শারমীন শরীফ : নমিতা ঘোষ মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্বাধীন বাংলা বেতাঁরকেন্দ্রে প্রথম নারী শিল্পী হিসেবে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করেছেন। নমিতাঁর মা যশোদা ঘোষ সে সময় রেডিওতে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করতেন।
কিছু কিছু স্মৃতি আছে যা মনের মনিকোঠায় চিরদিন অম্লান হয়ে থাকে। শিল্পী নমিতা ঘোষের জীবনেও তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল। ১৯৬৯ সালের কোন এক সময় একটি ঘরোয়া আসরে গান গাইতে গিয়েছিলেন শিল্পী। সাথে নিত্যসঙ্গী মা যশোদা ঘোষ। তৎকালীন স্টেট ব্যাংকের কোন এক বড়কর্তার বাড়ির ড্রয়িং রুমে আয়োজন করা হয়েছিল সংগীতের আসরটি। সীমিত সংখ্যক বিশিষ্ট অতিথি ছিলেন সে সন্ধ্যায় এবং অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

রাজনীতি বছর বয়স তখনো হয়নি নমিতা ঘোষের। তিনি কাগজে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখতেন, তাঁর সম্বন্ধে নানা খবর পড়তেন। মুজিবুর রহমান কে এত কাছ থেকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন সবাই। আনোয়ার উদ্দিন খান, অজিত রায় এবং নমিতা ঘোষ ছিলেন সেদিনের সন্ধান শিল্পী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আনোয়ার উদ্দিন খান তাঁর সুরেলা কন্ঠে একটি আধুনিক গান পরিবেশন করেছিলেন এবং এর পরেই অজিত রায় গান গেয়েছিলেন।

গান শেষে শেখ মুজিব অজিত রায় কে বলেছিলেন একটি কীর্তন গেয়ে শোনানোর জন্য কিন্তু অজিত রায় ছিলেন মূলত রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পী। অজিত রায়ের চোখ পড়েছিল নমিতা ঘোষের উপরে অতএব তিনি নমিতাকে ডেকে বললেন শেখ মুজিবকে কীর্তন গেয়ে শোনাবার জন্য।

ফ্রক করা ছোট্ট নমিতা সেদিন এগিয়ে এসেছিল। শেখ মুজিব এত ছোট নমিতাকে দেখে অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘এই মেয়ে তুমি কীর্তন গাইতে পারবা?’ নমিতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিলেন সে পারবে। এরপর নমিতা শুরু করেছিলেন কীর্তন, ‘আমি তোমায় নিয়ে বৃন্দাবনে’। বঙ্গবন্ধু সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন, জানতে চেয়েছিলেন নমিতা রবীন্দ্র সংগীত নজরুল গীতি গাইতে পারে কিনা। নমিতা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এর পরে নমিতাকে বলেছিলেন রবীন্দ্র সংগীত গাইবার জন্য, এবং নমিতা গিয়েছিলেন, ‘প্রমোদে ঢালিয়া দিন মন’। বঙ্গবন্ধু খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন নমিতাঁর নাম, সে কোথায় থাকে? বঙ্গবন্ধু সেদিন খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘এই তোমাকে বলে রাখছি, যদি এই দেশের শাসনভার পাই, তাহলে রেডিওতে, টিভিতে কীর্তন ও রবীন্দ্র সংগীত চালু করব।’ এই কথাগুলো সেদিন নমিতাঁর জন্য আশীর্বাদের মতো ছিল। তখন নমিতাঁর বয়স ছিল মাত্র ১০।

বৃহত্তর ঢাকা জেলার মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে নমিতা ঘোষের পৈত্রিক নিবাস। ১৯৫৯ সালের ১১ই ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকায় নমিতা ঘোষের জন্ম। বাবা হরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষ ছিলেন ব্যবসায়ী।মা যশোদা ঘোষ ছিলেন গৃহিণী কিন্তু গান বাজনার প্রতি মায়ের ছিল প্রচন্ড আগ্রহ। নমিতা ঘোষ ছিলেন তাদের পঞ্চম সন্তান। বাংলাবাজার গার্লস হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেছিলেন। নমিতাঁর জীবনের বড় অংশ জুড়ে ছিল রাজনীতি ও সংস্কৃতি।

মা যশোদা ঘোষ নজরুল গীতি রবীন্দ্র সংগীত ও শ্যামা সংগীত ভালো গাইতে পারতেন। তিনি বড় মেয়েকে গান শেখাতেন সাথে সাথে ছোট্ট নমিতাকেও গানের তালিম দিতে শুরু করেছিলেন। বাবা হরেন্দ্র চন্দ্র ঘোষও তাদের উৎসাহ দিতেন। বিভিন্ন সময় ওস্তাদ মুন্সি রইছ উদ্দিন, বারীণ মজুমদার, পি সি গোমেজ, বেদার উদ্দিন আহমেদ, লুৎফুর রহমান, মফিজুল ইসলাম, গৌরাঙ্গ ব্যানার্জি ও জাহিদুর রহিম এর কাছে তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীত নজরুল গীতি ও রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন।

