শারমীন শরীফ : ১৯৪৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার ধর্মদহ গ্রামে প্রগতিশীল পরিবারে জন্ম ডা. লায়লা পারভীন বানুর। মা আনোয়ারা রহমান এবং বাবা আজিজুর রহমান। বর্তমানে সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও এনাটমি বিভাগের প্রধান।
ডাক্তার লায়লা পারভিন বানু ১৯৫৪ সালে বরিশাল ক্যাথলিক মিশনারি স্কুলে পড়ালেখা শুরু করেন। কিন্তু পিতার চাকরির কারণে ১৯৬০ সালে তাকে বরিশাল ছেড়ে রাজশাহী চলে যেতে হয়। ১৯৬৫ সালে রাজশাহীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। বাবা সরকারি চাকরি করায় ছাত্র জীবনে সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত না থাকলেও বরাবরই ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থক ছিলেন।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস। ডা. বানু তখন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবা আজিজুর রহমান ছিলেন পুলিশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিদর্শক। ২৬ মার্চ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও রাজশাহী শহর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। এর পরদিনই এক ভয়াবহ করুণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ডা. বানু।
১৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টা, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার রাজশাহী অফিসের সামনে এসে থামে হানাদার বাহিনীর ট্রাক। ট্রাক থেকে নেমে আসে নরপিশাচরা। একে একে পাঁচজন অফিসারকে টেনেহিঁচড়ে অফিসের সামনেই লাইন করে দাঁড় করায়। ওই পাঁচজনের মধ্যে তাঁর বাবাও ছিলেন। নিমেষেই গর্জন করে উঠল মেশিনগানগুলো। লুটিয়ে পড়লেন সবাই। ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন তাঁর বাবা ও গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক।
এই করুণ কাহিনীর কথা স্মরণ করে ডা. বানু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাবার লাশ পাশে রেখে আহতদের চিকিৎসা আমাকেই করতে হয়েছে। কিন্তু লাশ দুটি ফেলে রাখা হলো দুই দিন। দাফনের উদ্যোগ নিল না কেউ। অফিসের ভেতরে বাগানে এনে লাশ দুটি দাফন করার অনুরোধ জানিয়ে ঘুরতে লাগলাম সবার কাছে। কেউ রাজি হলো না। সে মুহূর্তে নিজের প্রাণ বাঁচানোটাই সবার কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছিল। বাবার লাশ দাফন না হওয়া, চোখের সামনে পচে যেতে দেখা কী যে অসহনীয় এক অভিজ্ঞতা ছিল তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানেই পড়ে ছিল লাশ দুটি। সন্ধ্যার পর লাশভর্তি ট্রাক নিয়ে উপস্থিত হলো পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু লাশ দুটি ট্রাকে না উঠিয়ে রাস্তার পাশেই অল্প জায়গায় গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে মাটিচাপা দিল। তাঁদের দাফনও হলো না। আমার চোখ ফেটে পানি এল।’’
১৬ এপ্রিল কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিলে রাজশাহীর সাগরপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে চলে যান লায়লা পারভীন বানু। ১১ মে পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। এরপর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার ধর্মদহ গ্রামে চলে যান তাঁরা। গ্রামটি ছিল সীমান্তের কাছে মাথাভাঙা নদীর পাড়ে। এ সময় প্রতিদিন শত শত শরণার্থী এই সীমান্ত দিয়ে ভারতে পার হয়ে যেত। ডা. বানু এই শরণার্থীদের চিকিৎসা সেবা, খাবার ও পানির ব্যবস্থা করতেন।
লায়লা পারভিন ভারতের গ্রামের বাড়ি ধর্মদাহ গ্রাম ছিল বর্ডার এর কাছে মাথাভাঙ্গা নদীর পাড়ে। এই নদী হচ্ছে বর্ডারের সীমানা। এই সময় মে মাসে এই বর্ডার দিয়ে প্রতিদিন শত শত শরণার্থী ভারতে পার হয়ে যেত। লায়লা বানু এই সকল শরণার্থীদের বিভিন্ন রকম চিকিৎসা সেবা খাবারের ব্যবস্থা ও পানির ব্যবস্থা করতেন। এই সময় তিনি প্রতিদিন অসংখ্য পাকআর্মী দ্বারা ধর্ষিতা নারীর চিকিৎসা করেছেন হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছেন তাই দিয়ে।
