শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

পরের দিন ১১টার দিকে জন আর কেইটকে নিয়ে এল ওর দুই মেয়ে। ওরা নিজেদের রুমে গেল প্রথমে, সেখানে হোমের ফ্লোর ম্যানাজার গিয়ে দেখা করল ওদের সাথে তারপরে ফ্লোর পরিদর্শনে বের হল। প্রথমেই এল নার্সিং স্টেশনে। আমরা সবাই নিজেদের পরিচয় দিয়ে হাই বললাম ওদের সাথে। কি আদুরে দেখতে দুই বুড়ো বুড়ি। খুব হাসিখুশি আর মিষ্টি দু’জনেই। ওরা চলে গেল ডাইনিং হলের দিকে। আজ ওরা এখানেই লাঞ্চ করবে বলল। আমার টেবিলে ফাইল এল দু’জনার। আমি সব ইনফো কম্পিউটারে ঢোকানোর জন্য বসলাম। আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। কাল সারারাত এপাশ ওপাশ করেছি। ভাল ঘুম হয়নি একদম। আমি আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকি সারাক্ষণ। আমি ফ্রি ওষুধের জন্য মনোনীত হয়েছি, ওষুধ কোম্পানি ৩ মাসের সাপ্লাই পাঠিয়ে দিয়েছে এরমধ্যেই। ওষুধ খেয়ে বমিভাবটা কমেছে বেশ। এখন এমন খাই খাই ভাব বেড়েছে যে বলে বোঝানো যাবে না। মাঝরাতে উঠে মনে হয় কি খাব। বালিশের নীচে সারাক্ষণ কলা থাকে রাত্রিবেলা। ঘুম ভেঙ্গে উঠে কলা খেতে খেতে মনে হয় আমি রসগোল্লা খাচ্ছি। সকালে ঘুম ভেঙ্গেই মনে হয় ডিম খাব কখন। কোন এক আজব কারণে আর কোন কিছু খাবার খাওয়ার জন্য এত হাপিত্যেশ লাগে না। যাই হোক একটু আগের ঘটনা বলছি, আমি তখনও বিবাহিত নই; একবার খুব শরীর খারাপ হতে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানাল যে আমার ইউটেরাসে অনেক সিস্ট রয়েছে আর তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে বাচ্চা নিতে হবে না হলে পরে আমি আর বাচ্চা ধরে রাখতে পারব না। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, বিয়েই তো করিনি, বাচ্চা আসবে কোত্থেকে? আমি ক্যানাডাতে কাউকে চিনি না, থাকি হ্যামিল্টনে সেখানে সারাক্ষণ স্কুল আর কাজ এই নিয়ে পড়ে আছি, বর খুঁজে দেবে কে? দুঃশ্চিন্তায় আমার মাথা নষ্ট।

এইখানে এসে মনে হয় নিয়তিকে বিশ্বাস করতে হয়। যেটা হবার সেটা যেন হবেই। আজ এত বছর পরে পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয় যেটা যখন হবার কথা ছিল ঠিক তখনই মনে হয় হয়েছে বা ঘটেছে। কোত্থেকে আমার ছেলের পিতা তখন আমার সাথে যোগাযোগ করে জানাল যে সে এখানে আসতে চায়। ব্যাস হয়ে গেল, আসি বলার ২ মাসের মাথায় সে এখানে এবং তার মায়ের ইচ্ছায় ৫ মাসের মাথায় আমরা বিবাহিত। হ্যামিল্টন ছেড়ে টরন্টো চলে এলাম। আমার অবশ্য প্রধান একটা শর্ত ছিল যে আমরা বাচ্চা নিয়ে নেব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সেও রাজী হল। কোন একটা সময়ে আমি কনসিভ করলাম কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে গেল, বুঝলাম ডাক্তার যা বলেছে সেটা একদম ঠিক। ১ মাস অপেক্ষা করে আমার চেস্টা করলাম। আবার কনসিভ করলাম, এবারে আমি ভয়ে আধমরা; সব কিছুতে ভয় আমার। অক্ষরে অক্ষরে ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলছি।

