শারমীন শরীফ: ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের বছর। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেবার দাবিতে ছাত্র সমাজসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসমূহ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সে সময়টাতে লায়লা সামাদ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তিনি ও সহকর্মী কমরেড নিবেদিতা নাগ নিজ হাতে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের আগে এ দেশে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি করে উঠেছিল এবংঅবিভক্ত সমগ্র ভারতবর্ষে এই সংগঠন বেশ প্রসার লাভ করেছিল। লায়লা সামাদ একজন দক্ষ সক্রিয় সংগঠক হিসেবে এই সংগঠনে কাজ করতেন। ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবার অফুরান প্রাণশক্তিধারী এই সংগ্রামী নারী তার জীবদ্দশায় সংগঠিত সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে সক্রিয় থেকে সংগ্রামী জীবনকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছেন।
১৯২৮ সালের ৩ সালে এপ্রিল লায়লা সামাদ কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবার এ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খান বাহাদুর আমিনুল হক তত্কালীন অবিভক্ত বাংলায় এসিস্ট্যান্ট কমিশনার (সেলস ট্যাক্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দিনাজপুর জেলার মির্জা বংশের ছেলে। চাকরির সুবাদে কলকাতার জলপাইগুড়িতে দীর্ঘদিন কাটান। তিনি সাহিত্যানুরাগী ছিলেন এবং দুটি উপন্যাসও রচনা করেছেন, মা তাহমিনা হক শেরশাহের প্রধান সেনাপতি ড্যানিয়েল খানের বংশধর। তিনিও সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা ছিলেন। ‘সওগাত’-এ তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো এবং সে আমলে তিনি অর্গান বাজিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন এবং এস্রাজ রাজাতেন। ফলে বাড়িতে সার্বক্ষণিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার একটি পরিবেশ ছিল । মা বাবার চার সন্তানের মধ্যে লায়লা তৃতীয়। শৈশব থেকেই তিনি নাচ-গান, নাটক, সেলাই, আবৃত্তি, অভিনয়, লেখালেখি ইত্যাদি শিল্পকলায় পারদর্শী ছিলেন। পারিবারিক উত্তরাধিকার গুনে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ ছিল স্বভাবজাত।
জলপাইগুড়ি মিশনারি স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় তারপর কলকাতার ডাইসন স্কুলে। ঢাকার নারী শিক্ষা মন্দির স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করে কলকাতার সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। আই এ ভর্তি হন কলকাতার আশুতোষ কলেজে এরপরে সেখান থেকে আবার লেডিস ব্র?্যাবন কলেজে চলে আসেন এবং ১৯৪৪ সালে আইএ পাস করেন।
পরবর্তী সময়ে বিএ পাস করে ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় দুই বছর মেয়াদী পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স সম্পন্ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ‘বংশীধর- জালাল স্বর্ণপদক’ লাভ করেন।
স্কুলে থাকাকালীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও গান পরিবেশন করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে কথা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতিসেবী, নাট্যকা,র সমাজসেবী, সুগৃহিনী এবং রন্ধন বিদ্যায় পারদর্শী।
