শারমীন শরীফ : শিরীন আখতার ১৯৫৪ সালের ১২ই এপ্রিল ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার হরিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রফিকুল আনোয়ার মজুমদার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। মা রেহানা আখতার গৃহ কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড ও সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। চার বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে শিরীন প্রথম। শিরীন আখতাঁর এর পরিবারের প্রতিটি সদস্যই রাজনৈতিকভাবে ভীষণ সচেতন ছিলেন।
১৯৬১ সালে পি এন্ড টি স্কুলে তিনি প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন। সেই স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করে সেন্ট্রাল গভমেন্ট গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি পাস করেন। এইচএসসি পাশ করেন ১৯৭২ সালে বদরুন্নেছা কলেজ থেকে। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে সম্মান ১৯৭৯ সালে এবং এম এস এস পাস করেন ১৯৮০ সালে।
স্কুল জীবন থেকে শুরু হয় তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতা। ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ এর আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কলেজে ভর্তি হবার পর শিক্ষা দিবস উপলক্ষে ছাত্রলীগের পক্ষে তিনি কলেজের বটতলায় প্রথম বক্তব্য রাখেন। তিনি ১৯৭০ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত বদরুন্নেসা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
৪২, বলাকা ভবনে তাকে নিয়মিত যেতে হতো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের জন্য, প্রশিক্ষক ছিলেন ছাত্রনেতা হাসানুল হক ইনু। কেন বাংলার স্বাধীনতাঁর প্রয়োজন, ছয় দফার পর কেন এক দফা চান, নতুন বাংলাদেশ কেমন হবে ইত্যাদি বিষয় আলোচনা এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হতো সেখানে। পাশাপাশি অস্ত্র প্রশিক্ষণের শুরু হয়। স্বাধীনতাঁর প্রস্তুতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ছাত্রলীগের পক্ষে স্বাধীনতাঁর যে প্রস্তুতি চলছে আমরা তাঁর সাথে যুক্ত ছিলাম। ফলে ’৭০ নির্বাচন, সংসদ না বস্, বটতলায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিল থেকে আ. স. ম রবের স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, পরের দিন ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান থেকে স্বাধীনতাঁর ইশতেহার পাঠানো, ‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত নির্ধারণ ইত্যাদি আন্দোলনক্রমের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। অসহযোগ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রীদের ট্রেনিং শুরু হলে আমরা তাতে অংশ নিয়েছি। সেসময় পাড়ায় মহল্লায় প্রস্তুতি স্বরূপ সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আজিমপুর স্কুলের মাঠে সংগ্রাম পরিষদ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। সেখানে ধীরে ধীরে প্রচুর মা বোন অংশগ্রহণ করেন। ২৩ মার্চ পতাকা দিবস ঘোষিত হয়। পাকিস্তানের সকল পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। ২৫ শে মার্চ দুপুরেও আমরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছি।’
১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ রাতে ক্র্যাক ডাউন শুরু হয়। পাড়ার ছেলেরা রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া শুরু করে। প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে কেটে যায় সারাটি রাত, চারিদিকে আতঙ্ক। অসংখ্য অসংখ্য মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলা হয় সেই রাতে। বস্তিতে আগুন জ্বলছিল দাউ দাউ করে। ২৭ শে মার্চ কারফিউ শিথিল হলে সিদ্ধান্ত হয় বাসা ছেড়ে দিয়ে পরিবারের সবাই নদীর ওপারে জিনজিরা চলে যাবে। ওখানে দুদিন থাকার পর ছোট ভাই অপুর অসুস্থতাঁর কারণে ফিরে আসেন সবাই ঢাকার আজিমপুরের বাসায়। এ সময় একজন বাবাকে খবর দেয় যে লালবাগ থানায় বিভিন্ন সংগ্রাম পরিষদে তালিকা আছে এবং তাতে শিরীনের নাম আছে। বিপদজনক পরিস্থিতি আন্দাজ করে শিরীন বাড়ি ছেড়ে চলে যান কলাতিয়ায়। সেখানে খবর পান জিনজিরায় তারা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল সে বাড়ি পাক বাহিনীর জ্বালিয়ে দিয়েছে তাদের আশ্রয় দেবার অপরাধে। তিনি আবার ফিরে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি রোজি, লিনু, সানু, মলিকে নিয়ে গোপনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লিফলেট, বুলেটিন প্রকাশ করেন। গোপনে লুকিয়ে খুব ভোরে আর সন্ধ্যা রাতে বুলেটিন বিলি করতে বের হতেন তাঁরা। বেশ কিছুদিন পর তাদের কলোনির পাকিস্তানপন্থীরা উৎপাত শুরু করলে তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্ত অনুসারে সেসব দালালদের বাড়িতে বেনামে হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠান। যার