শারমীন শরীফ : ১৯৪৫ সালে ১০ই অক্টোবর বৃহত্তম ময়মনসিংহের শেরপুর জেলা শহরের পৈত্রিক বাড়িতে মঞ্জুশ্রী নিয়োগী জন্মগ্রহণ করেন। মা জ্যোৎস্না নিয়োগী ছিলেন তেভাগা, টংক ও ভাওয়ালী আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী। জ্যোৎস্না নিয়োগী, নারী মুক্তি আন্দোলন এবং সাংস্কৃতের আন্দোলনেরও অগ্রপথিক। বাবা আন্দামান ফেরত বিপ্লবী রবি নিয়োগী বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ময়মনসিংহ অঞ্চলের সংগঠিত তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলনসহ সকল আন্দোলনের পরিকল্পনা ও সংগঠিতকরনে তার নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা ছিল অনুকরণীয়। মানব মুক্তি আন্দোলনের অকুতোভয় যোদ্ধা মা-বাবা দুজনকেই দীর্ঘদিন জেল-জীবন কাটাতে হয়েছে, যখন তাঁরা জেলের বাইরে ছিলেন তখন ও হুলিয়া মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। তাই বলা যায় জন্ম থেকে মঞ্জুশ্রী নিয়োগী মাতা-পিতার স্নেহ বঞ্চিত একটি বিপ্লবী পরিবেশে বড় হয়েছেন।
১৯৪৮ সালে টংক আন্দোলন চলাকালে পলাতক অবস্থায় মা জোৎস্না নিয়োগী গ্রেফতার হন এবং তাকে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং বাবা রবি নিয়োগীও,তখন ঢাকা জেলে। মাত্র তিন বছর বয়সের মঞ্জুশ্রী তখন ঠাকুমার কাছে থাকতেন। ১৯৪৯ সালে পুলিশের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ঘরবাড়ি ফেলে তিন ভাইবোন ঠাকুমাসহ কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন এবং কলকাতায় পিসি অনু চক্রবর্তীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। অনু চক্রবর্তী ভালো গান করতেন এবং শেরপুর থাকাকালে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষকদের বিভিন্ন জনসভায় গণসংগীত পরিবেশন করে জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতেন। কলকাতায় গিয়ে নাট্য সংঘতে যোগ দেন। মঞ্জুশ্রী পিসির সাথে বিভিন্ন রিহার্সালে অনুষ্ঠানে যেতে শুরু করলেন এবং শুনতে শুনতে নিজের গলায় গান তুলতে শুরু করলেন।
১৯৫২ সালে মা জোৎস্না নিয়োগী জেল থেকে মুক্তি পান। শেরপুরে কোন আত্মীয়-স্বজন না থাকায় তিনিও গোপনে কলকাতায় চলে যান। বাবা মায়ের রাজনৈতিক টানাপোড়নের কারণে মঞ্জুশ্রী পড়াশুনায় ব্যাহত হয় তাছাড়া এক স্থানে তিনি বেশিদিন থাকতেও পারেননি। কলকাতায় থাকাকালীন সময় তিনি ধারাবাহিকভাবে কিছুদিন পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে রবি নিয়োগী জেল থেকে মুক্তি পেলে জোৎস্না নিয়োগী ছেলেমেয়েদের নিয়ে আবার শেরপুরে চলে আসেন। মঞ্জুশ্রী তখন বাড়িতে পড়াশোনা করতেন এবং ১৯৫৫ সালে তিনি শেরপুর কায়েদে আযম বালিকা বিদ্যালয় পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে তিনি একই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং এরপরে তিনি ঢাকায় ইডেন কলেজে ভর্তি হন কিন্তু থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। এইসময় কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের কাজে এবং নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত করেন মঞ্জুশ্রী। এক সময় তিনি বুলবুল ললিত কলা একাডেমিতে ভর্তি হন এবং দু’বছর গান শেখেন।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং এরপরে ময়মনসিংহ মুমিনুন্নেসা কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৭ সালে বিএ পাস করেন। এই সময় পিতা রবি নিয়োগী ময়মনসিংহ জেলে ছিলেন। ময়মনসিংহ থাকাকালীন অবস্থায় মঞ্জুশ্রী ছাত্র ইউনিয়নের যোগ দেন। এই সময় মঞ্জুশ্রী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করতেন। বি এ পাসের পর ঢাকা সমাজ কল্যাণ কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৬৮ সালে সমাজ কল্যাণ প্রথম পর্ব পরীক্ষার পর শেরপুরে চলে যান, দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষা তার আর দেয়া হয়নি। ছাত্রসমাজের ১১ দফার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। মঞ্জুশ্রী এই সময়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশগুলোতে সঙ্গীত পরিবেশন করে ১১ দফা আন্দোলনকে বেগবান করতে সহযোগিতে করেন।
১৯৬৮ সালে মঞ্জুশ্রী মায়ের অনুপ্রেরণায় উদীচীর ভাবাদর্শে ‘গনসংস্কৃতি’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। ‘গনসংস্কৃতি’র প্রথম সভাপতি ছিলেন শেরপুর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ হান্নান সাহেব এবং সম্পাদক ছিলেন ইমদাদুল হক হীরা। মঞ্জুশ্রী সাংস্কৃতিক সম্পাদিকা পদে মনোনীত হন। ১৯৬৯ সালে নারায়নগঞ্জে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের আদলে ‘সংস্কৃতি সংসদ’ গঠিত হয়। ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী জলোচ্ছ্বাসের পর সংস্কৃতি সংসদের পক্ষ থেকে সংগীত পরিবেশনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তা দিয়ে খাবার কিনে দুর্গত এলাকায় পাঠানো হয়।