নমিতা ঘোষ

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কালোরাত্রিতে বাঙালির জীবনে যখন চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল তখন নমিতারা ঢাকার শঁখারী বাজারের বাসায় থাকতেন। ২৭ শে মার্চ কারফিউল শিথিল হলে সকাল দশটার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে লাশের উপর দিয়ে হেঁটে তারা সবাই সদরঘাটে গিয়েছিলেন। ঘাটে গিয়ে তারা নৌকা পেয়েছিলেন কিন্তু কোন মাঝি ছিল না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে এক মাঝিকে পেয়ে তারা সবাই নৌকায় ওঠেন, সাথে সাথে অনেক মানুষ দৌঁড়ে নৌকায় উঠলে নৌকো কাত হয়ে গিয়েছিল এবং নমিতা নদীতে পড়ে গিয়েছিলেন। নমিতাঁর পরিবারের কেউ সাঁতাঁর জানতো না বলে নদীতে না ঝাপিয়ে সবাই চিৎকার করছিল। তখন ১৫-১৬ বছরের দুটি ছেলে নদীতে ঝাঁপিয়ে নমিতাকে টেনে নৌকায় তুলতে সক্ষম হয়েছিল। নৌকা কিছুদুর যাবার পর সদরঘাট টার্মিনাল থেকে পাকহানাদার বাহিনীর একদল সদস্য ডাক দিয়েছিল, ‘ইধার আও, নেহি তো গলি মার দেগা’। নমিতাঁর বাবা হতবিহŸল হয়ে বুঝতে পারছিলেন না কি করবেন, সাহস বুকে নিয়ে মাঝিকে দ্রæত ওপারে জিনজিরার দিকে দ্রæত বেঁয়ে যেতে বলেন। গ্রামে কিছুদিন থাকবার পর পুনরায় মিলিটারীদের ধাওয়া খেয়ে ১৬ই এপ্রিল অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে আগরতলা রাজবাড়ির শরণার্থী ক্যাম্পে পৌঁছান।

সেখানে কংগ্রেস নেতা প্রিয়দাস চক্রবর্তী আসেন। নমিতাঁর পরিচয় পেয়ে তিনি নরসিঙ্গের পলিটেকনিক্যাল হোস্টেলে থাকবার ব্যবস্থা করে দেন। পলিটেকনিক হোস্টেলে কয়েকটি বিশিষ্ট পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল তখন। তাঁরা ছিলেন প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, মীর শওকত আলি, মুক্তিযোদ্ধা খসরু, শিল্পী রিনি, রেজা ও শম্পা রেজা প্রমুখ।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালী তিনি স্বাধীন বাংলা বেতাঁর কেন্দ্রের প্রথম মহিলা শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী নমিতা সারা জীবন বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় থেকেছেন।

১৯৭১ সালে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশের শিল্পীদের সাথে তাঁর দেখা হয়। এরপর কলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতাঁর কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন। সাবেক ক্যাবিনেট সেক্রেটারি জনাব তৌফিক ইমামের সহযোগিতায় ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষ দিকে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতাঁর কেন্দ্রে কণ্ঠ দিতে শুরু করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী মরহুম তাজ উদ্দিন আহমেদের নির্দেশে তিনি আরও বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে জাগরণী গান গাইতেন। পরে ব্যারিস্টার বাদল রশিদের নেতৃত্বে দিলীপ সোমের গীতি আলেখ্য নিয়ে ১৪ সদস্যের একটি দলের সদস্য হিসেবে দিল্লী, বোম্বে, গোয়া, পুনা, কানপুর বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, কম্বল, ওষুধ সামগ্রী সংগ্রহ করতেন। এ সমস্ত অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন বোম্বের বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমান সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সবিতা চৌধুরী ও বিশিষ্ট সাংবাদিক সলিল ঘোষ।

নমিতা ঘোষ মুক্তিযোদ্ধা সংসদে সাংস্কৃতিক বিভাগে সহ-সভানেত্রী পদে দায?িত্ব পালন করেছেন একসময়। এছাড়াও তিনি বেতাঁর ও টেলিভিশনে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করেছেন এবং সেই সাথে গানের স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।

২০২১ সালের ১৯শে মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে নমিতা ঘোষ পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর।