শারমীন শরীফ : অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলার পালং গ্রামে ১৯২৪ সালের পহেলা জানুয়ারি নিরুপমা বন্দোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। মাতা শ্রীমতি বিন্দুবাসিনী দেবী এবং পিতা শ্রী মতিলাল বন্দোপাধ্যায়। পিতা মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মাতা বা পিতার কেউই কখনো কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তবে ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি তাদের নৈতিক সমর্থন ছিল। তাদের তিন কন্যা-সন্তানের মধ্যে নিরূপমা প্রথম। নিরুপমার জ্যাঠামশাই কলকাতায় থাকতেন এবং পরবর্তীকালে নিরুপমার পিতা-মাতাও জ্যাঠামশায়ের ইচ্ছায় সন্তানদেরকে নিয়ে কলকাতা চলে যান। কলকাতা কর্পোরেশন স্কুল থেকে নিরুপমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। চতুর্থ শ্রেণীর পাশের পর পঞ্চম শ্রেণীতে না পড়ে ডবল প্রমোশন নিয়ে ১৯৩৪ সালে রবীন্দ্র পরিবারের সরলা দেবী চৌধুরানী প্রতিষ্ঠিত ‘ভারত স্ত্রী শিক্ষা মহামন্ডল’- এ ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ১৯৩৯ সালে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯৪৭ সালে স্নাতকে ভর্তি হতে পারেননি কিন্তু ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিষয়ে সম্মানে ভর্তি হন। ঢাকাতে এসে তিনি মামার বাড়িতে অবস্থান করেন।
১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় কমরেড নিবেদিতা চৌধুরী নাগের সংস্পর্শে আসেন তিনি। নিবেদিতা নাগের কাছ থেকেই তিনি মার্কসীয় শিক্ষায় তালিম নেন এবং সমাজ ব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে পরবর্তীকালে নিরুপমা, কমরেড নেপাল নাগ, নিরঞ্জন গুপ্ত সহ অনেক কমরেডের সংস্পর্শে এসেছেন।
১৯৪২ সাল থেকেই নিরুপমা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজে যুক্ত হন। এছাড়া ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে সকল মিটিং মিছিল তিনি সম্মুখ সারিতে থাকতেন। এই সময় ফ্যাসিবাদীরা অনেক প্রগতিশীল কর্মীদের উপরে দৈহিক আক্রমণ চালায়, তরুণ প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী ও কবি সোমেন চন্দ সে-সময়ই খুন হন। এই ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণের প্রতিবাদে ঢাকাতে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং নিরুপমা বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিটি আন্দোলনেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
এবং সেখানেও তিনি মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশে শুরু হয় খাদ্য সংকট, দুর্ভিক্ষ শুরু হয় মহামারী। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নিরুপমা বন্দ্যোপাধ্যায় সমিতির পক্ষ থেকে সে সময় দিনরাত পরিশ্রম করে খাদ্য সংগ্রহ এবং প্রাণের কাজে অংশগ্রহণ করেছেন।
১৯৪৫ সালের ১৩ই মে কমরেড নিরঞ্জন গুপ্তের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। নিরঞ্জন গুপ্ত ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী এবং তিনি ছিলেন অব্রাহ্মণ। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের সাথে অব্রাহ্মণের বিয়ে ছিল অত্যন্ত গর্হিত কাজ, যে সংস্কার বর্তমান সমাজেও বিদ্যমান। নিরুপমার বাবা এই বিয়েতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে শুরু হয় সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা, নিরুপমা কলকাতার দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর নিরঞ্জন গুপ্তকে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকায় চলে আসতে হয়। ইতিমধ্যে তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। স্বামীর সাথে নিরুপমা গুপ্তও এক বছরের শিশুকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকাতে তারা যে বাসায় থাকতেন সেই বাসা কে পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড ডেন হিসেবে ব্যবহার করা হত, কারণ তখন পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে বে-আইনি ঘোষণা করেছিল। ১৯৪৯ সালে জেলে রাজবন্দীদের দাবির সমর্থনে এবং রাজনীতিদের মুক্তির দাবিতে মহিলা সমিতি, ছাত্র ফেডারেশন ও শ্রমিক সংগঠন যৌথভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকার সদরঘাটের কাছে অবস্থিত কন্ডিশন পার্কে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে কমরেড নিবেদিতা নাকের বক্তব্য শেষ হতেই পুলিশ ১১ জন মেয়েকে গ্রেফতার করে। তাদের মধ্যে নিরুপমা গুপ্তও ছিলেন। নিরুপমা গুপ্তের শিশুসন্তান তখন তার পিতা-মাতার কাছে ছিল। পরদিন নিরুপমার জেল হয়, নিরুপমার সাথে অন্য যেসব নারীরা জেলে গিয়েছিলেন তারা হলেন নিরুপমার মামী সুদেবী মুখার্জি, নিরুপমার দুই মামাতো বোন কল্যাণী ও মনীষা, নিবেদিতা নাগ, ইরা রায়, নাদেরা বেগম প্রমুখ। জেলে ঢুকে তারা অনশনকারী কমরেডদের সমর্থনে অনশন শুরু করেন। এই অনশন চলতে থাকে ত্রিশদিন ধরে।
