শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

জন মাকে বলত ডেটিং করারা জন্য, উৎসাহ দিত বাইরে ক্লাবে যাবার জন্য, এঞ্জেলাও ভাবছিল যে পল যাবার পর থেকে ও কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে; কোথাও যায় না, কিছু ভাল লাগে না। জনের উৎসাহে এঞ্জেলা চুল আর নখ ঠিক করার জন্য সেলুনে গেল, ওয়ারড্রব খুলে একটা ভাল জামা বের করল ক্লাবে পড়ার জন্য। ঘুরে ঘুরে আয়নায় দেখছিল নিজেকে, কেমন বুড়োটে লাগে নিজেকে, নিজেই ঘরে ফেস প্যাক বানিয়ে মুখে লাগাল। ভাবছিল আবার কাজে ফিরে যাবে। কিন্তু নিয়তির প্ল্যান ছিল অন্যকিছু। এঞ্জেলা স্ট্রোক করলো। ডিনার করছিল ও আর জন, হঠাৎ পড়ে গেল এঞ্জেলা। বেঁচে গেল এ যাত্রায় কিন্তু প্যারালাইজড হয়ে গেল বাম পাশটা। পার?্যালাইজড হয়ে এঞ্জেলা পুরোপুরি জনের ঊপড়ে নির্ভরশীল হয়ে গেল। এমন কিছু বয়স তখন না। আমি জানতে চেয়েছিলাম সোফিয়া এসেছিল কিনা মা’কে দেখতে? এঞ্জেলা বলেছিল আসেনি। মায়ের ভালবাসা ও সোফিয়াকে দিতে পারেনি কখনো তাই কিছু আশা করে না মেয়ের কাছ থেকে। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়ে সোফিয়া দান্তের কাছে থেকে ডাইনারে কাজ করত। উশৃংখলতা ধীরে ধীরে কমে যায় লুসিয়ার আদরে। এঞ্জেলা স্বীকার করে মেয়েটা ওর খারাপ ছিল না, ভালবাসা না পেয়ে পেয়ে পাথর হয়ে গিয়েছিল মা আর ভাইয়ের প্রতি। দান্তের সেই ছোট্ট ডাইনার ধীরে ধীরে অনেক বড় হয়েছিল। সোফিয়া দান্তের একাঊন্ট সামলাতো সেই থেকে আইডিয়া পেয়ে সোফিয়া একাঊন্টিং নিয়ে একটা ডিপ্লোমা কোর্স করে একটা ব্যাংকে ঢুকেছিল। প্রমোশন পেয়ে মেয়ে এখন ভাল পজিশনে আছে, বিয়ে করে স্বামী, বাচ্চা নিয়ে সে ভাল সংসার করছে শুধু মা, ভাইয়ের জীবনে সে কেউ নয়।
এদিকে এঞ্জেলার দেখাশুনা করতে গিয়ে জন কিছুই করতে পারল না। ভীষন ভাবে ঘরকুনো হয়ে গেল। কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরত তারপরে আর বাইরে যেত না। কয়েকটা মেয়ের সাথে ডেটিং করেছে কিন্তু বেশি দিন কোনটাই টেকেনি। এঞ্জেলাও স্বার্থপরের মত নিজের সুবিধার জন্য জনকে মুক্তি দিল না। জনের জীবনও ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে গেল। যে সন্তান মাকে উৎসাহ দিয়েছিল জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর জন্য সেই সন্তান নিজেই কেমন বদলে গেল। অনেক ড্রিংক করতে শুরু করল জন । বাড়ি ফিরে আর কিইবা করারা ছিল? একসময় পুরোপুরি এলকহলিক হয়ে ওঠে জন। মায়ের জন্য যেটুকু করতে হবে তার বাইরে সে মায়ের সাথে আর কথা বলত না। যতদিন পল বেঁচে ছিল এঞ্জেলার জীবনটা কিছুটা হলেও স্বস্তির ছিল। পল যাবার সাথে সাথে ওর জীবনটাও কেমন রং হীন হয়ে গিয়েছিল। জনও অসুস্থ হয়ে যায় একসময়, মায়ের দেখাশোনা আর তেমন করতে পারত না আর আঞ্জেলার জায়গা হয় এই হোমে।