সামারে আমি প্রতিদিন বাইরে বেঞ্চে বসে লাঞ্চ খাই। এই সময়টা আমি একা থাকতে ভালবাসি তাই দেরী করে লাঞ্চে যাই, যখন সবার লাঞ্চ শেষ আমি তখন আমার খাবারের ব্যাগটা নিতে ধীর পায়ে বাগানের বেঞ্চে গিয়ে বসি, ধীরে ধীরে খাই আর স্মৃতি রোমন্থন করি। আজও তাই করলাম। চারিদিকে ফুলের ছড়াছড়ি। যেদিকে তাকাই সবুজ আর রঙের বাহার। এখানে সামারটা এত ছোট তাও মানুষ হাজার ডলার খরচ করে বাগানের পেছনে। কার বাগান/লন কত সুন্দর হবে তার যেন একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলে। এককেকটা বাগান যেন একটা ছোট্ট বেহেস্ত। আমি রোদ বাচিয়ে বার্চের আড়ালে বেঞ্চে বসে আরামে খেতে শুরু করলাম। আমি মৌমাছি খুব ভয় পাই, সামারে এই একটা জিনিষ খুব বাজে, বাগানে বসলেই ওদের অত্যাচার। ছোটবেলায় একবার মৌমাছির হুলে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। মৌমাছিটা ঘরে ঢুকে এসে আমায় কামড়েছিল। আব্বা মৌমাছিটা দেখে আমার সরে যেতে বলল, আমিও এদিকে যাচ্ছি সেদিকে যাচ্ছি আর সেটাও আমার পিছু ছাড়ছে না, এর মধ্যে ঘাড়ে দিল হুল ফুটিয়ে। সে যে কি কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না। আমি বিছেও খুব ভয় পাই। ছোট বেলায় মাঝে মাঝে স্কুলে না যাবার বায়না করতাম। পেটে ব্যাথা একটা কমন বাহানা ছিল। মা এমন মার দিত স্কুলে যেতে না চাইলে, মার খেয়ে কিছুক্ষন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে চোখ মুছে খেলতে চলে যেতাম। আমার মনে আছে যেদিন আর্ট ক্লাস থাকত সেদিনই আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। ছবি আঁকাতে আমি সব সময় এমন ডাব্বা। ম্যাডাম একটা দোয়েল বা টিয়া পাখির ছবি বোর্ডে আটকে দিয়ে বলত দেখে দেখে আঁকতে তারপরে রঙ করতে। আমি পাখি আঁকতে গেলে ব্যাঙ হয়ে যেত আর ব্যাঙ আঁকতে গেলে গুবরে পোকা হয়ে যেত। এত এত চেস্টা করেছি, হয়নি! ম্যাডাম ঘুরে ঘুরে যখন সবার ছবি দেখত ঠিক আমার সামনে এসে একটা কান মলা দিয়ে বলত, ‘ তুই দেখেও আঁকতে পারিস না?’…ক্লাসের সবাই হেসে উঠত, যেন ছবি আঁকায় সবাই মহা পন্ডিত; মেজাজটা এমন খারাপ হত যে কি বলব। আর্ট ক্লাসে ম্যাডামের এই এক নিয়মের কোন অন্যথা হত না। ক্লাসের ছেলেগুলো এত পাঁজি ছিল যে আর্ট ক্লাসের আগে বোর্ডে কাকের ঠ্যাং এঁকে নিচে আমার নাম লিখে রাখত। আর ম্যাডামও ওদের কিছু বলত না বরং মুচকি হেসে আমার নিয়ে তামাশা করত। শুরুতে আমি এই ম্যাডামকে খুব পছন্দ করতাম, শ্যমালা করে কি মিষ্টি ছিল দেখতে যে মনে হত কোলে উঠে বসে থাকি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি তাঁকে ভয় পেতে শুরু করলাম।

