শারমীন শরীফ : মুক্তিযোদ্ধা মুকুল মজুমদারের জন্ম চাঁদপুরে। বাবা অনিল বরণ মজুমদার ওষুধের ব্যবসা করতেন। মা উষা মজুমদার শিক্ষকতা করতেন চাঁদপুর মাতৃপীঠ হাইস্কুলে। মতলবগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি মেট্রিক পাস করেন। দীপার মা এই স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি হোস্টেল সুপারের দায়িত্ব পালন করতেন বলে দীপা বাবা মার সাথে স্কুলের কোয়ার্টারে থাকতেন। মতলবগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি আইএ এবং ১৯৬৯ সালে তিনি বিএ পাস করেন। স্কুল জীবনে তার মধ্যে রাজনীতির যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল তাই যেন পুষ্প পল্লবী বিকশিত হয়েছিল কলেজ জীবনে।

কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় ছাত্র ইউনিয়নের হয়ে, কখনো রাজপথে আইয়ুব বিরোধী মিছিল-আন্দোলনে আবার কখনো বা ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে তাঁর ভ‚মিকা ছিল কর্মমুখর। রাজনীতি চর্চার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল।
ইতিমধ্যে উত্তাল ঊনসত্তরের গণআন্দোলন শুরু হয়। একাত্তরের মার্চে মুকুল মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় আসেন। ১৯৭১ এর সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য বাবার সাথে ঢাকায় আসেন তরুণী দীপা।

২৭ শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তার বাবা পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। দীপার বাবা এরপরে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। একাত্তরের ৮ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রথম মতলবে আসে। ভয়ে আতঙ্কে আপনজন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ পাশের গ্রাম সিপাহীকান্দিতে ছোট ভাইয়ের বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেও নিরাপত্তার অভাব দেখা দিলে ১৮ এপ্রিল তারা বাইশজন আগরতলা সীমান্ত দিয়ে বক্সনগর যাওয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে নারীই ছিলেন ১২ জন। দীপার পরিবার নদীর ওপারে সিপাহীকান্দি গ্রামে বড় ভাইয়ের বন্ধু সানাউল্লাহ দেওয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেন। পুরো পরিবার এখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে ১৮ দিন লুকিয়ে থাকেন, এরপর একদিন রাত ১১টায় একটি খোলা নৌকায় তাঁর আগরতলার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সে রাতে বৃষ্টিতে কাক ভেজা অবস্থায় হেঁটে ২১মে ভারতের বক্সনগর গিয়ে পৌঁছান। ২৩ শে মে তাঁরা আগরতলা পৌঁছে কৃষ্ণনগরে বাংলাদেশ অফিসে গিয়ে নাম রেজিস্ট্রেশন করেন। সেখানে ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসে মিজানুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী মতলবগঞ্জের এসপি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এবি সিদ্দিকী, পুলিন দে, মমতাজ বেগমকে দেখতে পান। একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রাণভয়ে যখন দলে দলে মানুষ মতলবের চরে আসেন তখন মুকুল মজুমদার তার দুই ভাই, বন্ধু ও ছাত্র জনতা এই পুলিশ সুপার এবি সিদ্দিকীর নির্দেশনায় অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। খাওয়া চিকিৎসাসহ সবরকম প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার মা। দেশের গান গেয়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছেন। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ও ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের সঙ্গেও গান গেয়ে নন্দিত হয়েছেন। পুরো পরিবারটিই ছিল রাজনীতি সচেতন। দাদা অশ্বিনী কুমার ভৌমিক কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন।

এ রকম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহে বেড়ে ওঠা মুকুল ক্রমশ রাজনীতি সচেতন ও দেশপ্রেমী মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। এ চর্চার মাধ্যমে ক্রমশ হয়ে ওঠেন একজন সংবেদনশীল মানবিক মানুষ। মুকুল মজুমদারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু মতলবের মতলবগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৬৫ সালে মতলবগঞ্জ থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এ সময় থেকেই রাজনীতি সচেতন পরিপূর্ণ এই মানুষটি শিক্ষকদের চোখ এড়িয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে ১৯৬৯-এ তিনি বিএ পাস করেন।

রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা তীব্রতর হয়। কলেজছাত্র সংসদে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন ছাত্রলীগের হয়ে এবং আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের মিছিলেও অংশগ্রহণ করেন। তিনি আবার ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষেও ভ‚মিকা রেখে পুরোপুরিভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শুধু রাজনীতি নয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রয়েছে।

