শারমীন শরীফ : শেফালী দাস, ১৯৪৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর টাঙ্গাইল সদরে একটি সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কুমুদবিহারী দাস অত্যন্ত প্রগতিশীল একজন মানুষ ছিলেন। তিনি একটি প্রাইভেট লোন অফিসের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করতেন। অবসর সময় তিনি কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং সেই সাথে সেই সাথে অভিনয়ের প্রতিও ছিল তার ভালোবাসা। মা হিরণ কুমারী দেবী গৃহিনী ছিলেন। তিনি তার স্বামীর সাহচর্যে পড়াশোনা শিখেছিলেন এবং সেই সাথে ভালো ইংরেজিও শিখেছিলেন, ফলে স্বভাবতই ছেলেমেয়েদের উপরেও সেই শিক্ষার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বাবা-মার দশ সন্তানের মধ্যে শেফালী ছিলেন পঞ্চম। বাবার হাত ধরেই ভাই-বোন সহ তিনি গান করতেন এবং একসাথে নাটকে অভিনয় করেছেন সেই ছোটবেলা থেকে। বাবার কাছে তিনি আবৃত্তিও শেখেন। ছোটবেলায় স্কুলসহ পাড়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি আবৃত্তি করেছেন।
লেখাপড়ার হাতেখড়ি বাবার কাছে, তারপর টাঙ্গাইল টাউন প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে পরে ভর্তি হন বিন্দুবাসিনী গার্লস হাই স্কুলে। সেই স্কুল থেকেই ১৯৬১ সালে এসএসসি পাস করে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন কুমুদিনী মহিলা কলেজে এবং ১৯৬৩ সালে আইএ পাস করেন। করটিয়া সাদত কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে বিএ পাস করে ১৯৬৮ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.এড পাস করেন। ১৯৬৯ সাল থেকে জামালপুর সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তী সময় তিনি প্রাইভেটে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পরে তিনি টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী সরকারি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন এবং সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
কুমুদিনী কলেজে পড়াকালীন সময় শেফালী দাসের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সে সময়কার সকল মিটিং মিছিল সমাবেশে হোস্টেলের মেয়েদেরকে সংগঠিত করে নিয়ে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিলেন শেফালী দাস। টাঙ্গাইলের শিক্ষা আন্দোলনে শেষ সময়কার ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলেন ফাইজুল রহমান মিঠু, বরুণ রায়, নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল খান মাহবুব, আতিকুর রহমান সালু প্রমুখ। বিএ ক্লাসে পড়াকালীন সময়ে করোটিয়ার সাদত কলেজে পুরো ক্লাসে তিনি সহমাত্র তিনজন মেয়ে ফরিদা ও মঞ্জু নিয়োগী। এদের সাথে নিয়ে তিনি তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সকল কার্যক্রমের যুক্ত হতে শুরু করেন। তাঁর সাথে সাথে শেফালীর ছোট দুই ভাইও রাজ ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়ে। সেই সময় বিভিন্ন সমাবেশ সম্মেলনে যোগদান করার জন্য প্রতিবেশীদের দ্বারা তিনি প্রচুর নিন্দিত হয়েছেন, এছাড়াও এম. এস. এফ এর ছেলেরা হুমকি দিতো নানা সময়।
টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট নাট্যকার সুবিনয় দাসের লেখা তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রূপাত্মক নাটকে তিনি কণ্ঠ অভিনয় করেন যেটি অডিও রেকর্ড করা হয় এবং সেই রেকর্ডকৃত নাটকটি টাঙ্গাইলের প্রধান প্রধান মোড়ে মাইকে বাজানো হতো।
১৯৭১ সালের সাথী মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে তৎকালীন জামালপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শেফালী দাস কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকে ১০ই মার্চ টাঙ্গাইল চলে আসেন। স্বাধীনতার ঘোষণা হলে শেফালির বাবা একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। এরপরে যখন শুরু হয় পাকবাহিনীর অত্যাচার তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার। প্রথমে তারা গ্রামের বাড়ি ঘারিন্দা যান, সেখানে গ্রামের সা¤প্রদায়িক ও লুটেরা প্রকৃতির লোকেরা হিন্দু পরিবারগুলোকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিতে থাকে। জুন মাসের প্রথম দিকে তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিলে ছোট ভাইকে নিয়ে তিনি জামালপুরে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। পথিমধ্যে মধুপুরে আর্মি গাড়ি থামিয়ে সবাইকে নামতে বলে, গাড়ির ড্রাইভার তার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তিনি শেফালীকে অনুরোধ করেন নাম জিজ্ঞেস করলে যে কোন মুসলিম মেয়ের নাম বলবার জন্য। আর্মি গাড়িতে উঠলে তিনি মাথায় বড় ঘোমটা টেনে বসেন, ড্রাইভার পাক আর্মিদের বোঝান যে সে ভাইয়ের