শারমীন শরীফ : ৪ঠা এপ্রিল, ১৯৭১, দাউদাউ করে জ্বলছে নরসিংদীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। তারই পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন বুলবুলের পরিবার। প্রায় দু’ঘণ্টা শেলিং হওয়ায় সেদিন কেঁপে কেঁপে উঠছিল চারিদিক। কাছেই কাঠের একটি দোতলা বাড়ি অক্ষত অবস্থায় থাকায় সেখানে আহতদের নিয়ে আসা হয়। কারোর হাত নেই পা নেই, বিভীষিকাময় এক দৃশ্য। তাঁদের সেবার জন্য এগিয়ে আসেন বুলবুল। ডেটল জল দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন মুক্তিযোদ্ধা সহ আহত অন্যান্যদের। রক্তক্ষরণ হতে হতে চোখের সামনে কয়েকজন নিথর হয়ে যান। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করবার ছিল না তাঁর। অদ্ভুতভাবে যুদ্ধের সাথে জড়িয়ে গেলেন তিনি। সেখান থেকে শুরু হয় তাঁর নিরুদ্দেশ যাত্রা, যার সমাপ্তি ঘটে কলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডস্থ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। বুলবুল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী সংস্থা এবং শরণার্থী শিল্পীগোষ্ঠীর সাথে যুক্ত হয়ে গণসংগীত ও দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য জনমত সৃষ্টিতেও তিনি ভ‚মিকা রাখেন।
বুলবুল মহলানবীশ ১৯৫৪ সালের ১০ই মার্চ কুমিল্লা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা অরুণচন্দ্র মহলানবিশ ব্রিটিশ আর্মি হয়েও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। দেশ বিভাগের পর সার্ভে অফ পাকিস্তানে যোগ দেন। তিনি সংস্কৃতি ও সমাজসেবার অঙ্গনে এক বিশেষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সংগঠক, আবৃত্তিকার ও নাট্য পরিচালক হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। করাচিতে প্রথম বাঙালি সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পী চক্র’ এবং নারিন্দার ‘অভিযাত্রীক’ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। মা বাসন্তী মহলানবীশ ভালো গান গাইতেন। ফলে বাড়িতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল যা বুলবুল ও তার ভাইবোনদের প্রভাবিত করেছিল। সব ভাই-বোনের মধ্যে বুলবুল দ্বিতীয়।
বুলবুলের লেখা পড়ায় হাতেখড়ি নারিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালযয়ে। পরবর্তীকালে বাবার চাকরির সুবাদে করাচি স্কুলে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৩ সালে করাচি থেকে এসে ভর্তি হন ঢাকার নারী শিক্ষা মন্দির উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। সেই স্কুল থেকে ১৯৬৯ সালে এস.এস. সি পাস করেন। এইচ.এস.সি ভর্তি হন ঢাকার বকশীবাজার সরকারি ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে। ১৯৭২ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন তিনি। ১৯৭৬ সালে অনার্স পাস করে স্বামীর চাকরির স্থল মধ্যপ্রাচ্যে চলে যান। পরবর্তীকাল ১৯৯২ সালে তিনি প্রাইভেটে এম.এ. পাস করেন।
তিন বছর বয়সে কবিতা আবৃত্তি গান ও মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার প্রবেশ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভিত্তিক সংগীত ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তিনি একাধিকবার প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সপ্তাহে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত ও নজরুল সংগীতে তিনি প্রথম হন। সূর্যস্নান ছবির নায়িকার ছোটবেলার চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন। স্কুলের সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন তিনি। ১৯৬৬ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি জগন্নাথ কলেজে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। অন্যায়ের প্রতিবাদে, সমাজ বদলের লড়াইয়ে এবং ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সংগীত যে একটি শক্তিশালী মাধ্যম সেটি তিনি খুব অল্প বয়সেই বুঝেছিলেন। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রাহাত খানের লেখা ও গণসংগীত শিল্পী সুখেন্দু চক্রবর্তী সুরারোপিত কিছু অবিস্মরণীয় গান তিনি একক ও সমবেত কন্ঠে পরিবেশন করেন। শিল্পীদের নিয়ে নিজেই একটি দল গঠন করে তিনি তাঁতিবাজার, বাংলাবাজার, পলাশগঞ্জ, গেন্ডারিয়া, ফরিদাবাদ, গোপীবাগ, ওয়ারী, আরমানিটোলা সহ বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত ও ব্রতচারী নৃত্য পরিবেশন করেন। কচিকাঁচার মেলার সদস্য হিসেবে বিভিন্ন জেলায় তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাবার অফিসের এক অনুষ্ঠানে বাবার একজন সহকর্মী তাকে নজরুল সংগীতে, ‘জয়গানে’ ‘ভগবানের’ জায়গায় ‘রহমান’ বলার জন্য বললে, সেই ছোট্ট বয়সেই তিনি প্রতিবাদ করে গান না গেয়ে চলে আসেন। বুলবুল স্কুলের উচ্চ শ্রেণীতে পড়ার সময়ই ছাত্র ইউনিয়ন রাজনীতির সাথে যুক্ত হন।
১৯৭৯ এর গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে সকল সভা-সমিতি, সমাবেশ, মিছিল ও গণ সংগীতের আসরে অংশগ্রহণ করেছেন। সে সময়কার প্রখ্যাত সুরকার সুখেন্দু চক্রবর্তী নেতৃত্বে গণসংগীত পরিবেশন করেন ট্রাকে করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুর পর প্রতিটি প্রতিবাদ মিছেলে তিনি অংশগ্রহণ করেন। অতিক্রম করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। লাঠি চার্জে তিনি আহত হন। সেসময় আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড ফরহাদ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, পঙ্কজ ভট্টাচার্য,ফৌজিয়া মুসলেম, রিনা ফরহাদ, তরু আহমেদ, দীপা দত্ত, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ১৯৭০ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সকল আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে বিয়ে হয় একই রাজনৈতিক আদর্শের সৈনিক প্রকৌশলী সরিত কুমার লালার সাথে।