এ সময় থেকে প্রতিদিনই পাকিস্তানি সেনারা গ্রামে আসতে শুরু করে। শুরু হয় যুদ্ধ। নদীর এপারে পাকিস্তানি সেনা আর ওপারে মুক্তিসেনার মধ্যে দিনের বেলা চলতে থাকে গুলিবিনিময়। হঠাৎ করে পাক সেনারা নির্দেশ দেয় ২৩ শে মে এর মধ্যে বর্ডারের তিন মাইলের মধ্যে যত গ্রাম আছে সেগুলো থেকে জনসাধারণকে আরও ভেতরে চলে যাবার। কিন্তু গ্রামবাসী সে নির্দেশ উপেক্ষা করে। ফলশ্রুতিতে ২৪শে মে পাক সেনারা সমস্ত গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁর দাদার লাশ পাওয়া যায় গাছে ঝুলন্ত অবস্থায়। লায়লা পারভিন বানু তখন ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে ভারতের করিমপুরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি এক খ্রিস্টান কবিরাজ পরিবারের সহযোগিতা পান এবং ওই পরিবারের ছেলে দিপু কবিরাজের মাধ্যমে মুজিবনগর সরকারের সন্ধান পান। তখন তিনি কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অফিস এ গিয়ে পিতার বন্ধু কামরুজ্জামান হেনার সাথে দেখা করেন। যুদ্ধে পিতা এবং দাদাকে হারানোর স্মৃতির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে বদলা নিতে যুদ্ধে যোগদান করার প্রচন্ড ইচ্ছা প্রকাশ করলে কামরুজ্জামান হেনা জেনারেল ওসমানের সাথে দেখা করতে বলেন। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও জেনারেল ওসমানীর সাথে তিনি দেখা করতে পারেননি। জুনের প্রথম দিকে কামরুজ্জামান হেনা লায়লা পারভিন বানুকে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী পরিচালিত ‘গোবরা ক্যাম্পে’ পাঠিয়ে দেন। ক্যাম্পে তখনো মেয়েদের সরাসরি অস্ত্র প্রশিক্ষণের অনুমতি ছিল না বলে শুধুমাত্র নার্সিং আত্মরক্ষামূলক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ফার্স্ট এইড প্রশিক্ষণ শুরু হয়। লায়লা বানু স্বযতেœ সব দায়িত্ব বুঝে নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে কাজ শুরু করেন।
দেশের স্বাধীন হবার পরে তিনি আবার রাজশাহী সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি পাশ করে বের হন এবং ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর ১৯৭৫-৭৬ এই দুই বছর রাজশাহী মেডিকেল কলেজে লেকচারার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে এম.ফিল করার জন্য পি জি হাসপাতালে আসেন। তখন তিনি দুদিনের জন্য সাভার গনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বেড়াতে গেলে সেখানকার পরিবেশ দেখে বিশেষ করে “গ্রামে চলো-গ্রাম গড়ো”, এই ¯েøাগানে মুগ্ধ হয়ে গ্রামে-গঞ্জে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে সরকারি চাকরি ছেড়ে ১৯৭৬ সালে গণস্বাস্থ্যেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে তিনি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেন। একই বছরে সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের সাসেক্স ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক নারী বিষয়ক একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থা ও অবস্থান তুলে ধরেন। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে তিনি গণস্বাস্থ্য ছেড়ে দেন এবং সে বছর ২৮ শে এপ্রিল ডঃ শফিকুল আলম কে বিয়ে করেন।
স্বামীর চাকরির কারণে ১৯৮০ সালে ডক্টর লায়লা লিবিয়া চলে যান এবং ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত লিবিয়াতে অবস্থান করেন। এই সময় তিনি চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। লিবিয়াতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ওমেন্স কংগ্রেসে সব দেশের প্রতিনিধি থাকলেও সেখানে বাংলাদেশের কোন প্রতিনিধি ছিল না। ডক্টর লায়লা উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলকে যোগদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
যে প্রত্যাশা নিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ডা. লায়লা পারভীন বানু, তার কতোটা পূরণ হয়েছে – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা স্বাধীন দেশ, একটা ভ‚খণ্ড, একটা পতাকা পেয়েছি, কিন্তু ৭ মার্চের ভাষণে জাতির জনক যে বলেছিলেন যে, এটা আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমরা দ্বিতীয়টা পেয়েছি? অর্থাৎ স্বাধীনতা পেয়েছি কিন্তু মুক্তি এখনও আমরা পাইনি। তাই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছি আমরা।’’