অনলাইন ডেস্ক : দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের শঙ্কা ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষত পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকদের লেবানন থেকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। অনেকে আবার এ সংক্রান্ত পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। তবে অনুন্নত দেশগুলো এ ক্ষেত্রে এখনও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।বেশকিছু দেশ লেবাননের ভেতরেই নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পেরেছে। মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) ইসরায়েলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বড় পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। খবর আলজাজিরার।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলি থেকে আরও বাসিন্দাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ তার সৈন্যরা দেশটির দক্ষিণে হিজবুল্লাহর যোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছে।

গত মাসে ইসরায়েল দেশটিতে আক্রমণ তীব্র করার পর থেকে প্রায় ১০ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং এক হাজারেরও বেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন।

অনেক বিদেশি দূতাবাস এক্স অ্যাকাউন্ট এবং অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের নিজ নিজ নাগরিকদের জন্য নির্দেশিকা এবং ভ্রমণ পরামর্শ দিচ্ছে।

এখানে সেই দেশগুলো রয়েছে যারা তাদের নাগরিকদের লেবানন ছেড়ে যেতে বলেছে এবং যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র: সাম্প্রতিক এক্স পোস্টে বৈরুতে মার্কিন দূতাবাস একটি লেভেল ফোর মাত্রার ভ্রমণ নির্দেশনা দিয়েছে। এতে বলা হয় ‘ভ্রমণ করবেন না’ – সর্বোচ্চ এই নির্দেশনা যা পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অফ কনস্যুলার থেকে জারি করা হয়। এতে বলে হয়, ‘জীবন হুমকির মুখে পড়ে যাওয়ায় এটি সর্বোচ্চ পরামর্শমূলক স্তর।’

যুক্তরাষ্ট্র আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তার নাগরিকদের দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য বাণিজ্যিক ফ্লাইট ব্যবহার করতে বলেছিল কারণ ইসরায়েল লেবাননের গভীরে হামলা শুরু করে। ২০২২ সালের হিসাব অনুসারে, প্রায় ৮৬ হাজার মার্কিন নাগরিক লেবাননে বসবাস করেন।

অস্ট্রেলিয়া: মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের অবিলম্বে লেবানন ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ। ‘আমরা লেবাননে থাকা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের দেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছি। এগুলো অস্থির পরিস্থিতি এবং আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকরা নিরাপদ, তিনি বলেন।

অস্ট্রেলিয়া সরকার এখন তার কিছু নাগরিককে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। আনুমানিক অস্ট্রেলিয়ার ১৫ হাজার নাগরিক লেবাননে বসবাস করেন। লেবাননে অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূত অ্যান্ড্রু বার্নস, এক্স-এর একটি সাম্প্রতিক পোস্টে নাগরিকদের লেবানন থেকে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি) ক্রাইসিস পোর্টালে নিবন্ধন করার পরামর্শ দিয়েছেন।

যুক্তরাজ্য: পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি ব্রিটিশ নাগরিকদের লেবানন ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কারণ ‘লেবাননের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল এবং খারাপ হচ্ছে’।

তার এক্স অ্যাকাউন্টে একটি সাম্প্রতিক ভিডিও পোস্টে, ল্যামি বলেছেন যে যুক্তরাজ্য সরকার লেবাননের বাইরে চার্টার্ড ফ্লাইট সরবরাহ করবে।

তিনি বলেন, ‘আপনার নিরাপত্তা আমার অগ্রাধিকার, এবং লন্ডন এবং বৈরুতে বিদেশি অফিসের দলগুলো বাণিজ্যিক ফ্লাইটের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আপনার ছেড়ে যাওয়ার জন্য আসন সুরক্ষিতসহ সমর্থন প্রদানের জন্য চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে চলেছে,’ তিনি জোর দেন।

ব্রিটিশ সরকার বলেছে, যে তারা বৈরুত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যবস্থা করবে এবং অর্থায়ন করবে। যাইহোক, যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের প্রতিটি আসনের জন্য ৩৫০ পাউন্ড ফি দিতে হবে। আনুমানিক চার থেকে ৬ হাজার বৃটিশ নাগরিক লেবাননে বাস করেন।

গত সপ্তাহে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় লেবানন থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ৭০০ সৈন্যকে সাইপ্রাসে স্থানান্তরিত করেছে।

ফ্রান্স :লেবাননের সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সও তার নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। আনুমানিক ২০ হাজার ফরাসি নাগরিক লেবাননে বাস করে।

ফরাসী সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র মঙ্গলবার বলেছেন যে এটি একটি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার পাঠাবে, যা আগামী দিনে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত, তার নাগরিকদের সম্ভাব্য নিরাপদভাবে সরিয়ে নেয়ার জন্য।

সোমবার বৈরুতে লেবাননের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ সমন্বয়কারী জিনাইন হেনিস-প্লাসচের্টের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-নোয়েল ব্যারটের বৈঠকের আলোকে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি বিমান হামলার ফলে বোমা বিস্ফোরণে দক্ষিণ লেবাননে একজন ৮৭ বছর বয়সী ফরাসি নারী নিহত হয়েছেন। ফ্রান্স সরকার আগস্টের শুরু থেকেই তার নাগরিকদের দেশ ছাড়ার জন্য সতর্কতা জারি করেছে।