বিছে রেখে কই চলে গেলাম। এমন এক সকাল বেলায় মায়ের মার খেয়ে কান্না কাটি শেষে মনের আনন্দে আমি বাগানে চলে গেলাম। একটা মোটা সোটা আম গাছের কান্ড ধরে আমি বাংলা সিনেমার নায়িকার মত ঘুড়তে গেলাম আর সাথে সাথে চীত্কার। আমার হাতে কয়েকশো কোটি বিছের বা ছ্যাঙ্গার কাটা ফুটে গেল। আমি গাছের দিকে তাকিয়ে দেখলাম কিলবিল করছে ছ্যাঙ্গা। আমি চেঁচাতে চেঁচাতে মায়ের কাছে। ডান হাতটা কালো হয়ে আছে ছ্যাঙ্গার কাটায়। মা হেসে বলল দেখলি স্কুলে গেলে এমন হত না। আমি রেগে গিয়ে আরো চেঁচাতে শুরু করলাম। মা কেমন করে নারকেল গাছের পাতায় শর্ষের তেল মাখিয়ে আস্তে করে হাতের ওপর থেকে টেনে নিল আর সব হুলগুলো পাতায় আটকে চলে গেল। কিন্তু পুরো হাত ফুলে গেল আর সেকি ব্যাথা, একদিক থেকে অবশ্য ভালই হয়েছিল; পরেরদিন এমনিতেই স্কুলে যেতে হয়নি। আমি তাই এখনো বাগানে গেলে বসবার আগে ভাল করে চারিদিক দেখে নেই। খেতে খেতে কত কিছু মনে পড়ছিল, সেই মফস্বলের রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ানো, হাডুডু আর ডাংগুলি খেলা মেয়েটা কি তখন জানত যে পৃথিবীর অপরপ্রান্তে এসে ঠেকবে সে? আমার ডান পায়ের নীচে ঠিক মাঝখানে একটা তিল রয়েছে। সবাই সেটা দেখে বলত আমি বিদেশে চলে যাবো। আর আমার ভীষণ দুষ্টু মেজদা সে বলত তিলটা যেহেতু ঠিক মাঝখানে তাই আমার কোথাও যাওয়া হবে না, এই দেশেই থেকে যাব। মেজদার কথা শুনলে আমার খুব মন খারাপ হত কারণ আমার দিদি তখন আলরেডি এ্যমেরিকায় চলে এসেছে আর আমি তখন বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই কবিতাটা সবে মাত্র শিখেছি। বিদেশে না গেলে দিদিকে দেখব কেমন করে? কত রাত এই চিন্তা করতে করতে মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করতাম কি করে দিদিকে দেখবো, মা রেগে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলত। বকা খেয়ে গাল ফুলিয়ে আমিও ঘুম।

আমার পতুলের বিয়ে, মেয়ে পুতুল আর ছেলে পুতুল দুটোই আমার। আমার পাশে বাড়ির বান্ধবি এসে আমার সাথে পুতুল খেলত। ওকে প্রস্তাব দিলাম যে মেয়ে পুতুলটাকে সে নিয়ে যাক আমি বরযাত্রি গিয়ে বউ তুলে নিয়ে আসব। বান্ধবি সাথে সাথে রাজি, সাথে এও বলে দিলাম যে বরযাত্রি কে খাওয়াতে হবে কিন্তু। তাতেও সে রাজি। এখন আমি ভাবি কেমন মহা বদ ছিলাম, জোর করে খাওয়া ও আদায় করে নিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে বর সাজিয়ে, বউয়ের সব জিনিষপত্র গুছিয়ে নিয়ে আমি আর আমার আর দুই বান্ধবি মিলে বরযাত্রি চললাম। রাস্তায় দেখা আমার ছোট ভাই মানে ছোটদার সাথে, আরেকটা পাঁজি। সে বলল যে সে আমাদের সাথে বরযাত্রি যাবে আমাদের মুরুব্বি হিসেবে। আরো বলল যে সাথে বড় কেউ না গেলে ভাল দেখায় না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। ছোটদা আমাদের সাথে চলল। পৌঁছে গিয়ে আমরা তিনজন চলে গেলাম ভেতরে বউ সাজাতে আর বসার ঘরে রয়ে গেল বর পুতুল আর সাথে আমার মুরুব্বি ছোটদা। বউ সাজিয়ে ফিরে এসে দেখলাম বর পুতুল গলায় দড়ি দিয়ে চেরারের হাতলের সাথে ঝুলে আছে, আমি অবাক হয়ে ছোটদার দিকে তাকাতে সে খুব গম্ভীর গলায় জানাল, ‘বউ পক্ষ এখনো কোন খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেনি তাই বর মনের দুঃখে গলায় দড়ি দিয়েছে’। আর কৈ যায়, সাথে সাথে আমি তারস্বরে চীত্কার করে কান্না আর মাটিতে গড়াগড়ি, আমার মাকে আসতে হয়েছিল সেই কান্না থামাতে। বিপদ দেখে ছোটদা কোন ফাঁকে কেটে পড়েছে। যাই হোক চোখ মুছে ভাল-মন্দ খেয়ে বউ নিয়ে বিদায় নিয়েছিলাম সেদিন। ছোটদা সঙ্গ নিয়েছিল খাবার জন্য বেচারার ভাগ্যে জোটেনি বরং মা এসে আমাদের সাথে খেয়েদেয়ে, তার বান্ধবির সাথে গল্প করে, পান খেয়ে বিদায় নিয়েছিল সাথে সবাইকে বৌভাতের দাওয়াত করে গিয়েছিল। এসব ভাবনা এলে মনটা নির্মল আনন্দে ভরে যায়। সেই পিচ্চি আমি আজ অপেক্ষা করছি একটা সত্যি পুতুলের জন্য। আহা কত সৌভাগ্য আমার! (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা