শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

৪.
গতকাল বিকেলে কাজ থেকে বেরিয়ে ভাবলাম পথেই অরুণকে ফোন করে নেই, আবার এও ভাবলাম যে বাসে বসে অনেক মানুষের সামনে সব বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে পারবো না। সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়ি ফিরেই ফোন করব এবং করলাম। অরুণ ফোন ধরল। পরিচয় পর্ব শেষ হতে অরুণকে জানালাম যে মাসিমা হোমে সহজ হতে পারছেন না এবং আরো কিছু বিষয়ে আমি তার সাথে কথা বলতে চাই, অরুণ ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে জানতে চাইল আমি শুক্রবারে কাজ করি নাকি এবং ২টার সময় ফ্রি আছি কিনা? আমি বললাম ফ্রি না থাকলেও আমি সময় করে নেব অরুণের সাথে কথা বলার জন্য। অরুণ জানাল সে ওই সময় হোমে আসবে এবং সামনে বসে কথা বলবে। খেয়াল করলাম যে আমি ইংরেজিতে কথা বললেও অরুণ উত্তর দিচ্ছিল বাংলায়, বাংলায় কথা বলা খারাপ কিছু নয় কিন্তু অরুণের বাংলা বলার কষ্টসাধ্য প্রয়াস লক্ষ্য করছিলাম। পুরো বিষয়াটাতে কেমন যেন রহস্য রয়েছে। এ নিয়ে আর বেশি ভাবলাম না, বাড়িতেও অনেক কাজ পড়ে আছে।

পরের দিন সকাল বেলাতেও সেই একই গণ্ডগোল মাসিমাকে নিয়ে। উনি কিছুতেই রুম ছেড়ে ডাইনিং রুমে খেতে যাবেন না। আমি আবার হাতের কাজ ছেড়ে গেলাম মাসিমার কাছে। গিয়ে দেখি উনি জানলার পাশে চেয়ারে বসে হাপুস হয়ে কাঁদছেন। আমি রুমে ঢুকে স্যান্ড্রাকে ইশারা দিলাম চলে যাবার জন্য, বেচারা কত কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মাসিমার কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম, গিয়ে বললাম যে; রুমে খাবার আনার নিয়ম নেই। প্রথম দিন আনতে পেরেছিলাম কারন সেটা মাসিমার প্রথম দিন ছিল বলে কিন্তু আজ আর হবে না সেটা। মাসিমা কিছুতেই যাবেন না। আমি জানতে চাইলাম কেন উনি ডাইনিংএ যেতে চান না? মুখ কালো করে মাসিমা জানালেন যে প্রথম দিন ছেলে চলে যাবার পরে দুপুর বেলা উনি ডাইনিং রুমে গিয়েছিলেন খেতে। অভ্যাস নেই বলে কাঁটা চামচ ছিটকে পড়ে গিয়েছিল হাত থেকে আর তাই দেখে আশেপাশের কয়েকজন মহিলা রেসিডেন্টরা হেসে ঊঠেছিল, মাসিমা না খেয়ে ঊঠে চলে গিয়েছিলেন। শুনে আমি মনে মনে ভাললাম; “বুলিইং এর কোন বয়স নেই”। মাসিমাকে বললাম যে চামচ পড়ে গিয়েছিল তার কারণ এই নয় যে তিনি কাঁটা চামচ ব্যাবহার করতে জানেন না বরং একটা অপরিচিত পরিবেশে তিনি একা ছিলেন বলে ভয় পাচ্ছিলেন, শুনে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন মাসিমা, তাঁর চোখ একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললাম আজ আমি সাথে থাকব এবং সব কিছু দেখিয়ে দেব কি করে কি করতে হয়, মাসিমা রাজি হলেন। মাসিমাকে খাবার ঘরে নিয়ে দূরে কর্নারে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। শিখিয়ে দিলাম কি করে খাবার আনতে হয়, ন্যাপকিন কোলের উপরে বিছিয়ে দিতে হয়, খুঁটিনাটি আরো কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিলাম। বললাম আমি লাঞ্চেও সাথে করে নিয়ে আসব তাহলে মাসিমার আর সমস্যা থাকবে না, সাথে এও বললাম যে কে কি বলল বা হাসল তাতে কিছু যায় আসে না কারণ সবাইকেই সমপরিমান টাকা দিতে হয় এখানে থাকবার জন্য বরং মাসিমা অনেকের থেকে একটু ভাল অবস্থানে আছেন কারন অরুণ তার একার জন্য একটি পুরো রুম নিয়েছে, যেখানে অনেককেই রুম শেয়ার করতে হয়,আমার এ কথায় মাসিমা তাঁর আত্মবিশ্বাস বেশ খানিকটাই ফিরে পেলেন। যাবার ঠিক আগেই দেখলাম জর্জ এসে মাসিমার পাশের টেবিলটাতে বসল। খুব একজন ভাল মানুষ সে।

