শারমীন শরীফ : তারাভানু ওরফে তারামন বিবি, বৃহত্তর রংপুরের কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর থানার শংকর মাধবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তারামন তার জন্মের তারিখ বা সাল বলতে পারেন না, এমনকি তার মাও ভুলে গিয়েছেন তারামনের জন্ম সন তারিখ, তবে এটুকু মনে আছে অগ্রহায়ণ মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তারামন বিবি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তারামন বিবির আনুমানিক বয়স ছিল ১৪-১৬ বছর, দেশের প্রয়োজনের কাছে এই বয়স কোন ব্যাপার ছিল না তারামন বিবির কাছে, আর তাই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন একটি সময় এই মেয়েটি গ্রহণ করেছিল একটি অনন্যসাধারণ ভূমিকা।

বাবা আব্দুল সোবহানের পেশা ছিল কৃষিকাজ, তবে মাঝে মাঝে কবিরাজী ও ঝাড়-ফুঁকও করতেন। মা কুলসুম বেগম অন্যদের বাড়িতে পেটে-ভাতে কাজ করতেন এবং কাজ শেষে খাবার নিজে না খেয়ে বাড়িতে নিয়ে আসতেন সন্তানদের জন্য। যুদ্ধের ৫-৬ মাস আগে বাবা আব্দুস সোবাহান খন্দকার য²া রোগে বিনা চিকিৎসা মৃত্যুবরণ করেন। মা কুলসুম বিবি ছয় সন্তান নিয়ে যখন দিশেহারা ঠিক তখনই শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। ছয় ভাইবোনদের মধ্যে তারামন বিবি ছিলেন তৃতীয়, ভাইগুলি সব ছোট ছিল, তাই বোনদের উপরে দায়িত্ব পড়ে খাদ্য যোগানের আর এই দায়িত্ব তারামন পালন করতেন ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে।

মে মাসের দিকে পাকহানাদের বাহিনী যখন শহর থেকে গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন তারামনের মা কুলসুম বিবি প্রাণের ভয়ে সন্তানদের নিয়ে সুনাভরি নদী পূর্ববর্তী চর রাজিবপুর গ্রামে তার ভাই কালুমোহন শেখের বাড়িতে আশ্রয় নেন। রাজিবপুরে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প।
মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন। তাঁর কমেন্ডিং-এ তদানীন্তন রৌমারী ও চিলমারী থানা এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিগেড়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছিল। যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে মুক্তিযোদ্ধার দলটিকে দু ভাগে বিভক্ত করে একাংশকে রৌমারী এবং অপরাংশকে রাজীবপুর পাঠান। রাজিবপুরের দুই নম্বর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন হাবিলদার মুহিব। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে রাজিবপুরে একটি ট্রেনিং সাব-সেক্টরও গঠন করেন। এখানে এলাকার যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।

তারামন বিবি

মে মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধা আজিজ মাস্টারের বাড়িতে তারামনের সাথে হাবিলদার মুহিবের সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি তারামন বিবিকে ক্যাম্পে রান্না করার প্রস্তাব দেন। প্রথমে তারামনের মা কুলসুম বিবি কিছুতেই মানতে পারছিলেন না কিন্তু কালু শেখ ও আজিজ মাস্টারের অনুরোধে তিনি রাজি হয়ে যান। তারামন বিবি পুরো প্লাটুনের যাবতীয় রান্নার কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও তারামনের পিতৃ প্রদত্ত নাম ছিল তারাভানু কিন্তু মুহিব হাবিলদার তাকে তারামন বলে ডাকতেন ফলে ক্যাম্পে তার নাম হয়ে যায় তারামন বিবি। কমান্ডার মুহিবের কাছে তারামন বিবি ছিলেন কন্যাসম, তারামন বিবি প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করতেন মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে নাড়াচাড়া, খোলা, জোড়া লাগানো, অপারেশনে যাওয়া-আসা এবং যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা দেখতে দেখতে তারা মনের হৃদয় মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা অঙ্কুরিত হয়। একদিন তিনি অস্ত্র চালনা শিক্ষা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং কমান্ডর মুহিব তারা মনের ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিয়ে ধীরে ধীরে অস্ত্র চালনায় শিক্ষিত করে তোলেন। থ্রী নট থ্রি, এস. এম. জি, এস. এল. আরসহ বিভিন্ন অস্ত্রের সাথে একে একে তারা মনের পরিচয় ঘটে। অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তারামন কয়েকটি যুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ করেছেন, তার মধ্যে ১৯৭১ সালের ৭ই আগস্ট চর নেয়াজি স্কুলের নিকট পাক হানাদার এর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি যুদ্ধে তিনি সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেন। বিকেল তিনটা থেকে ভোর চারটা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে, এই গেরিলা যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধার শহীদ হন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তেরোজন পাকহানাদার ও রাজাকারের মৃত্যু ঘটে। আর এর প্রতিশোধ নিতে হানাদারেরা শংকর মাধবপুর ভেলামারি গ্রামের প্রায় ৫০ জন নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।