কানাডা: লেবাননের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হওয়ার কারণে কানাডাও সোমবার দেশ থেকে তার নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। ‘লেবাননের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমশ বিপজ্জনক এবং অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। বিমানবন্দরটি খোলা রয়েছে এবং বাণিজ্যিক ফ্লাইট এখনও সচল রয়েছে,’ পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেলানি জোলি মঙ্গলবার তার এক্স অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন।

কানাডার বৈদেশিক বিষয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগ অনুসারে, ৪০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার কানাডার নাগরিক লেবাননে বসবাস করে।

জার্মানি :জার্মানি ইতোমধ্যে লেবানন থেকে দেশটির নাগরিক সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। দূতাবাসে অপ্রয়োজনীয় কর্মী, তাদের পরিবার এবং চিকিৎসাগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জার্মান নাগরিকদের

সোমবার জার্মান পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যৌথভাবে ঘোষণা করেছে যে, লেবানন ছাড়তে ইচ্ছুক জার্মান নাগরিকদেরও সহায়তা দেবে তারা।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, লেবাননে ১,৮০০ নিবন্ধিত জার্মান নাগরিক রয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সোমবার বৈরুত বিমানবন্দর থেকে ১১০ জার্মান নাগরিককে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

ইতালি: পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি সোমবার দেশটির নাগরিকদের লেবানন ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।’এই সময়ে দেশ ছেড়ে যাওয়াই ভালো কারণ পরিস্থিতি সত্যিই জটিল, সেখানে সংঘাত চলছে। সর্বাধিক নিরাপত্তার স্বার্থে ইতালীয় নাগরিকদের লেবানন ছেড়ে জন্য চলে যাওয়াই ভালো,’ তাজানি যোগ করেন।

কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা আমাদের দূতাবাসকে সুরক্ষা দিতে তুসকানিয়া প্যারাট্রুপার কারাবিনিয়ারির উপস্থিতি জোরদার করেছি। তাজানির মতে, প্রায় ৩০০ ইতালীয় কাজের জন্য লেবাননে রয়েছেন। আর প্রায় তিন হাজার দ্বৈত নাগরিক রয়েছেন।

কী অবস্থায় সেখানকার বাংলাদেশিরা : লেবাননে থাকা প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি চরম অনিশ্চয়তা এবং শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। অধিকাংশই রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে।

গেল শুক্রবার লেবাননে আকাশপথে আগ্রাসন শুরু করে ইসরায়েল। সবচেয়ে তীব্র হামলা চলছে দক্ষিণাঞ্চলের দাহিতে। তাই সেখান থেকে বাংলাদেশিরা প্রাণ বাচাঁতে যাচ্ছেন বৈরুতের দিকে। সেখানে সরকারিভাবে নানা আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও তাতে প্রবেশাধিকার পাচ্ছেন না বাংলাদেশিরা।

এক প্রবাসী বাংলাদেশি বলেন, কোম্পানির কাছে গিয়ে বললাম আমাদের এই করুণ অবস্থা। তখন কোম্পানির মালিক বললেন, আমরা নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। আপনাদের নিরাপত্তা কীভাবে দিব?

তিনি আরও বলেন, আমাদের খাবার দরকার। কিন্তু আমরা কই খাবার পাব? আমরা খোলা আসমানের নিচে আছি। আমাদের জানের নিরাপত্তা কী? এখানে লেবানিজরা এসে অন্যদের খাবার দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের দেইনি। আমাদের এখন তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছি। আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নাই। আমরা এখন কোথায় যাব?

তবে আশ্রয়কেন্দ্রে প্রবেশাধিকার না পাওয়া বাংলাদেশিদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন সামর্থবানরা। ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলছে উদ্ধারকাজ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঘুরে খাবার ও পানি সরবরাহ করছে বাংলাদেশ দূতাবাস। তবে সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য।

আরেক বাংলাদেশি প্রবাসী জানান, হামলার খবরে তারা এক কাপড়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসেন। সঙ্গে কোনো টাকা-পয়সাও আনতে পারেননি। রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। তারা সরকারের সহায়তা চান।

এদিকে লেবাননের সংঘাতে এ পর্যন্ত আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি। দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে চলছে তাদের চিকিৎসা। আটকে পড়াদের ফিরিয়ে আনতে এরই মধ্যে কাজ করছে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ।

ভারত: ইসরায়েলের হামলাকে বিবেচনায় নিয়ে তার নাগরিকদের লেবাননে ভ্রমণ না করতে পরামর্শ দিয়েছে ভারত। সরকারি তথ্য অনুসারে, লেবাননে চার হাজারের এরও বেশি ভারতীয় রয়েছেন। নয়াদিল্লি তাদের সবাইকে দ্রুত লেবানন ছেড়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে।

বৈরুতে ভারতীয় কনস্যুলেটের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘লেবাননে প্রায় ৪ হাজার ভারতীয় নাগরিক রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ খাত, কৃষি খামার ইত্যাদিতে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আছেন,’