচিত্রে। অনেকে আবার সন্তানকে একটি ভাল জীবন দেবার জন্যই মধ্য বয়সে দেশ ছেড়ে পরদেশী হয়ে একটা জগাখিচুড়ী জীবন যাপন করে। না পারে ফেলে আসা জীবনে ফিরে যেতে, না পারে নতুন দেশকে ভালোবাসতে। পৃথিবীর সকল পরদেশীদের জন্য মুনিরার বুকের মাঝে কেমন একটা মুচড়ে ওঠে। নিজের দেশ ছাড়ার কথা মনে হয় মুনিরার। খুব একটা আনন্দে সেও দেশ ছাড়েনি, পরিস্থিতি ওকে বাধ্য করেছিল। অল্প বয়স ছিল আর তেমন কোন পিছুটান ছিল না বলে মনিরা সহজেই মানিয়ে নিয়েছিল এই দেশে। এটা মানতে সে বাধ্য যে পৃথিবীর অন্যতম একটি নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ দেশেই তার বসবাস। শুরুর সেই একাকী জীবনের দিকে ফিরে তাকালে নিজের জন্য নিজেরই কেমন মায়া লাগে মনিরার কিন্তু তার একাকীত্ব কি ঘুচেছে আদৌ? এখনও কি হয় না মনে “আমি কার? কে কাহার?” বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাজে মন দিল মনিরা।

নতুন কিছু সেবাকর্মী কাজে যোগ দিয়েছে, তাদের শিডিউলে ফেলতে হবে। নতুনদের অবশ্য শুরু করতে হয় বিকেলের অথবা রাতের শিফট দিয়ে। বিশেষ করে রাতের শিফিটে কেউ কাজ করতে চায় না কিন্তু হায়ারিং এর সময়ে ওদের বলা থাকে বিধায় কিছু করার থাকে না। নতুন একটি জ্যামাইকান মেয়ে ওমনিরা আমাকে অনুরোধ করেছিল আমি যেন ওকে রাতের শিফটে কাজ দেই, সে শুধু রাতেই কাজ করতে চায়। একটু কৌতুহলে আমি জানতে চেয়েছিলাম, কেন? ওমনিরা আমাকে বলেছিল ওর ছোট বাচ্চা, ডে কেয়ার অনেক খরচ। সরকারি ডে কেয়ারের জন্য ও ওয়েটিং লিস্টে আছে। ওমনিরা আমাকে ওর গল্প শুনিয়েছিল।

ওমনিরা ওর দেশে নার্স ছিল, স্কিলড ক্যাটাগরিতে সে এই দেশে এসেছিল। এখানে এসে ওকে আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হয়েছিল। ওমনিরা ইন্টারন্যাশনাল নার্স হিসেবে এখানে এসেছিল এবং নার্সিং প্র্যাকটিস করার জন্য ওকে CPNRE (Canadian Practical Nurse Registration Examination) দিতে হয়েছিল, কিন্তু ও পাশ করতে পারেনি আর তাই ওকে একেবারে প্রলিমিনারি থেকে শুরু করতে হয়েছে। ওমনিরা PSW শেষ করে কাজ শুরু করে দিয়েছে এবং পার্ট টাইমে আবার RPN course করছে বিকেল বেলা। ওমনিরা এখানে এসে আবিস্কার করেছিল যে সে প্রেগন্যান্ট, কথাটা ওর জ্যামাইকানবাসী বয়ফ্রেন্ডকে জানাতেই সে খুশিতে উল্লাস করে বলেছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ক্যানাডা নিয়ে যেতে যাতে ওরা সুখী নীড় বাঁধতে পারে। হায়রে সুখ! হায়রে অসুখ! সুখের ভাবনাটাই মনে হয় অসুখ। ওমনিরা ওর নিজের রেসিডেন্সি গুছিয়ে নিয়ে জ্যামাইকা গিয়েছিল বিয়ে করতে এবং ৬ মাসের মধ্যে ওর বর চলে এসেছিল আর তার কিছু দিনের মাথায় ও মেয়ে সন্তান প্রসব করেছিল। ওমনিরার স্বামী চেয়েছিল ছেলে। ওমনিরা আগে থেকে জানতে চায়নি ভ্রূণ ছেলে না মেয়ে, এটা সারপ্রাইজ রেখেছিল দুজনের জন্যই। প্রসুতি ঘরের বাইরে ওর স্বামী দাঁড়িয়েছিল। যেই কিনা নার্স ওকে গিয়ে জানিয়েছিল যে একটি ঝাকড়া চুলের মিষ্টি মেয়ের বাবা হয়েছে ওমনিরার স্বামী চীৎকার করে বলে ছিল “Oh man! I wanted a boy!” ভেতরে ঢোকেনি সে। ব্যাথায় কষ্টে ওমনিরার বুক ভরে উঠেছিল। শুনতে শুনতে আমি ভাবছিলাম জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কিছু পুরুষেদের সেই একই কাব্যগাথা “ছেলে চাই, ছেলে চাই!” এই আধুনিক যুগে এসেও এরা বোঝে না ছেলে বা মেয়ে জন্মের নির্ধারণের ক্ষেত্রে মায়ের কোন ভূমিকা নেই। এরা কত সহজেই না নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে! কত সহজেই না নিরবে গায়েব হয়ে যেতে পারে সব ফেলে! আমরা পারি না, কেন পারি না? বিধাতা আমাদের মনে কোমলতা দিলেন দায়িত্ববোধ উপলব্ধির জন্য আর সেই কোমলতাই কাল হল আমাদের জন্য। আমরা খেতাবপ্রাপ্ত হলাম দূর্বল হিসেবে।

