শারমীন শরীফ : ১৯৫৪ সালে শ্রীমতি আশালতা সেনে নেতৃত্বে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক রূপে সমাজসেবা ও সমকালীন প্রতিটি প্রগতিশীল গণআন্দোলনে প্রথম সারির নারী কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন মরিয়ম বেগম। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনে, ১৯৫৪ যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনে ও কাগমারী সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে এ দেশের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৩১ সালে ২৩শে মার্চ ফরিদপুর শহরে মরিয়ম বেগম জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খান বাহাদুর ইসমাইল প্রখ্যাত আইনজীবী ছিলেন। খান বাহাদুর ইসমাইল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন এবং কলকাতার ল কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে ফরিদপুরে ওকলাতি শুরু করেছিলেন। তিনি ফরিদপুর জেলার মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৩৮ সালে ফৌজি ইসলাম গঠন করায় তত্কালীন সরকার কর্তৃক তিনি খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। মা কাওকাবোন নেসা একজন শিক্ষিত নারী হওয়ায় স্বামীর সহচর্যে ছেলেমেয়েদেরও সুশিক্ষিত গড়ে তোলেন। কাওকাবন নেসা ইসলামের ইতিহাসের উপরে প্রচুর পড়াশুনা করেন, তিনি ভাল রবীন্দ্র সংগীত ও আধ্যাত্মিক গান করতেন। ফরিদপুরে গান্ধীজীর উপস্থিতিতে কাওকাবন নেসা চরকায় সুতা কেটে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাবা-মার চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে মরিয়ম প্রথম সন্তান। পৈত্রিক নিবাস গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার ঘুনাপাড়া গ্রাম। দাদা বশির উদ্দিন জমিদার ছিলেন। সম্ভ্রান্ত এবং রক্ষণশীল পরিবার হলেও বাড়িতে সংস্কৃতির চর্চা হতো। বাইরে বন্ধু-বান্ধবের সাথে মরিয়ম বেগমের মেলামেশা বাবা পছন্দ করতেন না কিন্তু মা এই বিষয়ে সহযোগিতা করতেন, ফলে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে গানের আসর বসতো। ছোটবেলা থেকেই ওস্তাদ রেখে গান শিখতেন ভাই-বোনেরা। এই কারণেই পরবর্তীকালে তাঁরা স্বনামধন্য ও বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিশিষ্ট নজরুল সংগীত শিল্পী ফিরোজা বেগম ও আসউদ্দৌলা তাঁরই ছোট ভাই বোন।
ফরিদপুর সরকারি গার্লস হাই স্কুলে তার প্রথম স্কুল জীবন শুরু হয়, এবং সেই স্কুল থেকেই ১৯৫০ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। বিভিন্ন কিছু কারণে এরপরে কয়েক বছর তাঁর লেখাপড়া আর হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালে তিনি কলকাতার টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট থেকে টেক্সটাইল ডিজাইন এর উপরে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি যখন স্কুলের ছাত্রী ছিলেন তখন স্কুলের অনুষ্ঠানেগুলোতে নিয়মিত ভাবে গান করতেন এবং সেই সাথে বেশ কয়েকটি নাটকেও অভিনয় করেছেন যেগুলোর মধ্যে ‘রাধাকৃষ্ণ’, ‘মীরাবাই’ উল্লেখযোগ্য। ৫০ দশকের প্রারাম্ভে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫০ সালে শ্রীমতি আশা লতা সেনের নেতৃত্বে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি গঠিত হয় এবং তিনি তার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সেই সমিতির মাধ্যমে নারী শিক্ষা বিস্তার, আত্মনির্ভরশীলতা ও সচেতনতার মাধ্যমে দেশ প্রেম জাগিয়ে সমাবেশের পূর্বে মহিলাদের সংগঠিত করেন ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
৫২র ভাষা আন্দোলনের সময় গেন্ডারিয়াতে প্রতিবাদ মঞ্চে তিনি শহীদ মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন, মিছিলে তিনি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন । ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টে যোগ দেন এবং যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি নুরজাহান মুর্শিদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা সহ পার্টির অন্যান্য কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন। টাঙ্গাইল কাগমারি সম্মেলনে তিনি সাত দিন ধরে সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করেন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় তার নাম তালিকাভুক্ত হওয়ায় বাড়িতে শুরু হয় পুলিশের হামলা। এই সময় পুলিশের ভয়ে বাড়িতে থাকা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং তাকে আশ্রয় নিতে হয় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে, এমনকি বাড়ির কাছে রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমেও অনেকবার রাত কাটিয়েছেন তিনি।
