শারমীন শরীফ : ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম জেলার স›দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে হান্নানা বেগম জন্মগ্রহণ করেন। মা আয়েশা খাতুন, বাবা মোহাম্মদ শামসুল হুদা। তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
কুমিল্লায় মামার বাড়িতে বেড়াতে এসে ‘অভয় আশ্রয়’ স্কুলে তাঁর পড়াশোনার প্রথম হাতে খড়ি হয়। তাই শৈশব কেটেছে গ্রামে। ছোটবেলার একটি মধুর স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘একবার স্কুলে সবার থেকে বেশি নাম্বার পাওয়াতে তাঁর সাথীরা তাঁকে পথে একা ফেলে চলে যায়’। বাবা ছিলেন একজন রেলওয়ে কর্মকর্তা। আরবি, ফার্সি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর সমান দক্ষতা ছিল, সেই সাথে তিনি ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ। আর এজন্যই তাঁদের বাড়িতে সব সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আনাগোনা ছিল। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো যে এত আধুনিকতাঁর সত্তে¡ও মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাঁদের দ্বিধা ছিল। আর এই কারণে হান্নানা বেগমের বড় বোনের উচ্চ শিক্ষা হয়নি। তাঁর মনের মধ্যে সব সময় একটা আতঙ্ক বিরাজ করতো যে বড় বোনের মত তাঁর ওপর পড়াশোনা করা হবে না। অন্যান্য বেগমের বিয়ের আলাপ শুরু হয় তখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন। পাত্র তখন ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে পড়াশোনা করছে। বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন সময়ে কোন একটি কারণে পাত্র মৃত্যুবরণ করে এবং বিয়ের আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার তাঁকে বিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় তখন তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্রী। এবার পাত্র ছিল বুয়েটের এক মেধাবী ছাত্র। কিন্তু হান্নানা বেগম দম্ভার পাত্রী ছিলেন না, এবারে বিয়ে বন্ধের জন্য তিনি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে অনশনে চলে যান, এবং এমন অবস্থা হয়েছিল যে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়েছিল। এরপরে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে বিয়ের কথা তুলে তাঁর পড়াশুনাতে আর ব্যাঘাত ঘটানো হবে না। অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করেছিলেন এবং এরপর পড়াশোনা তিনি সম্পূর্ণভাবে সরকারি খরচে করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে তিনি চট্টগ্রামের ডাঃ খাস্তগীর স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন।
চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে নবীন বরণ অনুষ্ঠান থেকেই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হয়ে ওঠেন এবং একপর্যায়ে সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের ১১ দফার আন্দোলনে আইয়ুবশাহীর পতনের সময় তিনি তখন চট্টগ্রাম শহর শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। এ সময় রাজপথ ও ছাত্রী ইউনিয়নের অফিসই ছিল তাঁর ঠিকানা। তাঁর কাজ ছিল তখনকার সময় স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্রীদের সঙ্ঘবদ্ধ করা এবং নেতৃত্ব দেয়া। গোয়েন্দা বিভাগের তৎপরতায় তাঁর অভিভাবকদের এ সময়ে দারুন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। গণজোয়ারের উত্তল তরঙ্গে প্রতিদিন স্বতঃস্ফূর্ত নারী পুরুষ ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে এসে দাবি জানাতো সংঘটিত হওয়ার জন্য। এভাবে একদিন গড়ে ওঠে স্কুলের ‘ঝি সমিতি’, তাঁদের পেশাগত দাবি নিয়ে আর এই সমিতির সভাপতি ছিলেন হান্নানা বেগম।
১৯৬৯ এর গণআন্দোলনের সময় থেকেই ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি চলতে থাকে বাংলাদেশে একটি নারী সংগঠন সৃষ্টি করার। শুধু সাজগোজ এবং ঘরকান্না নয়, নারীদের মধ্যে সচেতনতাবোধ সৃষ্টি করাই ছিল যার উদ্দেশ্য। চলতে থাকেন নারী সংগঠন গড়ে তোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা।
