শারমীন শরীফ : আতিয়ার রহমান ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংগ্রামী যোদ্ধা। আতিয়ার রহমান জানতেন প্রয়োজনে তার ষোড়শী কন্যা যে কোনো যুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন আর সেজন্যই তিনি ছোটবেলা থেকেই আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মেয়েকে করে তুলেছেন। স্কুল জীবন থেকে ফিরোজা খানম মিছিল, মিটিং ও আন্দোলন, সংগ্রামের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন। তার এসব কাজে মা উম্মে কুলসুমের আপত্তি থাকলেও বাবার প্রশ্রয় তাকে সব সময় উৎসাহিত করেছে। মাত্র পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় ফিরোজা খানম বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের মহাসম্মেলনে যশোর থেকে যোগ দেয়া কয়েকজন মেয়ের মধ্যে ফিরোজা খানম ছিলেন কনিষ্ঠতম।

ফিরোজা খানম ১৯৫৫ সালের ১৭ ই ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলার তেরখানা থানার ইছামতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মা বাবার আট সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা আতিয়ার রহমান খান দেশ বিভাগের পর আনসার বাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। বাবার বদলির চাকরি ছিল বলে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে তাঁদের বিভিন্ন স্কুলে তাঁদের পড়তে হয়েছে। এরকম অনেক ঘোরাঘুরির পরে ফিরোজা খানম ১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি প্লানিং কমিশন ও রেডিওতে খন্ডকালীন সমাজ কল্যাণ বিভাগে যোগদান করেন।

ফিরোজা খানমের বাবা-মা মেয়েকে মেয়ে হিসেবে না দেখে বরং মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁদের এই অগ্রসর চিন্তার কারণে ফিরোজা স্কুল জীবন থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্য ও নাটকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে কোন বাধা পাননি। স্কুলে পড়াশোনা কালীন তিনি সিভিল ডিফেন্স ও রেড ক্রসের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের অংশগ্রহণ করেন। এই প্রশিক্ষণ থেকে তিনি যে কোন দুর্যোগ ও যুদ্ধের সময় আহত পঙ্গুদের কিভাবে সারিয়ে আনতে হবে, কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে হবে, কিভাবে সেবা দিতে হবে, ইত্যাদি বিষয় আত্মরক্ষামূলক ও নার্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।এসময় তিনি গার্লস গাইডেরও সদস্য ছিলেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭০ সাল, ফিরোজা খানম তখন ছাত্রলীগের যশোর সরকারি মহিলা কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদিকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসেছিলেন সাংগঠনিক সফরে, মিটিং শেষে অবস্থান করছিলেন সার্কিট হাউসে। স্নেহ করে ফিরোজকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার নাম। জানতে চেয়েছিলেন ফিরোজা কোন ক্লাসে পড়ে তার বাবা কি করে এইসব। সবকিছু জেনে নিয়ে তিনি ফিরোজার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘এই তোরে দিয়েই আমার কাজ হবে। তোরেই আমার দরকার।’ বঙ্গবন্ধুর এই সামান্য কথাগুলি ফিরোজকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অসামান্য শক্তি যুগিয়ে ছিল।

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবি ঘোষণার পর বাংলার মানুষ স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালে সারাদেশের মতো যশোরে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আলী হোসেন মনি, জেলা সভাপতি খান টিপু সুলতান, সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলমসহ অন্যান্য নেত্রীবৃন্দ পরিক্ষিত কর্মীদেরকে একটি নিউক্লিয়াস গ্রুপে সংগঠিত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সফল পরিণতিতে এ সকল কর্মীরা উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রেখেছিল। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিউক্লিয়াস গ্রুপের চল্লিশ জনকে কয়েকটি দলে ভাগ করে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এই চল্লিশ জনের মধ্যে ৬/৭ জন মেয়েও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা ছিলেন রওশন জাহান সাথী, সালেহা বেগম শাহিদা বেগম, ডরথি দাস হিয়া, ফিরোজা খানম, মমতাজ বেগম প্রমুখ। শংকরপুরের রশিদ সাহেবের আমবাগানে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। মূল প্রশিক্ষক ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন সদস্য আবু জাহিদ। মাসাধিকার প্রশিক্ষণে রাইফেল চালনা, গ্রেনেড ছোড়া, ক্রলিং করা, কেমোফ্লেজ করা, ট্রেঞ্চে আশ্রয় নেয়ার পদ্ধতি, যুদ্ধাহতদের নিয়ে আসা, তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, আত্মরক্ষার কৌশল রক্ত করা এবং এ্যাম্বুস করার বিষয়গুলো শেখানো হয়।