১৯৭১ সালে ২৫ শে মার্চ এর পরে মঞ্জুশ্রীদের বাড়িতে ছাত্র ইউনিয়ন শারীরিক কসরৎ ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয় এবং এই প্রশিক্ষণ একমাস ধরে চলে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পাক হানাদার বাহিনী শেরপুরে প্রবেশ করে। মঞ্জুশ্রীর বাবা রবি নিয়োগীর নামে তখন হুলিয়া চলছিল এবং তঁকে ধরে দিতে পারলে ৫০০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে পাকিস্তান সরকার। আর্মি আসার খবর পেয়ে তারা মেঘালয় বর্ডারের দিকে রওনা দেন এবং ভারতের মেঘালয়ের বারেঙ্গাপাড়া পৌঁছান। রবি নিয়োগী এবং জোৎস্না নিয়োগীর আসার খবর পেয়ে বেশকিছু গারো তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। এই গারোরা ছিল হাজার ১৯৪৭- এর আগের আন্দোলনের সহযোদ্ধা। বারেঙ্গা পারায় কয়েকদিন থাকার পর মঞ্জুশ্রী তার বড় ভাই রনজিৎ নিয়োগীর সাথে কলকাতায় চলে যান। বাবা-মা বারেঙ্গাপাড়ায় থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং মঞ্জুশ্রী কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতিতে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতির পক্ষ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে জনগণকে বাংলাদেশের অবস্থা জানাতেন এবং তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দিতেন। এরপরে মঞ্জুশ্রী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধ সময়ের স্মরণীয় ঘটনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সময়ের একটি দিনের কথা উল্লেখ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে পাক বাহিনী তখন ক্রমান্বয়ে পিছু হটছিল। ৫ ডিসেম্বর যশোর জেলার বর্ডার এলাকা থেকে পিছু হটে তারা যশোর ক্যান্টনমেন্টে চলে আসে। পরদিন মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা অনেকেই যশোরের বেনাপোল বর্ডার অতিক্রম করে নাভারন বাজারে বিজয়োল্লাসে জনসভা করেন। মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতির অনেক শিল্পী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে মঞ্জুশ্রী নিয়োগীও সেদিন কলকাতা থেকে আসেন এবং উক্ত জনসভায় গণসংগীত পরিবেশন করেন। দেশ হানাদার মুক্ত হলে মঞ্জুশ্রীরা সপরিবারে শেরপুর ফিরে আসেন কিন্তু বাড়ি বলতে সেখানে কিছুই ছিল না, সবই ধ্বংসস্তূপ। প্রতিবেশী বাকিতুল্লা মিয়া থাকার জন্য দুটি ঘর ছেড়ে দেন, ওই বাড়িতে থেকে রবি নিয়োগীঁইয়ানিজ ভিটাতে কোনরকম বসবাসযোগ্য একটি ঘর তোলেন।
১৯৭২ সালে মা জোৎস্না নিয়োগীর উদ্যোগে শিশু কিশোরদের নিয়ে খেলাঘরের শাখা গঠন করা হয়। খেলা ঘরের কাজকর্ম চলত মঞ্জুশ্রী দের বাড়িকে কেন্দ্র করেই। মঞ্জুশ্রী খেলাঘরে ভাই-বোনদের গান শেখাতেন। ১৯৭৪ সালে দেশে খাদ্যা ভাব দেখা দেয়, শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সারাদেশের মতো শেরপুরেও লঙ্গরখানা খোলা হয়। বিভিন্ন মহল থেকে অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ করে আটা কিনে রুটি বানিয়ে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদেরকে দেয়া হতো। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের জন্য মঞ্জুশ্রী তখন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রগতিশীল কর্মী অশোক দাশগুপ্তের সাথে তিনি পরিণয়ের সূত্রে আবদ্ধ হন। স্বামী রাজনৈতিক সচেতন হওয়ায় রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মঞ্জুশ্রী তার কাছ থেকেও সহযোগিতা পেয়ে এসেছেন। নারায়ণগঞ্জে বাংলাদেশ উচিৎ শিল্প গোষ্ঠীর শাখা গঠন হওয়ার পর থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। এক কন্যা সন্তানের জননী মঞ্জুশ্রী নিয়োগী দাশগুপ্তা নারায়ণগঞ্জ যে একটি স্কুলের শিক্ষকতা করছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র সৈনিকদের কিছুটা মূল্যায়ন হলেও শব্দ সৈনিকদের কোন মূল্যায়ন হয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেন মঞ্জুশ্রী নিয়োগী? এছাড়া স্বাধীনতার ৪০ বছরেও দেশের তেমন কোন উন্নতি না হয়ে বরং দেশ ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন? এখানে জীবনের সৌন্দর্যবোধ, সুকুমারবৃত্তি লুণ্ঠিত হচ্ছে? একটা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে আজ দেশের মানুষ? এমনকি দেশ এখনও স্বাধীনতাপূর্ব তিমিরেই রয়ে গেছে বলে অভিমত মুক্তিযোদ্ধা মঞ্জুশ্রী নিয়োগীর?