এঞ্জেলার সাথে কারো বনে না। সবার ভীষণ খুঁত ধরে আর খিটিমিটি লেগেই থাকে। সারাদিন অজস্রবার নালিশ শুনতে হয় সবার আর তার বিচার করতে হয় না হলে সে কান্নাকাটি করে একাকার করে। আজ দৌড়ে যাচ্ছি ওর রুমে, কি বিচার করতে হয় কে জানে? রুমের বাইরে থেকেই এঞ্জেলার চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। ঢুকে দেখি পওলিন গজগজ করতে করতে এঞ্জেলার রুম গোছাচ্ছে আর হুইলচেয়ারে বসে এঞ্জেলা বকে যাচ্ছে সমানে। জিজ্ঞেস করলাম “কি হয়েছে এঞ্জেলা?”… এঞ্জেলা বলল সে তার ডায়মন্ডের আংটি খুলে টেবিলের উপরে রেখেছিল কাল রাতে সকালে সেটা নেই… সকাল থেকে পওলিন ছাড়া ওর রুমে আর কেঊ ঢোকেনি অতএব ওটা পওলিন নিয়েছে। আমি জানি ওর ডায়মণ্ডের কোন আংটি নেই এবং এটা সেটা হারিয়ে গেছে বলে চীৎকারও নতুন কিছু নয় এঞ্জেলার জন্য। মাত্র কিছুদিন আগে এঞ্জেলা ডেমেনশিয়ার রোগী বলে চিহ্নিত হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি বললাম “অনেক ধন্যবাদ তোমাকে আমাকে বিষয়টা জানানোর জন্য, আমি আংটি খুঁজে বের করব ভেব না।” তারপড়ে কথা ঘোরানোর জন্য বললাম “ইশ দেখতো নখের নেলপলিশটা কেমন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এখন তো ফল চলছে চল ফলের সাথে ম্যাচ করে একটা লাল নেলপলিশ লাগিয়ে দেই?” খুব খুশী হল এঞ্জেলা। বলল “লাগিয়ে দাও”। আমি বললাম পওলিন সময় নিয়ে সুন্দর করে লাগিয়ে দিক আমাকে অন্য আর এক রুমে যেতে হবে। এঞ্জেলা রাজি হল কিন্তু এও বলতে ভুলল না যে আমি আর আগের মত ওর সাথে গল্প করি না। নালিশটা ভুল নয়। সকালের শিফটগুলো ভীষন ব্যাস্ত থাকে, কাজের কোন শেষ নেই, লাঞ্চের পড়ে কিছুটা সময় একটু ঝিমিয়ে পড়ে সব কিছু। তখন একটু সময় পাওয়া যায় কোথাও গিয়ে বসবার জন্য।
এঞ্জেলাকে প্রমিস করলাম যে শিঘ্রি আমরা আবার আগের মত গল্প করব, সাথে সাথে এও মনে পড়ল যে আমি চলে যাবার সাথে সাথে ও এটা ভুলে যাবে এবং আবার নালিশ করবে সময় না দেবার জন্য। আমার অবাক লাগে এই ভেবে যে কোনো এক সময় ওর কাছে বসে ওর গল্প শুনেছিলাম এটা ওর মাথায় গেঁথে আছে কিন্তু তারপরেও কতবার ওর কাছে বসেছি ওর কথা শুনেছি সেগুলো কিছুতেই ওর মাথায় থাকে না। আজব এক রোগ এই ডেমেনশিয়া, মনে হয় ইরেইজার দিয়ে খেয়াল খুশি মত কেউ যেন মানুষের স্মৃতির এখানটা ওখানটা মুছে দিচ্ছে। মানুষ যতই মনে করার চেস্টা করে স্মৃতিরা যেন একটা অন্ধকার দেয়ালে এসে ধাক্কা খায়, গুমরে গুমরে মরে। তখন যেন কি অদ্ভুত একটা কষ্ট হয়, সন্তান হারিয়ে ফেলার কষ্টের মত হয়ত।

এঞ্জেলার রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা মাসিমার রুমে গেলাম। মাসিমা যেন আমার জন্যই বসেছিলেন। আমি ঢুকতেই বললেন “এসেছো? আমি ভয় পাচ্ছিলাম যদি না আসো!” মাসিমাকে অভয় দিলাম, বললাম; মাসিমা আজকে ডাক্তার যাক তখন আপনাকে আমার অফিস ঘর দেখিয়ে দেব, আপনি নিজেই এসে আমাকে খুঁজে নিতে পারবেন।” তখন বুঝিনি কি সর্বনাশ করে ফেলেছি। ১১.০৫ এ ডাক্তার রুমে ঢুকল। সাথে একজন নার্স। ডাক্তার এসে কিছু পরিক্ষা, নিরীক্ষা করলেন, নার্স কিছু ব্লাড নিল। ইউরিন স্যাম্পেল নিল। শেষে ডাক্তার বললেন যে আপাতত মাসিমা পুরোনো অষুধগুলো খেতে থাকবেন এবং আজ নেয়া বøাড এবং ইউরিন স্যাম্পল এলে তখন দেখবেন যে কোন ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে কিনা। আমি ডাক্তারকে নিজের থেকে বললাম যে মাসিমা ইংলিশ বোঝেন না এবং বলতে পারেন না, এই কারনে তিনি খুব ভীত সন্ত্রস্ত। আমি ওনার ভাষা জানি তাই ওনার নেক্সট এপয়েন্টমেন্ট ওনার ছেলের সাথে আমাকেও ইমেইল করলে ভাল হবে যে ছেলে উপস্থিত না থাকতে পারলে যেন আমি হাজির থাকতে পারি। ডাক্তার বললেন ওনার কোন অসুবিধা নেই। আমি যেন ওনাকে ইমেইল করে আমার ইমেইল এড্রেস জানিয়ে দেই। ডাক্তার চলে গেলে আমি মাসিমাকে সব বুঝিয়ে বললাম। জানতে চাইলাম ছেলে অরুণ কখন ফ্রি থাকে, আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই। মাসিমা বললেন তিনি ঠিক ভাল করে জানেন না তবে ৫টার পরে আমি চেস্টা করতে পারি। আমার কাজ শেষ হয়ে যায় ৪টার মধ্যে। অরুণকে ৫টার পরে ফোন করতে হলে আমাকে কাজের পরে ফোন করতে হবে। অরুণের সাথে কথা বলা বা যোগাযোগ করাটা আমার দায়িত্বের মধ্যে ঠিক পড়ে না কিন্তু আজ এক বেলার মধ্যেই মাসিমার জন্য কেমন একটা অলিখিত দায়িত্ব এসে ভর করেছে আমার ঘাড়ে। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু মন বলল করতে হবে। (ক্রমাগত)