ফিরোজা খানম

১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ, সারা দেশের মতো যশোরের জনগণও বিক্ষোভ ফেঁটে পড়েছিল। হাজার হাজার মানুষের মিছিল, অগ্রভাগে বেশ ক’জন সাহসী মেয়ে। তাঁদের একজন ফিরোজা খানম। মিছিলটি টেলিফোন ভবনের সামনে আসতেই সারা শহর প্রকম্পিত হয় গুলির শব্দে। মানুষ হতবাক এবং ইতস্তত হয়ে গেলেও মিছিল থেকে কেউ পালায়নি। পাকিস্তানের সৈন্যদের গুলিতে নিহত হলো রাস্তার পাশের বাড়ির চারুবালা। মিছিল আরো জঙ্গি রূপ ধারণ করে তখন। স্লোগানের আওয়াজ আরো বৃদ্ধি পায়। মিছিল শেষে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পরের দিনের মিছিলে অগণিত মানুষ, যশোর শহর হয়ে পরে মিছিলের শহর। ওই সময় প্রতিটি মিছিলের সম্মুখভাগ থেকে স্লোগান দিয়েছেন ফিরোজা খানম।

এদিকে ফিরোজা খানমের ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আশরাফুর রহমান বুলবুল ও বাড়ির কাউকে না জানিয়ে বন্ধুদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে চলে যায়। যোদ্ধা পিতার সন্তানকে মাতৃভ‚মি হানাদার মুক্ত করার অদম্য বাসনায় টেনে নিয়ে যায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। বুলবুল ভারতের বিহারের ট্রেনিং শেষে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং অসীম সাহসিকতার সাথে কয়েকটি অপারেশনে করে।

২৫ শে মার্চের আগেই ফিরোজা খানমসহ ১০-১৫ জনের একটি দল যশোর শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে সাড়াপোল গ্রামে অবস্থান নেন। ওই এলাকার জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা এবং তরুণদেরকে সংগঠিত করে তাঁদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজে ফিরোজা যুক্ত ছিলেন। ২৭শে মার্চ ফিরোজা খানমের বাবা মেয়েকে দেখতে সাড়াপোল গ্রামে যান এবং শহরের খবরা খবর জানান। বাবার কাছ থেকে জানতে পারেন পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যরা যশোর শহরের রাস্তায় যাকেই পাচ্ছে তাকে গুলি করে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে। সেই বীভৎস অত্যাচার থেকে আট বছরের শিশুর রেহাই পায়নি। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন স্থানে পড়ছে অবিরাম মর্টারের শেল। বাবা ফিরোজ কাকাকে কিছু টাকা দিয়ে বলেন সে যেন যশোর শহরের ধারে কাছেও না যায় এবং আবার আসবেন মেয়েকে দেখতে।