সংবেদনশীল মনের তাগিদে রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর সমাজসেবার কাজ । ১৯৩৯ সাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে, বাবা বদলি হয়ে কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি চলে আসেন।এখানে এসে শোষণ-বঞ্চনা ও সমাজের অসম শ্রেণীবিন্যাস তাঁকে আহত করে। সমাজের এই অন্যায় বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে তার সংগ্রামী চেতনা। সে সময় তিনি সরাসরি প্রবেশ করেন রাজনৈতিক জীবনে। কলকাতা থাকাকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড মোজাফফর আহমেদের সাথে পরিচিত হন। জলপাইগুড়ি এসে রাজনৈতিক গুরু হিসেবে পান কমরেড মোখলেসুর রহমানকে, যিনি তাঁর গৃহ শিক্ষক ছিলেন। আরো একজন তার জীবনকে তখন আলোকিত করেছিল, তিনি জলপাইগুড়ির তুখোর ছাত্র নেতা এবং সম্পর্কে চাচাতো ভাই মীর্জা সামাদ। পরবর্তীকালে তাকে সার্বক্ষণিক সহযোদ্ধা ও স্বামী হিসেবে পেয়েছিলেন। পারিবারিক অসম্মতি থাকা সত্তে¡ও রাজনৈতিক আদর্শে মিল থাকার কারণে ১৯৪৬ সালের ১৯শে মে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
সাধারণ কর্মীর মত তিনি জলপাইগুড়ির মহল্লায় মহল্লায় কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করতেন। সমাজতন্ত্রের উপরে প্রকাশিত বই ‘স্বাধীনতা’ ও ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকা মহল্লার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করেন।
পার্টির তহবিলে অধিক অর্থ সংগ্রহের কারণে তিনি পার্টি কর্তৃক পুরস্কৃত হন, এছাড়াও পার্টি কর্তৃক পরিচালিত দুটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রও তিনি পরিচালনা করতেন।
দেশবিভাগের পর ১৯৪৮ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম লগ্নে স্বামী মির্জা সামাদের উপর পার্টি কর্তৃক জুয়ারসের চা বাগান ও রেলওয়ে শ্রমিক ইউনিয়নে কাজ করার দায?িত্ব অর্পণ করা হয়। সেই সাথে সৈয়দপুর চট্টগ্রাম দিনাজপুরে গোপনে চলতে থাকে তাদের পার্টির কাজ। স্বামীর সাথে তিনিও সার্বক্ষণিক পার্টির কাজে যুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসে স্বামীর সাথে তিনিও যোগ দেন। এ সময় স্বামীর সাথে তার নামেও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে শুরু হয় তাঁর আত্মগোপনরত জীবন। কমরেড হেনা দাস দিনাজপুরে তাদের গোপন আস্তানা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে বেশ কিছুদিন থাকার পরে স্বাভাবিক জীবন বিঘ্নিত হওয়ায় এবং অর্থনৈতিক সংকটের ফলে তিনি কলকাতায় বড় বোনের কাছে চলে যান। রাজনৈতিক আদর্শ তাকে জীবনের অনেক কিছু উপেক্ষা ও ত্যাগ করতে শিখিয়েছিল।
১৯৫২ সালে তিনি পুনরায় ঢাকার পুরানা পল্টনে তার নিজ বাসভবনে ফিরে আসেন এবং আবারো প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে সকল সভা-মিছিলসহ অন্যান্য দাপ্তরিক কাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এদেশের নারী প্রগতির জন্য নিবেদিত প্রাণ ‘জুঁইফুল রায়ে’র সংস্পর্শে এসে তিনি মহিলাদের সংগঠিত করবার জন্য গোপনে কাজ শুরু করেন। নারী আন্দোলন গণতন্ত্রের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে এদেশে যে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে উঠেছিল লায়লা সামাদ সেই সংগঠনের একজন দক্ষ সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রাক্কালে তিনি ফ্রন্ট গঠনের সহায়তা করার জন্য সভা সমিতিসহ অন্যান্য কর্মকান্ডের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। মাওলানা ভাসানী তাকে দিনাজপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে যুক্তফ্রন্টের মহিলা সংসদ প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেন কিন্তু ভোটের তালিকায় তাঁর নাম না থাকায় নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি একনিষ্ঠ ভাবে কাজ করেন। তত্কালীন মুসলিম লীগ সরকার ৯২ ‘ক’ ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয় এবং রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ ও কর্মীদের উপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সেই তালিকায় তাঁর নামও ছিল। কিন্তু আই বি বিভাগের এক সুহৃদের