১৯৭১ এর মার্চ মাসে তিনি সদ্য বিবাহিতা। স্বামীর সিরাজগঞ্জের চাকরিস্থলে। ২ মার্চ নারিন্দা দয়াগঞ্জ এলাকায় গঠিত হয় সর্বদলীয় প্রথম পরিষদ। যার আহŸায়ক ছিলেন সাংবাদিক আবেদ খান এবং যুগ্ম আহ্বায়ক বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া। প্রতিদিনই মিচ্ছিল গুলি ধরপাকড় চলছে। গোপনে চলে গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি। সে সময় পরিষদের সদস্য হিসেবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সকলকে প্রস্তুত রাখা, দা, বটি, লাঠি-সোটা, ইট, পাথর সবকিছুই সময় মত ব্যবহার করে আত্মরক্ষার পরামর্শ দেয়া এবং সেইসাথে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নেন তিনি। বাবা আর্মিতে ছিলেন বিধায় প্রশিক্ষক হিসেবে জরুরি অবস্থায় কি করনীয় তার প্রশিক্ষণ দিতেন। ফলে বাড়িতেই ছোটখাটো একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প তৈরি করা হয়।
বুলবুলরা যে পাড়ায় থাকতেন সেখানে তারা সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন, যুদ্ধের ডামাডোলে পাড়ার বিহারীদের মধ্যে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বাবা প্রাক্তন সামরিক অফিসার, দুই বোন ও বড় ভাই সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ফলে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন। পাড়ার মুরুব্বিরা তখন তাদের ঢাকার বাইরে চলে যাবার জন্য পরামর্শ দেন। ২৯ মার্চ পরিবারের সকলে ঢাকা ত্যাগ করে নরসিংদী চলে যান। সেখান থেকে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে কলকাতায় পৌঁছান। সেখানে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত শিল্পী ও নাট্য শিল্পী হিসেবে শব্দ সৈনিকের দায?িত্ব পালন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে কাপড়-চোপড়, শুকনো খাবার ও ওষুধ বিতরণ করেন, সেই সাথে সংগীত পরিবেশন করে জনগণকে দেশকে মুক্ত করার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকালে সেই সময়কার রেসকোর্স ময়দানে যখন পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করছিল ঠিক সেই মাহন্দ্রেক্ষণে কলকাতার বালিগঞ্জের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’- গানটি। বাঙালির বিজয়ের ঐতিহাসিক ক্ষণে কালজয়ী গানটিতে কণ্ঠ দেয়া শিল্পীদের অন্যতম- বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশ।
মহিলা পরিষদের জন্ম লগ্ন থেকেই বুলবুল এর সদস্য ছিলেন। মহিলা পরিষদের প্রথম সম্মেলনে তিনি একক কন্ঠে, ‘জাগো নারী জাগো’, গানটি পরিবেশন করলে মহীয়সী বেগম সুফিয়া কামাল ও মনোরমা তাকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ‘নাট্যচক্র’ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি।
আবুধাবির প্রবাস জীবনে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য তিনি সেখানে বর্ষবরণ, একুশে ফেব্রæয়ারি, স্বাধীনতা দিবস,বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন পরিবেশনা শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে বেতার ও টেলিভিশনে নিরপেক্ষ অনুষ্ঠান প্রচার এবং শিল্পীদের ১৪ দফার দাবিতে অনুষ্ঠান বর্জন করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সদস্য হিসেবে তিনি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিনিধিত্ব করেন। আন্দোলনের তিন বছর তিনি বিভিন্ন রকম হুমকিসহ নানা ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন।
বুলবুল দুই ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন। মহিলা পরিষদ রোটারি ক্লাব অব গ্রেটার ঢাকা ও বেনুকা ললিতকলা কেন্দ্রের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। ছাড়াও ছিলেন বেতার টেলিভিশনের নিয়মিত সংগীতশিল্পী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় গল্প কবিতা ও সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধ তিনি লিখতেন নিয়মিতভাবে।
বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে চীন আন্তর্জতিক বেতারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বরেণ্য এই কণ্ঠযোদ্ধা স্মৃতিচারণ করলেন ঠিক ৫০ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক ক্ষণের। বললনে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ সংগ্রামী এক নারী – বুলবুল মহলানবীশ এবং বাস্তবের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। তরুণ প্রজন্মকে বললনে ইতিহাসলগ্ন হতে। তাঁর বিশ্বাস সুস্থ সংস্কৃতির চর্চাই সমাজকে নিয়ে যেতে পারে প্রগতির পথে। জীবনভর সংস্কৃতির পথেই তাঁর দৃপ্ত পদযাত্রা!
বুলবুল মহলানবীশের ১২টির বেশি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি ও স্মৃতি-৭১ তার বহুল আলোচিত বই। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য পেয়েছেন- চয়ন স্বর্ণপদক, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ফাউন্ডেশন সম্মাননা, পশ্চিমবঙ্গের নজরুল একাডেমি সম্মাননা পদকসহ নানা পুরস্কার।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই শব্দসৈনিক বুলবুল মহলানবীশ না ফেরার দেশে চলে গেছেন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর শুক্রবার (১৪ জুলাই) ২০২৩ ভোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।