একবার সম্মুখ যুদ্ধের ঘটনা। মধ্য দুপুরে সবাই খেতে বসেছে তখন, কেবল তারাবানু খেয়ে দেয়ে চারপাশে নজর রাখছেন। এমন সময় তারামন সুপারি গাছের উপরে উঠে দৃষ্টি রাখছেন। হঠাৎ দেখলেন পাকিস্তানিদের একটি গানবোট দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে জানালেন কমান্ডারকে। সবার খাওয়া চলছে তখন। খাওয়া ছেড়ে সবাই নিজ নিজ অবস্থান নিয়ে নিলেন মুহূর্তের মধ্যেই। সন্ধ্যা পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধ চলেছিল সেদিন। তারাবানু না দেখলে মুক্তিযোদ্ধারা সেদিন মাটির সঙ্গে মিশে যেত।

সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও গুপ্তচর সেজে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ঢুকে তথ্য নিয়ে আসতেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তারাবানু দারুণ অভিনয় করতে পারতেন চোখের পলকেই। কখনো এমন হয়েছে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ঢুকেছেন মাথায় চুলে জট লাগানো পাগলের বেশে, কখনো সারা শরীরে কাদা লাগিয়ে, কখনো পঙ্গুর অভিনয় করে পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে ঢুকে শুনতেন নানান গোপন তথ্য, ক্যাম্পের সবাই মনে করতো পাগল নয়তো মাথায় ছিটগ্রস্ত। বিভিন্ন অপারেশনের আগে কলার ভেলায় করে তারামন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের রসদ, অস্ত্র গোলাবারুদ পৌঁছে দিয়েছেন জায়গা মতো। মোহনগঞ্জ, তারাবর কোদালকাটি, গাইবান্ধার ফুলছড়ির বহু বিখ্যাত যুদ্ধে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তারামন বিবি। কেবল এই দুটো অপারেশনই নয়। মোহনগঞ্জ, তারাবর কোদালকাটি, গাইবান্ধার ফুলছড়ির বহু বিখ্যাত যুদ্ধে পুরুষ সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তারামন বিবি।

বীর প্রতীক তারামন বিবি কয়েকবার বিয়ের পিড়িতে আসীন হয়েছেন কিন্তু সংসার তাদের দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে তারা মনের প্রথম বিয়ে হয় দশঘড়িয়া পাড়ার মেসের আলীর সাথে সে বিয়ে ছয় মাসও স্থায়ী হয়নি। যুদ্ধের পরে তারামন বিবির দ্বিতীয় বিয়ে হয় তারাবরের বলে আব্দুল হামিদের সাথে, এই বিয়ে তিন/চার মাস স্থায়ী ছিল। তৃতীয় বিয়ে হয় শংকর মাধবপুরের আব্দুল মজিদের সাথে। আব্দুল মজিদ নিরীহ একজন দিনমজুর ছিলেন, তিনি জানতেন না যে তাঁর স্ত্রী একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারামন বিবি এই সংসার টিকে যায় এবং এই ঘরে তার দুটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। অভাব অনটনের কারণে তারামন বিবির সন্তানদের শিক্ষা জোটেনি বরং পেটের তাগিদে তারা অন্যের বাড়িতে কাজ করতো।
স্বাধীন বাংলাদেশ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন, ২০০ বছর ব্রিটিশদের শাসন তারপরে ২৫ বছর পাকিস্থানী শোষকদের বন্ধন ছিন্ন করতে লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী-পুরুষের আত্মৎস্বর্গের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের এই দেশ, এই স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধু সরকার অসীম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করেন যার সিংহভাগ ছিল প্রাক্তন সৈনিক এবং পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র দুজন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে বীর প্রতীক হিসেবে ভূষিত করা হয়, তাঁঁদের একজন আর্মি মেডিকেল কোর থেকে অংশগ্রহণকারী ক্যাপ্টেন ডক্টর সেতারা বেগম এবং অন্যজন অজপাড়াগাঁয়ের অখ্যাত এক দিনমজুর তারাভানু ওরফে তারামন বিবি। তারামন বিবি জানতেন না যে তিনি এত বড় খেতাবে ভূষিত হয়েছেন এবং শুধু ওই পর্যন্তই এরপরে কেউ এই অখ্যাত সাধারণ বীর মুক্তিযোদ্ধার খবর নেয়নি।
২৪ বছর পর ১৯৯৫ সালে ময়মনসিংহের অধ্যাপক বিমল কান্তি দের ব্যক্তিগত অনুসন্ধান, উদ্যোগ ও পরিশ্রমের ফলে তারামন বিবি নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হন। সেই সময় তাঁকে নিয়ে পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়। অবশেষে ১৯৯৫ সালের ১৯শে ডিসেম্বর এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আনুষ্ঠানিক ভাবে তারামন বিবিকে বীরত্বের পুরস্কার তাঁর হাতে তুলে দেয়া হয়। খালেদা জিয়া সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং সামরিক হাসপাতালে তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তত্ত¡াবধায়ক সরকার নগদ ৫০,০০০ টাকা প্রদান করেন, এছাড়াও ভোরের কাগজ পক্ষ থেকে ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।

২০১৮ সালের ১লা ডিসেম্বর সবাইকে ছেড়ে যান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী নারী মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীর প্রতীক। তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়া তালতলা কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। তারামন বিবির মত অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যারা আজও পায়নি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি, এই সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তারামন বিবি সহ সকল বীর নারী-পুরুষ কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।