শারমীন শরীফ : শারমীন শরীফ তাঁর কাজের মাধ্যমে কানাডার বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের সংস্পর্শে এসেছেন। তাঁদের নিয়ে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ঘটনা তাঁর স্মৃতির ঝুলিতে জমা হয়ে আছে। ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য তাঁর স্মৃতির সেই ভাণ্ডার থেকে কিছু স্মৃতি তিনি উপস্থাপন করেছেন। তাঁর এই লেখা মূলত পৃথিবীর সব বয়স্ক-বৃদ্ধ মানুষদের প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে ‘বাংলা কাগজ’এ বের হবে।

আজ গুরপ্রীত চলে আসছে ওর নতুন আবাসে। রুহা সকালেই বেরিয়ে গিয়েছে, যাবার সময় আমি ওকে বলেছিলাম আমাকে ফোন করে জানাতে যখন ওরা পথে। রুহা যথারীতি ফোন করে জানালো যে সব জিনিসপত্র নিয়ে ওরা এখন রাস্তায় এবং গুরপ্রীত ওর গাড়িতে। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম কটা বাজে, মনে মনে ভাবলাম জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বসতে ওদের আরো ঘন্টা দুই লাগবে আর ততক্ষণে আমার লাঞ্চব্রেক শুরু হয়ে যাবে। আমি ভাবলাম লাঞ্চব্রেকে আমি ওখানে যাবো, কেমন কি হল গিয়ে দেখে আসব। এই ট্রিপটা আমার কাজের মধ্যে পড়ে না, নিজের মনের টানেই যেতে ইচ্ছে করছে আর তাই কাজের সময় ব্যয় করতে চাই না। হাতের কাজ গুছিয়ে রাখলাম আগের থেকে। আমার সুপারভাইজারকে বললাম যে আমি বাইরে যাচ্ছি লাঞ্চ করতে এবং কই যাচ্ছি তাও বললাম। আমি খুব সৌভাগ্যবান যে আমার সুপারভাইজার মারিনা খুব ভাল একজন মানুষ। যদিও কাজের সময় সে তার বুদ্ধিই বেশি ব্যবহার করে কিন্তু কখন হৃদয় ব্যবহার করতে হবে তাও সে জানে, যেমন আজ এই মুহুর্তে সে তাঁর হৃদয় দিয়ে বলল- যাও, সময় নাও, তাড়াহুড়ো করে ফিরতে হবে না, এটা কাজেরই অংশ। আমি খুশী হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আজকাল অল্পতেই আমার নিজেরও বেশ ক্লান্ত লাগে, হাফ ধরে যায়। যেতে যেতে পথে টুকটুক করে স্যান্ডউইচটা খেয়ে নিলাম সাথে অনেকটা পানি। পৌঁছে দেখি পুরুষ নার্স মার্ক চলে গিয়েছে, হারপ্রীত আর রুহা মিলে সব গোছাচ্ছে। হারপ্রীত এখন রান্নায় ব্যাস্ত। আমায় দেখে ওরা দারুণ অবাক হল আর গুরপ্রীত দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরল। এখানে এসে আমার মনে হল কি হচ্ছে দেখার চেয়ে মনে হয় এই ভালোবাসাটুকু পাবার লোভেই আমি এখানে এসেছি। আমার অবচেতন মন জানত গুরপ্রীত আমায় দেখে খুশী হবে এবং আমি ওর কাছে এতটুকু হলেও গুরুত্বপূর্ণ কেউ।