ফিরোজা খানমের বাবা আতিয়ার রহমান খান হাই কমান্ডের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এলাকার আনসারদের সংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আতিয়ার রহমান ২৯ শে মার্চ মেয়েকে আবার একনজর দেখার জন্য গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন, শহরের পাশেই চাঁচড়ার মোড়ে পৌঁছতেই পাকহানাদের ব্রাশ ফায়ারে তিনি নিহত হন। শহরের সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় বিক্ষুদ্ধ হয়ে চাঁচড়ার কাছে একটি ব্রিজ ভেঙে ফেলে এবং এর উপরে পাশের চাটাই দিয়ে চাটাইয়ের উপরে পিচ ঢেলে ফাঁদ পাতে। আর্মিরা গাড়ি শুদ্ধ ব্রিজের নিচে পড়ে যায় তারপরেই শুরু হয় মুক্তি পাগল মানুষের সাথে হানাদার বাহিনীর লড়াই। গ্রামের সাধারণ নিরস্র মানুষেরা সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। গুলি বোমা আর মোটর এর শব্দে প্রকম্পিত হয় যশোর শহর। জনমানব শূন্য রাস্তা, ৩০ মার্চ বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটেলিয়ানসহ ইপিআর হেড কোয়াটারের বিদ্রোহ এবং পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র জনতার হাতে আসার পর যশোর শহর পুনরায় জনতার দখলে চলে আসে। কয়েকটা দিন জনগণ কিছুটা স্বস্তি পায়। পহেলা এপ্রিল প্রাক্তন দারোগা রশিদ সাহেবের নেতৃত্বে কয়েকজন মিলে রাস্তার উপরে পড়ে থাকা লাশ নিয়ে এসে কবর দেন। এর কয়েকদিন পর আর্মির গুলিতে তিনিও শহীদ হন। এদিকে ফিরোজা খানম পথ চেয়ে বসে থাকেন কবে বাবা শহরের খবর এবং জামা কাপড় খাবার নিয়ে আসবেন, কিন্তু বাবার আর আসা হয়নি।

সাথী মুক্তি যোদ্ধারা আগেই ফিরোজার বাবার মৃত্যুর সংবাদ জানতে পেরেছিল কিন্তু ফিরোজাকে জানানোর সাহস তাঁদের হয়নি। কয়েকদিন পরে সাথী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে ফিরোজা যশোরের বাড়িতে আসেন। ফিরোজা কে দেখা মাত্রই ছোট ভাই বোন এবং সদ্য বিধবা মায়ের শুরু হয় গগনবিধারী কান্না। আকাশ বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণের জন্য। তখন শহর থেকে জনগণ পালাতে শুরু করে। ফিরোজা ও তার মা ছোট ভাইবোনদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নড়াইলের রাস্তা বাদে সকল রাস্তা হানাদারদের দখলে। তাই নড়াইলের রাস্তা ধরেই যাত্রা শুরু করেন, সাথে এলাকার আরো কিছু সাথী মুক্তিযোদ্ধা দল এবং কয়েকজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ট্রাকে করে নড়াইল হয়ে এড়েন্দা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেন। একমাস থাকবার পর খুলনা জেলার তেরখাদা থানার আটলিয়া গ্রামে আবু চাচার বাড়িতে চলে যান। আবু চাচা ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা আর তাই এই বাড়িটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটি। ফিরোজা খানম তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়ে স্পাইংয়ের কাজ শুরু করেন। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফিরোজা এই অঞ্চলেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করেন।

বড় সন্তান হওয়ায় স্বাধীনতার পরেই ফিরোজাকে সংসারের হাল ধরতে হয়। বিধবা মা ও ছোট ছোট ৬-৭ জন ভাই বোনদের কে নিয়ে কি করবেন কোথায় যাবেন কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের সাথীরা সকলেই বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। তখনকার ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ফিরোজার মা ও মুক্তিযোদ্ধা ভাই বুলবুল সহ ফিরোজাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাসায়। বঙ্গবন্ধু ফিরোজাকে দেখেই চিনতে পারেন। বঙ্গবন্ধু সে সময় ফিরোজার মায়ের হাতে নগদ ৫০০০ টাকা দেন এবং পেনশনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এই অভাবের মধ্যেও ফিরোজা নিজে এবং ভাই-বোনদের পড়াশুনা বন্ধ করেননি। বি এ পাসের আগেই তিনি ১৯৭৮ সাল থেকে চাকরি করে ছোট ভাইবোনদের পড়াশুনা করাতে থাকেন। ১৯৬৯ সালে ১৮ নভেম্বর জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ পূরণ কর্মকর্তা খুলনার শেখ শাহনেওয়াজ আলীকে বিয়ে করেন।

ফিরোজা খানম বর্তমানে সমাজ কল্যাণ বিভাগে সমাজসেবা অফিসার হিসেবে কর্মরত। ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল এখন থানা আনসার এডজুটেন্ট হিসেবে কর্মরত। ফিরোজা খানম নিজে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। যে চেতনা নিয়ে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার আটাশ বৎসর পরেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তবে তিনি হতাশ হননি। ফিরোজা খানম বিশ্বাস করেন সত্যের জয় একদিন হবেই।