১৯৭০ সালের ১৯ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার শাখা গঠিত হয়। যুগ্ন আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে হান্নানা বেগম এর সংগঠন গড়ে তোলায় নিবেদিত হন। স্বাধীনতা পূর্বকালে চট্টগ্রামে মহিলা পরিষদের বিস্তৃতি ছিল অবিস্মরণীয়। মিসেস ওমরতুল ফজল আহŸায়ক, বেগম মুসতারি শফি যুগ্ন আহবায়কদের একজন, সীমা চক্রবর্তী, দিল আফরোজ, চিত্রা বিশ্বাস, জাহানারা বেগম, ননীবালা বড়ুয়া, উম্মে সালমা, জাহেদা মনসুরা, নুরজাহান খান, রমা দত্ত, মিসেস মন্ডলসহ একনিষ্ঠ বিশাল কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর দিকনির্দেশনায় এ সংগঠনের গণজোয়ার ছিল অবিশ্বাস্য রকম। তখনকার দিনেও প্রত্যেকটি গণজমায়েতের জন্য মাইকিং করতেন মহিলারা এবং এমন সমাবেশ হত যা চট্টগ্রামের কোন মিলনায়তনে ধারণ ক্ষমতা ছিল না। প্যান্ডেল করে মাঠে ওই সভা করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে এ সংগঠনের সদস্যরা আত্মনিবেদন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই সক্রিয় অবদান রাখেন।
১৯৭২ সালের স্বাধীনতাঁর পর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। হান্নানা বেগম চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদিকা মনোনীত হন এবং দীর্ঘ ষোলো বছরে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতাঁর পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালে তিনি ও তাঁর বড় বোন লেখিকা হাসিনা খাতুন স্বীকৃতি নামে একটি সাপ্তাহিক মহিলা সাময়িকী নিয়মিত প্রকাশ করেন বেশ কয়েক বছর। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী এ এ.ম. আনোয়ারুল কবিরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচিত সভাপতি, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট, এবং বঙ্গবন্ধু ল’ কলেজের অধ্যক্ষ। ১৯৮৪ সালে নারী নির্যাতন ও সামাজিক-অনাচার প্রতিরোধ কমিটি দেশব্যাপী যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে চট্টগ্রামে হান্নানা বেগম তাঁর অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তাঁর তৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, কৃষক ও সর্বস্তরের মানুষ এ নারী নির্যাতন ও সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলনের শামিল হন।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে উজ্জীবিত করে তোলার জন্য বাংলাদেশে প্রথম বিজয় মেলা শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকে। ১৯৯০ সালে অধ্যাপিকা হান্নানা বেগম ছিলেন তাঁর অন্যতম সংঘটক। সাংবাদিক আবুল মোমেন, ফারুক-ই- আজম বীরপ্রতীক, রানা দাশগুপ্ত, সাংবাদিক আজিজুল ইসলাম ভূইয়া ও অধ্যাপিকা হান্নানা বেগম এর প্রাথমিক উদ্ভাবক।
নবম শ্রেণীতে অধ্যানরত অবস্থায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ললাট লিখন’ চট্টগ্রামের ‘বান্ধবী’ পত্রিকার ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তিনি পত্রপত্রিকায় নিয়মিতভাবে লিখতেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ৩/৪ তারিখে পাহাড়তলী ওয়ারলেস কলোনিতে যখন বাঙালি-বিহারী দাঙ্গা হয় তিনি তখন সেখানেই ছিলেন। বাবা রেলওয়ে কর্মকর্তা সুবাদে ওয়ারলেস কলোনিতে তাঁদের বহুদিনের আবার। ১৯৭১ এর ১৯ শে মার্চ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের চট্টগ্রামে স্মরণকালের বৃহত্তম মহিলা জমায়েত হয়। জে এম সেন হল বা মুসলিম ইনস্টিটিউটে জমায়েত আটবে না বলে জে এম সেন হলের মাঠে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। কবি সুফিয়া কামাল, মালেকা বেগমসহ কেন্দ্রীয় নারী নেতৃবৃন্দ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। মহিলারাই তখন মাইকিং করতেন। দিল আফরোজ, নজমে আরা, চিত্রা বিশ্বাস, ননীবালা বড়ুয়া, উম্মে সালমা মাইকিং করতেন। এবং মাইকিং করতে করতে তারা হান্নানা বেগমের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতো। বিহারীদের কাছে হান্নানা বেগম তখন চিহ্নিত শত্রু। কিন্তু তবুও তিনি এই এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান নি। তারা জানতেন রণে ভঙ্গ দিয়ে এলাকা ছাড়লেই বাঙ্গালীদের উপর বিহারী অত্যাচার আরো বেড়ে যাবে। এরপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বাধ্য হয়ে সব ফেলে খালি হাতে হান্নানা বেগম ও তাঁর পরিবার পাঠানটুলি পানওয়ালা পাড়ায় অন্যের বাসায় এসে আশ্রয় নেন।