সাথে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। আর্মিরা নেমে গেলে সেদিন তিনি বেঁচে যান। একসময় তিনি জামালপুর এ যান মার্চ মাসের বেতন তুলতে কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা খুরশেদা বেগম তাঁকে বেতন দিতে অসমতি জানান। এমনকি জামালপুরের তৎকালীন এসডিও আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া তাঁকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাবার পরামর্শ দেন এবং শেফালীকে শেরপুর বর্ডার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসার প্রস্তাব রাখেন কিন্তু তিনি সে প্রস্তাবে অসম্মতি জানান এবং ফিরে আসেন স্কুলের হোস্টেলে। সে স্কুলের তদারকিতেও ছিল রাজাকারদের প্রধান ভ‚মিকা। শেফালীকে বাঁচানোর জন্য হোস্টেলের নাইট গার্ড তাকে পরামর্শ দেন জোরে জোরে নামাজ পড়তে যাতে রাজাকাররা বুঝতে পারে তিনি মুসলিম সেই সাথে নাইটগার্ড তাঁকে পাহারা দিতেন। স্কুলের দপ্তরি ও নাইট গার্ডের সহযোগিতায় দুই ভাইবোন পরের দিন ষাড়মারা হয়ে শেরপুর বর্ডার অতিক্রম করে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ বাজারে পৌঁছান। পথে বি.এস.এফকে পাক আর্মি ভাবে দৌড় দিলে বি.এস.এফ সদস্যরা তাঁদের ধরে থানায় নিয়ে আসেন। থানার আওয়ামী লীগ এমপি ও নেতারা তাঁর পরিচয় জানতে পেরে তাকে সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনেন। সেখানে কমরেড নারায়ন বিশ্বাসের সাথে তাঁদের দেখা হয়।
এদিকে বাড়িতে শেফালির পিতা মাতা রাজাকারদের আক্রমণের শিকার হন এবং কাকতালীয়ভাবে বেঁচে যান। এরপরে দেশে থাকা আর নিরাপদ নয় ভেবে তাঁরাও কলকাতায় চলে যান। শেফালী দাস সেকজানে নারায়ন বিশ্বাসের সাথে একদিন সেলিনা বানুর বাসায় যান এবং সেখান থেকে সেলিনা বানুর মাধ্যমে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নানের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাঁর অতীতের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানান। আব্দুল মান্নান শেফালীকে একটি স্লিপ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অডিশনের জন্য পাঠান। সেখানে তিনি সংবাদ পাঠের পর সংবাদ পর্যালোচনা পাঠ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। এছাড়াও তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিপ্লবী কবিতা পাঠ করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করবার জন্য ¯েøাগান দিতেন। তিনি সেলিনা বানুর সঙ্গে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে গিয়ে শরণার্থীদের সহযোগিতা করেছেন। স্বাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের পর টাঙ্গাইলে এসে দেখেন তাঁদের বাড়ি রাজাকারেরা দখল করে নিয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সহযোগিতায় তাঁরা বাড়ি ফিরে পান। ১৯৮৬ সালে মতিলাল সরকারের সাথে তার বিয়ে হয়।
শেফালী দাসের সংগ্রামী জীবনকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন কমরেড নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাস।বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার ফলে নারায়ন বিশ্বাস, পার্টির অনেক গোপন মিটিং করেছেন তার বাসায় আর, সেসব মিটিংয়ে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, আজিজুল ইসলাম খান, আলতাফ হোসেন, মন্মথ দে,সাইদুর রহমান, কবির চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ নেতারা নিয়মিত আসতেন। এছাড়াও ছাত্র রাজনীতি করার সময় মতিয়া চৌধুরী, স্নিগ্ধা চৌধুরী ও সৈয়দ আব্দুল মতিন এর সংস্পর্শে এসেছেন তিনি। এবং তাদের আলোচ্যই বিষয়বস্তু তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে সংগ্রামী জীবনে পদার্পণ করার জন্য।
মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে কাজ করায় ১১জন বীর নারীকে সম্মাননা প্রদান করেছে ৭১ ফাউন্ডেশন। স্বাধীনতার দিবসের ৪৭তম বার্ষিকী উদযাপনে উপলক্ষে ৩১ র্মাচ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির মিলনায়তনে বীর নারীদেরকে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। এই ১১ বীর নারী হলেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম (মরণোত্তর), জওশন আরা রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেফালী দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইলা দাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. লায়লা পারভীন বানু, সৈয়দা সালমা হক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মজুমদার দীপা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাঈদা কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. এসএম আনোয়ারা বেগম আনু, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডালিয়া নওশিন।