ওরা যখন গোছানোতে ব্যাস্ত আমি তখন গুরপ্রীতকে নিয়ে একটা বিল্ডিংটুর দেবার জন্য বেরুলাম। ওর রুমটা ৫ তলায়। এলভেটর ধরে নিচে নামতেই হাতের বাঁদিকে একটা রিক্রিয়েশন রুম। ওখানে কার্ড খেলা হয়, লুডো, বিংগো খেলার আয়োজন আছে, একটা সেলফে অনেক বইও আছে দেখলাম। অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে গল্প করছে। এত মানুষ দেখে গুরপ্রীত কেমন জড়সড় হয়ে গেল। দুজন মহিলা এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন নতুন কিনা। আমি হিন্দিতে বললাম যে ওর নাম গুরপ্রীত এবং আজই তার প্রথম দিন। গুরপ্রীত পাঞ্জাবীতে ওদের সাথে কথা বলা শুরু করলে আমি চুপ করে গেলাম। ওরা গুরপ্রীতকে সাথে করে ওদের টেবিলে নিয়ে গেল, যেখানে আরো কয়েকজন বসে ছিল। আমি বইয়ের সেলফের দিকে এগিয়ে গেলাম, বই ঘাটতে ঘাটতে মনে হল একটা ভুল করে ফেলেছি, গুরপ্রীতকে নিয়ে আমার আসা উচিৎ হয়নি। আমি যেহেতু পাঞ্জাবী বলতে পারি না ইচ্ছে করলেই আমি ওকে কিছু বুঝিয়ে বলতে পারব না।

আমার এমন মনে হবার কারণ হল আমি চাই না গুরপ্রীতের ছেলের সাথে ওর সম্পর্কের বিষয়টা এখানে সবাই এখনি জানুক। আমাদের সাউথ এশিয়ান মানসিকতার কথা আমারা কম বেশি সবাই জানি। চাই না শুরুতেই ওরা গুরপ্রীতকে করুণার চোখে দেখুক, তাহলে ওর আর বন্ধু বানানো হবে না, শুধু তাই নয় সবাই ওকে এই নিয়ে অজস্র প্রশ্ন করে বিব্রত করবে। আমি দ্রæত ওদের টেবিলে ফিরে গিয়ে বললাম যে আমাদের এখন যেতে হবে। গুরপ্রীতের ফ্ল্যাট নম্বর দিয়ে বললাম ওর দিকে একটু নজর রাখতে। সবাই আশ্বস্ত করল।

রুমে ফিরে গিয়ে আমি রুহাকে আমার আশংকার কথা বলাতে রুহা সায় দিল এবং বলল যে এটা ওর মাথায় আসেনি। রুহা গুরপ্রীতকে জিজ্ঞেস করল ও বেশি কিছু বলেছে কিনা। গুরপ্রীত নিজে থেকেই বলল যে সে তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কারো সাথে আলাপ করতে চায় না। তাই সে কিছুই বলেনি, শুধু বলেছে আগে ও ব্র্যাম্পটনে থাকত। আমি শুনে খুব খুশী হলাম। রুহা ওকে বুঝিয়ে বলল আমাদের আশংকার কথা। গুরপ্রীত বলল যে সে বলবে তাঁর কেউ নেই, ওর স্বামী মারা যাবার পর থেকে ও একা এবং একটা মেয়ে ছিল মরে গিয়েছে। ছেলের কথা সে কিছুতেই বলবে না। আমরা আশ্বস্ত হলাম, আমি মনে মনে ভাবলাম যে গুরপ্রীত টিকে যাবে এখানে। ৫ তলার বেশ খোলা মেলা একটা এপার্টমেন্ট, বড় বড় জানালা, রুহা আর হারপ্রীত মিলে বেশ সাজিয়েছে। স্যালভেশান আর্মি থেকে অনেক কিছু তুলে এনেছে রুহা, একটা ছোট্ট টিভিও আছে সাথে, আয়োজন দেখে আমি বেশ মুগ্ধ, তার থেকেও বেশি মুগ্ধ গুরপ্রীত। বিল্ডিং অফিস প্রয়োজনে গ্রোসারীও করে দেয়। সবাইকে গ্রোসারী ফর্ম দিয়ে যায় সপ্তাহের শুরুতে, যার যা প্রয়োজন লিখে রাখে বৃহস্পতি বারে ওরা ফর্ম কালেক্ট করে শুক্রবারে গ্রোসারী দিয়ে যায় এবং মাসের শেষে সবাইকে বিল করে। গুরপ্রীতের ওসব দায়িত্ব আমরা নিয়েছি বলে ওর ওসবের ঝামেলা নেই। এই পর্যায় আমি বিদায় নিতে রেডি হলে রুহা বলল, আজকের মত সেও রেডি যাবার জন্য এবং আমি চাইলে তার সাথে যেতে পারি।