ওমনিরার সুখের সংসার হয়নি। নতুন বাচ্চা নিয়ে বাড়ি যাবার পরে শুরু হয়েছিল নতুন কাহিনী। বাচ্চার কোন কাজ ওর স্বামী করতে চাইতো না, বাচ্চা কাঁদলেও তার অনেক অসুবিধা হত। কাজকম্ম করতে চাইতো না। ভালবাসা একসময়ে ভাল খাঁচায় পরিণত হল এবং যথারীতি খাঁচা ভেঙ্গে ওমনিরার স্বামী একদিন গায়েব হয়ে গেল। ওমনিরা এক জ্যামাইকান মহিলার বাড়ির বেসমেন্টে ভাড়া থাকে। মহিলা ওমনিরাকে খুব পছন্দ করে এবং ওর স্বামী চলে যাওয়াতে সে ওমনিরাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেছিল যে ‘এটাই ভাল হয়েছে, আপদ নিজেই বিদায় হয়েছে’। বাড়িওয়ালী নিজেই সমস্যার সমাধান করে বলেছিলেন যে বাচ্চাটা যেহেতু কাঁদে না তাই রাতের বেলা সেই রাখতে পারবে আর তাই ওমনিরা রাতের শিফট নিয়ে কাজ করতে চায়। দিনের বেলা বাচ্চা দেখা একটু ঘুমানো আর বিকেল বেলা পড়াশুনা, নার্সিং পরীক্ষার জন্য প্রপারেশন। রাতে বাচ্চাকে ভাল করে খাইয়ে দাইয়ে বাড়িওয়ালীর জিম্মায় রেখে কাজে যাওয়া। রাতের শিফটে কাজ করতে আগ্রহী বলে ওমনিরার আওয়ারের কোন কমতি নেই। রাতের শিফিটে কেউ সিক কল করতে চাইলে তারা ওমনিরা কে আগে কল দেয় এবং ওমনিরাও কখনো না বলে না। এই মেয়েটার জন্য আমার ভীষন এক মায়া, কি যে কঠোর পরিশ্রমী সে। জানি ওর এই কষ্টের দিন শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই, শক্ত হাতে সে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে এই আপরিচিত ভূখন্ডে।

ব্রেকফাস্ট আওয়ার শেষ হলে দেখি মাসিমা আর জর্জ ধীর পায়ে আমার ওয়ার্কিং স্টেশনের দিকে এগিয়ে আসছে। মাসিমা এসে মনে করিয়ে দিয়ে বললেন যে আমি বলেছিলাম আমার কাজের জায়গা আমি ওনাকে দেখাব কিন্তু সেটা হয়নি বলে উনি জর্জকে বলেছেন আমার কাছে নিয়ে যাবার জন্য। জর্জ মাসিমার কাছে জানতে চাইল উনি একটু বাগানে হাটতে যেতে চান কিনা। বাইরে তখন হেমন্তের অপূর্ব আবহাওয়া। মাসিমা একটু ইতস্তত করছিলেন দেখে আমি বললাম যে জর্জ খুব সতর্ক একজন মানুষ এবং বাইরে গেলে ওঁর ভালই লাগবে। এর মধ্যে খেয়াল করে দেখলাম জর্জ মাসিমাকে নাম ধরে ডাকছে, শুনতে খুব মিষ্টি লাগছিল। আমি হেসে একটু চোখ মটকে মাসিমাকে বললাম যে জর্জের খুব পছন্দ হয়েছে ওকে। শুনে মাসিমা একটু লজ্জা পেলেন আবার ঘাবড়েও গেলেন। কথাটা বলেই আমি বুঝলাম যে একটা আনপ্রফেশনাল মন্তব্য করে ফেলেছি। আমি মাসিমার হাত ধরে বললাম যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মাসিমা যেন কিছু মনে না করেন। মাসিমা আমার চিবুক ছুঁয়ে একটু আদর করে দিলেন। জর্জ বুঝতে পারছিল আমরা ওকে নিয়ে কিছু বলছি তাই কপট রাগে বলল যে পুরো ব্যাপারটা আনফেয়ার কারণ ও কিছু বুঝতে পারছে না। আমি দুষ্টুমি করে বললাম আমরা মোটেই ওকে নিয়ে কথা বলছি না এবং নিজেকে এত ইম্পর্টান্ট ভাবার কোন কারণ নেই। জর্জ হেসে বলল যে সে বেলার (মাসিমার কাল্পনিক নাম) কাছ থেকে বাংলাটা ভাল করে শিখে নেবে। আমি চোখ মটকে বললাম “গুডলাক”। ওরা ধীরে ধীরে হেটে এলিভেটরের দিকে চলে গেল। ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম গতকালও মাসিমা কতটা আপসেট ছিলেন সব কিছু নিয়ে আর আজ তিনি নিজেই একটা গল্প সৃষ্টি করতে চলছেন। পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে মনে হয় আমাদের জুড়ি নেই। হঠাৎ একটা হইচই শুনে আমি ডানদিকের উইংসের দিকে এগিয়ে গেলাম, দেখলাম রেসিডেন্ট এরিখের রুমের বাইরে ভীড়। ভেতরে ঢুকে দেখি এরিখ বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছে আর ডিউটিরত নার্স ঝুকে ওর পালস দেখছে। আমরা জানি এরিখের ফাইলে DNR (Do Not Resuscitate) লেখা আছে। নার্স আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হাউস ডক্টরকে ডাকতে বলল। আমি বুঝলাম এরিখ আর নেই। (ক্রমাগত)