সমিতির মাধ্যমে তিনি মেয়েদের জন্য অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, তাছাড়া মেয়েদের তৈরি হস্তশিল্প প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করেন। এই সময় কিংবদন্তি ইলা মিত্রের হয়েও কাজ করেছেন তিনি, ইলা মিত্র যখন অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সাধীন তখন পার্টির হয়ে ইলমিত্রের কাছে জরুরি তথ্যসম্বলিত চিরকুট দিয়ে আসতেন। ১৯৫৮ সালের পর তিনি ন্যাপের সক্রিয় সদস্য হিসেবেও কাজ করেন, তার সেন্ট্রাল রোডের বাড়িতে সে সময় নিয়মিত মিটিং ও পরিকল্পনা হতো। মোজাফফর আহমেদ আব্দুল গনি হাজারীসহ অনেক নেতৃবৃন্দ তার বাসায় আত্মগোপন করতেন। তখন মাওলানা ভাসানীর নামে ওয়ারেন্ট বের হয় মাথার দাম ধরে, ভাসানী তখন আত্মগোপন করেছিলেন ঢাকার অদূরে ইটের ভাটা অঞ্চলে। সেসময় তিনি ও লায়লা সামাদ পার্টির পরিকল্পনা অনুযায়ী নৌকায় করে অনেক দূরে গিয়ে অর্থ খাবার ও তথ্য মাওলানা ভাসানের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
১৯৫৫ সালে তিনি ‘রুপায়ন’ নামে বøক, বাটিক ও স্ক্রিন প্রিন্টিং এর প্রথম সফল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশীয় রং ও নকশায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে অক্ষরসম্বলিত শাড়ির প্রবর্তন করেন। সেই সময় শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে ফলে ডিজাইনের ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিকভাবে শিল্পীর সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। তাদের এই সখ্যতার পরিণত প্রাপ্ত হয়েছিল বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তিনি পৈত্রিক বাড়ি ফরিদপুরে ছিলেন। ২৮ শে মার্চ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাবা-মা সহ গ্রামের বাড়িতে চলে যান। ৪ঠা এপ্রিল কামরুল হাসান সেখানে এসে পৌঁছান এবং একরাত সেখানে থাকার পর যশোর সীমান্ত পথে ভারতে চলে যান। ভারতে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের শরিক হন। গ্রামের রাজাকারের উত্পাত শুরু হলে মরিয়ম বেগম বাবার সাথে ঢাকায় চলে আসেন। পাকসেনারা স্বামী দেশদ্রোহী বলে তাকে নানাভাবে হুমকি দেয়, একপর্যায়ে তাকে জোর করে সাদা কাগজে স্বামীর সাথে ডিভোর্সের কথাও লিখিয়ে নেয়। এতকিছুর মধ্যেও তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন এবং নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন। ১৯৭২ সালে দেশের স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর আহবানে ‘মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা’র কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে দায?িত্ব পালন করেন। এই সংস্থায় বীরাঙ্গনা নারীদের মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলাসহ ভোকেশনাল ট্রেনিং, লেখাপড়া ও রান্নাবান্নার উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের সামাজিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হতো। মরিয়ম বেগম এ সকল ক্ষেত্রে তাঁদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।
পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের সরকারের উদ্যোগে গৃহীত বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের বøক ও বাটিক ছাপার প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দীর্ঘ এক যুগেরও অধিককাল দায?িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের পাটের শপিং ব্যাগে আকর্ষণীয় ডিজাইন ও রংয়ের ব্যবহার করে তিনি সেসব ব্যাগ রপ্তানিমুখী করে দেশের মূল্যবান রপ্তানি আয় বাড়াতে সাহায্য করেন ১৯৯৬ সালে তিনি উত্তরায় মহিলা আওয়ামী লীগ গঠন করেন এবং সভানেত্রী দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় তিনি বাংলাদেশের সপ্তম সংসদে আওয়ামী লীগ কর্তৃক মহিলা আসন-১২ থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি উত্তরা লেডিস ক্লাবের উপদেষ্টা সহ বিভিন্ন কলেজের উপদেষ্টা হিসেবে দায?িত্ব পালন করেছেন।
১৯৮৮ সালে ২রা জানুয়ারি স্বামী বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসান জাতীয় কবিতা উত্সবে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন, তারপর এই মহান মানুষটির সাহচর্য ছাড়া তিনি তিন মেয়ে এবং ছেলেকে নিয়ে সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিবেদন করেন, এই সময় তিন কন্যার মধ্যে তিনি এক অন্যা কে হারান । মানুষের জন্য কিছু করার প্রয়াসে তিনি বলেন, ‘যতটুকু পেরেছি চেষ্টা করেছি সমাজকে কিছু দিতে, দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে, এখন একেবারে জনগণের কাতারে আসার সুযোগ হয়েছে আর এ-সুযোগ আমি কাজে লাগাতে চাই, প্রতিটি দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়মের ছকে বেঁধে দিতে পারলেই আমার জীবনের সফলতা আসবে।’