অনেকেই তাঁদের বুদ্ধি দিয়েছে ওপারে চলে যাবার জন্য কিন্তু হান্নানা বেগম সে কথায় কান্না দিয়ে মনস্থির করেন দেশের অভ্যন্তরে থেকেই তিনি তাঁর মত করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি বোরখা পড়ে কাজ করতে শুরু করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খবরা খবর সংগ্রহ শুরু করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন খাবার দিতেন এবং তাঁদের জন্য টাকা সংগ্রহ করে আনতেন। এভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের শামিল হয়েছেন এবং সহযোগী হিসেবে তখন তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর বোন হাসিনা খাতুন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার জন্য শহীদুল্লাহ নামে একটা ডাক্তারের মেয়েকে করানোর দায?িত্ব নিয়েছিলেন, তার একমাত্র কারণ ছিল এই বাড়িতে টেলিফোন ছিল। হান্নানা বেগম বলেন ওই সময়ের একটি স্মৃতি তিনি কখনোই ভুলতে পারেন না, তাহলোঃ তাঁর ফুপাতো ভাই জসিম মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল কিন্তু তাঁর আগেই রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পাক বাহিনী নির্যাতন করে তাঁকে মেরে ফেলে। আর এক মুক্তিযোদ্ধা রকিব তখন তাঁদের বাসায় লুকিয়ে ছিল তখন পাহাড়তলী থেকে খবর আসে রকিবের বাবাকে বিহারীরা ধরে নিয়ে গেছে। পাহাড়তলীর প্রতিটি বাড়ি থেকে পুরুষ সদস্যদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল বিহারীরা। তারা রাস্তায় হাটতো এবং হাঁক দিয়ে যেত, “এক শির ১০ রুপেয়া”, বলে।
বিজয়ের দিন ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলেই তিনি ছুটি গিয়েছিলেন পাহাড়তলীর কর্মী বোনদের দেখতে। গিয়ে জানতে পারেন বহু নারী কর্মী ইতিমধ্যে বিধবা হয়েছেন।
কয়েকদিনের মধ্যেই আবিষ্কৃত হয় পাহাড়তলীর বধ্যভ‚মি। হাজার হাজার মানুষের মাথার খুলিয়ার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হার গুলি তিনি পরম ভালোবাসায় স্পর্শ করতেন। পরবর্তীকালে মহিলা পরিষদের সকল মিছিল এই বধ্যভ‚মি থেকেই শুরু হতো এবং শেষ হত। স্বাধীনতাঁর পর পরই চট্টগ্রাম মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে নিরন্ন শহীদ পরিবারের নারীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাগজের ঠোঙা বানানোর প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। মহিলারা ঠোঙা বানিয়ে মহিলা পরিষদকে দিত এবং বিনিময় পারিশ্রমিক পেত। হান্নানা বেগম ছিলেন এই প্রকল্পের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা।
হান্নানা বেগমের দুটি সন্তান, একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে। কর্মজীবনের দীর্ঘ সময় অধ্যাপক হান্নানা বেগম চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে অধ্যাপনা করেন। অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক এ সাহসী নারী একসময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে উপপরিচালক পদে নিয়োজিত ছিলেন। অর্থনীতিবিদ হান্নানা বেগম নারী অর্থনীতি বিষয়ক বহু গ্রন্থের প্রণেতা। পেশাগত জীবনে অর্থনীতির অধ্যাপক। দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে অধ্যাপনা ছাড়াও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) ডেপুটি ডাইরেক্টর, জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম বোর্ডে মেম্বার কারিকুলাম ও চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।