মাধ্যমে সেটা জানতে পেরে তিনি শিশু কন্যা সহ কলকাতায় চলে যান। কলকাতায় অবসর সময়ে তিনি মৃন্ময় পাত্রে নকশার কাজ শেখেন, হিন্দি ভাষা শেখেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় পোস্ট গ্রাজুয়েটে প্রথম স্থান অধিকার করায় ‘পদ্মজা নাইডু’র হাত থেকে স্বর্ণ পদক লাভ করেন; যা এদেশের নারী সমাজের জন্য ছিল বিরল সম্মান। স্বর্ণপদক লাভের পরে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে না দেয়ার ফলে সেদিনই তিনি দেশে ফেরার পথে রোওয়ানা হন এবং সীমান্ত অতিক্রম করার সময় তার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই পাসপোর্ট না থাকার কারণে তিনি বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েও স্টকহোম যেতে পারেননি।
৬০ দশকের প্রারাম্ভে পুরানা পল্টনস্থ একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পাশাপাশি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার ‘মহিলা পাতা’র সম্পাদনা কাজে যুক্ত হন।পরবর্তী সময়ে স্টাফ রিপোর্টারের দায়িত্ব পালন করেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি সাহিত্যচর্চাতে মনোযোগ দিয়েছিলেন ‘আপনার শিশুকে জানুন’ বইটি তার রচিত প্রথম বই। ‘অনন্যা’ নামে মহিলাদের পত্রিকাটি তিনি নিজ উদ্যোগেই বের করেছিলেন। তিনি ‘চিত্রিতা’ নামে বিনোদনমূলক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন যেটিতে কবি শামসুর রহমানের বিখ্যাত কবিতা সফেদ পাঞ্জাবি ছাপা হয়। সাহিত্য অনুরাগী সহযোগীদের নিয়ে ‘কথাকলি’ নামে একটি প্রেস চালু করেন যদিও সেটা পরে বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন দিনগুলোতে দেশের প্রতি একনিষ্ঠ ভালোবাসা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোপন তহবিল গঠন করেন। নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। রাজাকারের দৃষ্টি এড়ায়নি তার উপর থেকে, বুদ্ধিজীবী হত্যার যে সুদীর্ঘ তালিকা ছিল সেখানেও তাঁর নাম ছিল।
সাহিত্য চর্চা তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। ছোট গল্পের জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পান। এছাড়া ‘বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পদক’, ‘নুরুন্নাহার বিদ্যা বিনোদনী স্বর্ণপদক’, ‘হাসান হাফিজুর রহমান স্বর্ণপদক’’ এবং ‘সুফি মোতাহার হোসেন পুরস্কার’ লাভ করেন। এছাড়াও লেখিকা হিসেবে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন।
লায়লা সামাদের কয়েকটি গল্প ও অন্যান্য বিষয়ের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দুঃস্বপ্নের অন্ধকার’, ‘কুয়াশার নদী’, ‘অরণ্যে নক্ষত্রের আলো’, ‘বিচিত্রা’, ‘কলরোল’, ‘আপনার শিশুকে জানুন’, ‘স্বাক্ষর’, ‘শ্রী শ্রী বিড়ালোদ ওমদাস’ ও ‘৭১’র কড়চা’। তিনি কিছু প্রবন্ধও রচনা করেন।
লায়লা সামাদের ব্যক্তিসত্তা ও মানবতা বোধকে সমাজের কল্যাণকর কাজের সাথে সম্পৃক্ত করে তিনি তাঁর জীবনকে বিভিন্ন ধারায় বিকশিত করছিলেন। দেশের ক্ষুধিত, নির্যাতিত মানুষের প্রতি, সেইসাথে অবহেলিত, মর্যাদাহীন নারী সমাজের জন্য তাঁর কর্মকে প্রসারিত করেছেন তিনি। গরিব মেধাবী ছাত্রদের পড়াশোনার খরচ বহন করতেন অকাতরে। তিনি আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন না বলে পরিবার, প্রতিবেশী ও পরিজনদের প্রতি খেয়াল ছিল পুরোপুরি। শত কাজের মধ্যেও তিনি অসুস্থ মা এবং পক্ষাঘাতগ্রস্থ ভাইয়ের সেবা যত্নের ত্রুটি করেন নি।
লায়লা সামাদের কর্মবহুল বিচিত্র জীবনের সাফল্যের পেছনে স্বামী মির্জা সামাদের অবদান অনস্বীকার্য। এক কন্যা সন্তান, স্বামী ও পরিজন রেখে তিনি ১৯৮৯ সালের ৯ই আগস্ট ভোর চারটায় হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি মৃত্যুহীন প্রাণ, তাঁর কর্ম সাধনা, নিষ্ঠ, ও সংগ্রাম নারী সমাজকে আজীবন প্রেরণা যোগাবে।