অনশন ভাঙ্গানোর জন্য জেল কর্তৃপক্ষ জোর করে হাত-পা বেঁধে নাকের মধ্যে দিয়ে নল ঢুকিয়ে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করত এবং মেয়েরা সে দুধ বমি করে ফেলে দিত, এ নিয়ে চলত ধস্তাধস্তি। এই ধস্তাধস্তিকালীন সময়ে একবার এক মহিলা পুলিশের দরজায় ধাক্কা লেগে নাক থেকে রক্ত বেরিয়ে যায় এর ফলে রাজবন্দীদের নামে কেস হয়। জেলেই কোর্ট বসানো হয় এবং বিচারে নিরুপমা গুপ্ত নাদেরা বেগম এবং ইরা রায়ের তিন মাসের সাজা হয়। একমাস বাদে তারা আবার অনশন শুরু করেন। পরবর্তীকালে জোর করে খাওয়ানোর সময় দুধের মধ্যে শক্তি বলকারক কোন ট্যাবলেট গুলিয়ে দেয়া হতো ফলে আর বমি করা যেত না এবং সেই সাথে খাওয়ানোর পরে তাঁদেরকে জানলার শিকের সাথে হ্যান্ডকাপ দিয়ে আটকে রাখা হতো যাতে তারা বমি করতে না পারে। নিরুপমা ছিলেন বেশ হালকা পাতলা, পুলিশ চলে যাওয়ার পর হ্যান্ডকাপ থেকে হাতটা গলিয়ে বের করে আনতেন এবং অন্যদের হ্যান্ডকাপ খুলে দিতেন। দ্বিতীয়বার অনশন চলে ষাট দিন। ইতিমধ্যে নিবেদিতা নাগ, সুদেবী মুখার্জি, মনীষা জামিনে ছাড়া পান। সুদেবী মুখার্জি ও মনীষা ছাড়া পাওয়ার পরে কলকাতা চলে যান কিন্তু নিবেদিতা নাগ আবার আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান।
নিরুপমা গুপ্ত ছাড়া পান ১৯৫০ সালে, ছাড়া পেয়ে তিনিও কলকাতায় চলে যান। কিন্তু নিরুপমার স্বামী পূর্ব বাংলাতেই রয়ে যান। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলার সম্পাদক ছিলেন তখন। ১৯৫২ সালে নিরঞ্জন গুপ্তও কলকাতায় চলে যান এবং পার্টির কাজে ব্যাস্ত হয়ে যান। জীবনের তাগিদে তখন নিরুপমা গুপ্তকে চাকরি করতে হয়, একটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। চাকরি করতে করতে তিনি বিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন এবং ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট বি এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। বিএ পাস করার পরে একটি মাধ্যমিক স্কুলে চাকরি শুরু করেন তিনি। ১৯৬০ সালে তিনি পি টি পাস করেন। ১৯৬১ সালে ইতিহাসে অনার্স এবং ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। চাকরির কারণে সব পরীক্ষায় তাকে প্রাইভেটে দিতে হয়েছে। ১৯৬৩ সালের জানুয়ারিতে একটি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২৬ বছর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি প্রধান শিক্ষিকার দায?িত্ব পালন করেছেন।
আজীবন সংগ্রামী দৃঢ?চেতা এই মহীয়সী নারী নীতির প্রশ্নে কোনদিন আপোষ করেননি। কুলীন ব্রাহ্মণের কন্যা নিরূপমা গুপ্ত মার্কসীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মানব জাতির মুক্তির লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। এক অব্রাহ্মণ মানব মুক্তির সৈনিককে বিয়ে করে, বিত্তবৈভব ছেড়ে তিনি সাধারণভাবে জীবন যাপনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কারো ওপরে নির্ভরশীল হতে চাননি বলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পড়াশোনা করেছেন এবং ৩৯ বছর বয়সে প্রাইভেটে তিনি এম এ পাস করেছেন। ছোটবেলায় কলকাতায় জ্যাঠা মশায়ের বাড়িতে পরবর্তীকালে মামার বাড়িতে থেকে তিনি একটি কথা প্রায়ই শুনতেন সেটা হল ‘ছেলে সন্তান হচ্ছে সুসন্তান’। তখনই তার মাথায় প্রশ্ন জেগেছিল, তাহলে মেয়েরা কি কুসন্তান? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের এই পার্থক্যটা তিনি পিতা-মাতার কাছ থেকে বুঝতে না পারলেও চাকরি করতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছেন। মেয়েরা যে কোনো কাজ দক্ষতার সাথে শেষ করতে পারে নিরুপম গুপ্ত সেটি প্রমাণ করেছেন যোগ্যতার সাথে। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন প্রতিটি মুহূর্তে একজন নারীকে লড়াই করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতা করতে গিয়ে তিনি শিক্ষক আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৮৪ সালে নিরুপমা গুপ্তের স্বামী নিরঞ্জন গুপ্ত পরলোকগমন করেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা চিকিৎসাশাস্ত্রে শিশু বিশেষজ্ঞ।