ফলে তাদের উৎপাত কিছুটা বন্ধ হয়। শিরীন এবং তাঁর সঙ্গীরা যুদ্ধের মাঝখানে ঈদের আনন্দ থেকে বিরত থাকবার জন্য বুলেটিন এবং পোস্টারের এর মাধ্যমে সকলকে আহ্বান জানান। এতে কাজ হয়, ঈদে নতুন জামা কাপড় পড়ে কেউ রাস্তায় বের হয়নি সেদিন। এরপরে শিরীন ও তাঁর পুরো দলটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ কাপড় ওষুধ জোগাড়ের জন্য তৎপর হয়েছিলেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের জন্ম লগ্ন থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এই দল গড়ে তোলার শুরুতেই অনেককে অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, দিতে হয়েছে প্রাণ। অনেককে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথমে মমতাজ বেগম, আফরোজা হক রিনা, মিঠুন বানু, আমেনা সুলতানা বকুলসহ আরো অনেকে আত্মগোপন করেছিলেন কিম্বা গ্রেফতাঁর হয়েছিলেন। পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিরীন রংপুরে আত্মগোপন করেছিলেন।
১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে ‘জাসদ’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন হলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। তিনি অস্ত্র রাখার মিথ্যা অভিযোগে রংপুর শহর থেকে গ্রেফতাঁর হন। তাঁর সাথে গ্রেফতার হন মুস্তাফিজুর রহমান বকুল। শিরীনকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয় রাত ১১ টায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর দেহ তল্লাশ এর নামে তাঁর শাড়ি খুলে ফেলা হয় এবং কোমরের দড়ি বেঁধে দেয়া হয়। সিপাহীরা অশ্লীলভাবে সারারাত ধরে তাঁর শারীরিক বর্ণনা দিচ্ছিল, শুনে শুনে একটি রাত আতঙ্কে কেটে গিয়েছিল। সকালে শুরু হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদ। তাঁর মুখ থেকে কিছু বের করতে না পেরে সিপাহীরা তাঁর হাত উপর দিকে বেঁধে কাধ থেকে পা পর্যন্ত মোটা লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করেছিল। তাঁকে ভয় দেখানো হয়েছিল যে আঙ্গুলে সুচ ফোটানো হবে, গরম ডিম যোনিপথে প্রবেশ করানো হবে যদি সে কথা না বলে। সেদিন তিনি ইলা মিত্র, প্রীতিলতাঁর অসীম সাহসিকতাঁর কথা মনে করে নিজেকে শক্ত করেছিলেন। এর একদিন পরে তাকে রংপুর কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে তখন আ. স. ম আব্দুল রব ছিলেন। কিছুদিন জেলে থাকবার পর একদিন তাঁকে জেলারের রুমে ডাকা হয়, নেতাকর্মীরা কে কোথায় আছে জানবার জন্য আর্মির লোকেরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কোন তথ্য তাঁর কাছ থেকে বের করতে না পেরে তাঁর দুহাতে বৈদ্যুতিক তাঁর বেঁধে দেয়া হয় এবং চোখে পট্টি বাধা হয়। পরপর দুবার তাকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রায় ১৫ দিন মাথা তুলতে পারেননি। এত অত্যাচারের পরেও তিনি মুখ খোলেননি এবং কোন তথ্য দেননি। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি থাকেন তিনি।
১৯৭৮ সালে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালের ৫ই মে তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একসময়ের সহ-সভাপতি মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৭৯ সালে ডাকসু ছাত্রী মিলনায়তন সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং ১৯৮৩ থেকে ৮৭ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল তুমুল ঝড় যা, ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে এসে থামে। সে সময় অবৈধ ক্ষমতা দখলদারি এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তিনি এই পরিষদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য ১৯৮৩ সালের ২৬ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বাসায় তৎকালীন ছাত্র নেত্রীবৃন্দ কর্তৃক তৈরি হয়। পুরো আন্দোলনের সময় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য তিন বছরের শীর্ষ পুত্রকে রেখে তিনি মাসের পর মাস পালিয়ে থেকেছেন। বাড়িতে পুলিশের হামলা এবং আনাগোনা ছিল অহরহ। শিরীন আখতার ১৯৮৮ সালে জাতীয় শ্রমিক জোট বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন এবং ১৯৯১ সালের কার্যকরী সভাপতি এর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সে বছরে তিনি কর্মক্ষেত্রে নারীর সমাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, ‘কর্মজীবী নারী’ নামক সংগঠন করে তোলেন।
১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন হক তা ও ধর্ষণকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সম্মিলিত নারী সমাজের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন এবং সে বছর বেইজিং বিশ্ব নারী সম্মেলনে যোগদান করেন।
১৯৬৬ সালে তিনি জেনে ভাই আই এল ও সম্মেলনে বাংলাদেশের শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে সরকারি ডেলিকেশনে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একজন “সংসদ সদস্য” হিসাবে নির্বাচিত হন।