হারপ্রীত আরো আধাঘন্টা থাকবে টুকটাক কাজ শেষ করার জন্য। গুরপ্রীত হাগ দিয়ে আমাদের বিদায় দিল। বুঝলাম সে আগের থেকে অনেক সাবলিল এবং সংকোচের খোলস ভেংগে বেরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে, সে বুঝতে পেরেছে যে সে আর যাই হোক, সহায়হীন নয় আর। তার ঘরে একটা ফোন লাইন এনে দিয়েছে রুহা, সে এখন আমাকে, রুহাকে এবং হারপ্রীতকে যেকোন প্রয়োজনে ফোন করতে পারবে যেখন তখন, একটা ছোট্ট খাতায় রুহা আমাদের নাম ও নাম্বার বড় করে লিখে ফোনের পাশে রেখে দিয়েছে।

রুহা আমার ভাল বন্ধু, আমরা প্রায়ই একসাথে বাইরে লাঞ্চ করতে যাই। একে অন্যকে ট্রীট করি। আমাদের কাজের আশেপাশের সব ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টগুলো আমাদের চেনা। আমার সব থেকে পছন্দের জায়গা হল দোসা হাট। রুহার সাথে ওর বরের অনেক বয়সের ব্যাবধান। ওদের ১৬ বছরের একটা মেয়ে আছে। রুহার দাম্পত্য জীবন সুখের নয়। কোন কিছুই না শুধু ওদের দুজনার সব কিছুতেই বিস্তর ফারাক। ছুটির দিনে দুজনে সারাদিন বাড়িতে কিন্তু তারপরেও ৩টির বেশী বাক্য বিনিময় হয় না। ওর বর স্পোর্টস চ্যানেল আর ইন্ডিয়ান নিউজ চ্যানেল নিয়ে পড়ে থাকে সারাদিন, মেয়ে মেয়ের মত আর রুহা বাজার, রান্না, লন্ড্রি এগুলো নিয়ে কাটিয়ে দেয় সারাদিন। মাঝে মাঝে ছুটিরদিনে দাওয়াত থাকলে কিছুটা হাফ ছেঁড়ে বাচে সে। রুহা বলে ওর বাড়িতে যেতে ভাল লাগে না, সব কিছু কেমন গুমোট লাগে। মেয়েটা আগে অনেক কাছের ছিল, টিন হবার সাথে সাথে তারও পরিবর্তন এসেছে, সেও তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। গাড়ি চালাতে চালাতে রুহা বলল- “মনিরা সুখ কি বলতে পার? সুখের সংজ্ঞা কি?” অনেক বড় প্রশ্ন কিন্তু উত্তরটা খুব সোজা; আমার মত করে আমি ভাল থাকার নামই হল সুখ, কিন্তু “আমার মত আমি” থাকাটাতেই যত গণ্ডগোল কারণ ইচ্ছে হলেই সব কিছু সম্ভব নয়। রুহা বলে ওর কাজটাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে, অজস্র ক্লায়েন্ট ওর জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে প্রতিদিন। তাঁদের জন্য ওর ভালবাসা আর ওর জন্য তাদের ভালবাসা, এই অপূর্ব স্বার্থহীন ভাব বিনিময়ে রুহার কাছে সুখ। আমি বললাম এও এক স্বর্গীয় সুখ রুহা, এই বা ক’জনের ভাগ্যে জোটে বল? (ক্রমাগত)
শারমীন শরীফ : সাংস্কৃতিক কর্মী, টরন্টো, কানাডা