জর্জের বয়স হবে ৭০ কিন্তু শরীর ভেংগে পড়েনি বা তেমন কোন রোগসোগ ও নেই তার। পেটানো স্বাস্থ্য। সে এখনো ড্রাইভ করে। জর্জের সারাদিনের কাজ হল সবাইকে সাহায্য করা। এ রুম সে রুম ঘুরে কার কি লাগবে, কাউকে খবর কাগজ পড়ে শোনাতে হবে, কাউকে কোথাও নিয়ে যেতে হবে এর জন্য জর্জ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে সর্বক্ষণ। হোমের অনেক নিয়ম সে মানে না এবং এ নিয়ে হোমের অনেকের অনেক সমস্যা কিন্তু ডাক্তার বলেছে জর্জকে বাঁধা না দিতে, বাঁধা দিলে সে সিভিয়ার ডিপ্রেশনে চলে যাবে; এই ডিপ্রেশনটাই জর্জের একমাত্র সমস্যা। এমন দিনও গিয়েছে দিনের পর দিন সে বিছানা ছেড়ে ওঠেনি, ওষুধ খায়নি, খাবার নাম মাত্র খেয়েছে, কারো সাথে কথা বলে নি। অনেক কাউন্সেলিং এর পরে জর্জ সুস্থ হয়ে ডিপ্রেশন থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে সবাইকে বন্ধু করে নিয়েছে, এর ওর জন্য কিছু করার মধ্যে সে ভীষণ আনন্দ খুঁজে পায়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বলেছে এটাই জর্জের ওষুধ, তাকে ব্যাস্ত থাকতে দিতে হবে এবং সে যদি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারে তাহলে সে ভাল থাকবে। অতয়ব ৮ তলার ছোট্ট পরিসরে বিভিন্ন দেশের এই রং বেরঙের মানুষের জীবনে জর্জ রাতারাতি একজন প্রিয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যক্তিতে পরিনত হল। জর্জের জীবনটাও অদ্ভুত, চেনা পথে যে সারাটা জীবন হাটা যায় না জর্জই তার প্রমাণ। বেশির ভাগ সময়ই ভাবনার রঙে আমাদের জীবনটা রাঙানো হয় না কিন্তু তাই বলে তো আর থেমে থাকা যায় না? প্রিয় পাঠক জর্জের গল্প এরেকদিন হবে আজ মাসিমার কথা হোক। চোখের পলকে আমি ভাবলাম জর্জের এখানে এসে বসাটার পিছনে ইশ্বরের অবদান রয়েছে। আমি এগিয়ে গিয়ে জর্জকে হাই বলে বললাম যে আমার একটা সাহায্য প্রয়োজন, সাথে সাথে জর্জ লাফিয়ে ঊঠল; আমি মাসিমার সাথে জর্জকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দ্রæত খুব সংক্ষেপে যতটুকু বলা যায় বা বলা ঠিক ততটুকু বলে বললাম যে সে যেন মাসিমার দিকে একটু খেয়াল রাখে, সাথে এও জানাতে ভুললাম না যে কি কি খাবার মাসিমা খান না। মাসিমাকে বললাম যে জর্জ খুব ভাল মানুষ, সে ভাঙ্গা ইংরেজিতে বললেই জর্জ বুঝে নেবে এবং সে মোটেই অন্যদের মত না, এও বললাম যে, জর্জ ইন্ডিয়া গিয়েছিল এবং সে ইন্ডিয়ানদের খুব পছন্দ করে; মাসিমা ভরসা পেলেন। আমি নিজের জন্য এক কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে দ্রুত আমার কাজে ফিরে গেলাম। (ক্রমাগত)