এবি সিদ্দিকের সুপারিশে মুকুল সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সঙ্গে কলকাতায় মহেন্দ্র রায় লেনে গোবরা ক্যাম্পে যান। এটি ছিল ফরিদপুর জেলার মাদারীপুরের জমিদার বিমল বাবুর ছাব্বিশ কক্ষবিশিষ্ট একটি বাড়ি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করার জন্য তিনি এ বাড়িটি বরাদ্দ দেন।
এখানেই চলছিল সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টারের কাজ। মুকুল মজুমদার এই ট্রেনিংয়ে অন্তর্ভুক্ত হন। সেন্টজন অ্যাম্বুলেন্সের উদ্যোগে এখানে নারীদের ফাস্ট এইড ও নার্সিং ট্রেনিং দেয়া হতো। কলকাতা নীলরতন হাসপাতালে তাদের ক্লাস করানো হতো।

মুকুল মজুমদার দীপা

ট্রেনিং দিতেন ক্যাপ্টেন এসএম তারেক, এলএমজি চালানোর ট্রেনিংও তিনি দিয়েছেন। মুকুল মজুমদার এখানে প্রখ্যাত লেখক মৈত্রেয়ী দেবী, কবি বিষ্ণু দে-র পুত্রবধূ অধ্যাপক মীরা দে, নবনীতা দেব সেন প্রমুখের সান্নিধ্যে আসেন। তারা উল্টো ডাঙ্গা, সল্টলেকসহ বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে ঘুরে ট্রেনিং গ্রহণকারী মেয়েদের উৎসাহ দিতেন। মুকুল মজুমদার এ সেন্টারের উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

এ সময় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দীপা, রাফেয়া আক্তার ডলি, কৃষ্ণা রহমানসহ ট্রেনিং সেন্টারের মেয়েরা মিলে একাত্তরের ১০ অক্টোবর কলকাতার রাজপথে এক প্রতিবাদ মিছিল করি। লায়লা পারভীন, গীতিকার ইরা কর, আম্বিয়া, মাজেদা, কৃষ্ণ দাস, হাফিজা আক্তার, গীতা মজুমদারসহ অনেকেই এ মিছিলে অংশ নেন। স্লোগান ছিল- ‘সপ্তম নৌবহর ফিরিয়ে নাও’। অমৃতবাজার’ পত্রিকায় এই মিছিলের ছবি ছাপা হয়। মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনা আমাকে এখনও ভারাক্রান্ত করে, যেমন আমরা যখন বিশাল এক জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার উদ্যোগ নেই তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সীমান্ত পাহারা দিচ্ছিল। সেই সময়ে হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরা কয়েক যুবককে দেখছিলাম। পরে জেনেছি ওরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ওরাই আমাদের রাতে সীমান্ত পার করে দেয়ার জন্য সেখানে অবস্থান করছিলেন। আমাদের দলের সঙ্গে ৯ মাসের শিশু নিরঞ্জন ও তার মাও ছিলেন। আমরা ধরা পড়ে যাব সেই আশঙ্কায় বাচ্চার কথা শুধু নয় কাঁদতেও দেয়া হয়নি।

তিন দিন শুধু ওর মায়ের আনা রান্না করা বার্লি ছাড়া কিছুই খায়নি। ছেলেটি পরে মারা যায়। আঠারো দিন আমাদের সঙ্গে থাকা এই শিশু নিরঞ্জনের অসহায় মৃত্যু এখনও আমাকে কষ্ট দেয়। যদিও জানি এমন অসংখ্য নিরঞ্জন কতভাবে না এ যুদ্ধে জীবন হারিয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনও জানা যায়নি।

এমন লাখ লাখ প্রাণ, হাজারো রক্তাক্ত ক্ষত, যন্ত্রণা নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। একটি মুক্ত, অসা¤প্রদায়িক, মানবিক বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে আমাদের সে কি আনন্দ! প্রথমে ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পরে ‘অবজারভার’ পত্রিকায় কাজ করি। ইতিমধ্যে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে অবসর নিই।’

তিনি বলেন, “নারী মুক্তিযোদ্ধারা যেমন সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে আশ্রয়, খাবার চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদানের কথা যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অত্যাচার নিপীড়িত হওয়ার কথাটি যেভাবে এসেছে, তাদের বীরত্বের কথা সেভাবে আসেনি।”

মুকুল মজুমদার দীপা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও মুক্তিযুদ্ধ-৭১ এসহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।