শারমীন শরীফ : জাহানারা ইমাম ওরফে জুড়ু ১৯২৯ সালের ৩রা মে মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সৈয়দ আব্দুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মনে প্রানে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক একজন মানুষ। মা সৈয়দ হামিদা বেগম ছিলেন গৃহিণী। সেকালের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় মুসলমান মেয়েদের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত ছিল না, তাঁর দাদার বিশ্বাস ছিল যে মেয়েদের বাংলা লেখাপড়া শেখানো রীতিমত গুনাহের কাজ। আর সে কারণেই তাদের বাড়ির মেয়েদের কেবল কোরআন শরীফ পড়া শেখানো হতো। খুব গোপনে তাঁর বাবা তাঁর মাকে বাংলা পড়া ও লেখা শিখিয়েছিলেন কিন্তু উচ্চশিক্ষার বেলায় তিনি খুব একটা সার্থক হননি। স্ত্রীকে সফলভাবে শিক্ষিত করে তুলতে না পারলেও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় নিজের চারটি মেয়েকে রীতিমতোই শিক্ষিত করে তুলেছিলেন সমস্ত পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিক‚লতাকে উপেক্ষা করে।
বাবার ছিল বদলির চাকরি। বাবার চাকরির সূত্রে তাঁর শৈশব কাটে কুড়িগ্রামে। ছোটবেলায় পড়াশুনার ব্যাপারে জাহানারা ঈমান ছিলেন একেবারেই উদাসীন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার পর এক পর্যায়ে অস্থির মতি জাহানারা ইমাম ঠিক করেন তিনি আর পড়ালেখা করবেন না। কিন্তু বাবার পুরনো বন্ধু মটকা চাচার কাছে মতিলাল নেহেরুর কন্যা পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর ভাগ্নি বিজয় লক্ষী পন্ডিতের কথা শুনে এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত স্টেটমেন্ট পত্রিকায় আধুনিক পোশাকে সজ্জিত শ্রীমতি বিজয় ল²ী পন্ডিতের ছবি দেখে তিনি তাঁর মত পাল্টান। কিশোরী জাহানারা ইমামের জীবনে প্রেরণার উৎস হন বিজয়ল²ী। ষষ্ঠ শ্রেণি শেষ করে জাহানারা ইমাম আসেন কুড়িগ্রামে, বাবার কর্মস্থলে। কুড়িগ্রামে মেয়েদের জন্য পড়াশোনার কোনো আলাদা ব্যবস্থা ছিল না ফলে ছেলেদের স্কুলের রেজিস্টার খাতায় তাঁর নাম লেখানো হলো এবং সিদ্ধান্ত হল সময়মতো সে পরীক্ষা দেবে কিন্তু স্কুলে আসতে পারবে না। তাঁর পড়াশুনার জন্য বাড়িতে দুজন গৃহ শিক্ষক রাখা হয় যারা দুবেলা এসে তাঁকে পরিয়ে যেত।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে জড়ুর সাথী হয় বই। বাবার কাছে বাড়িতে নিয়মিত পত্রপত্রিকা আসতো সে সময় তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দৈনিক আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, আজাদ, সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া, মাসিক ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বসুমতি, আর মোহাম্মদী। বাড়িতে ছিল কলের গান ও বাদ্যযন্ত্র। অবসরে রেকর্ডের আঙ্গুর বালা, ইন্দুবালা, হরিমতি, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, কমলা ঝরিয়া, আব্বাস উদ্দিন আহমেদ, কনক দাস, শাহানা দেবী, যুথিকা রায় হয়ে উঠলেন জুড়ুর বিনোদনের সঙ্গী।
পাশাপাশি মটকা চাচার সহায়তায় তিনি এমন সব বইয়ের সান্নিধ্যে এসেছেন যেগুলো তাঁর মেধা ও মননের জগতকে আলোকিত করেছে। ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম, নারী শিক্ষা আন্দোল্ন মুসলিম সমাজ জাগরণের প্রচেষ্টা, বেগম রোকেয়ার সাধনা – এসব বিষয়ের উপর রচিত বইগুলো মটকা চাচা নিয়ে আসতেন জুড়ুর জন্য। ইংরেজি বাংলা অংক ভূগোল আর ইতিহাসের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য এবং বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে জুড়ুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন গৃহ শিক্ষক অসীম মজুমদার। জুড়ুর আরেক গৃহ শিক্ষক রবিন বন্দ্যোপাধ্যায় তিনিও ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। এই দুই গৃহ শিক্ষকের সহায়তায় একে একে তিনি পরিচিত হন টলস্টয়, দস্তায়েভস্কি, ভিক্টর হুগো, সেলমা লেগারলফ, শেক্সপিয়ার, বার্নার্ড শ, ন্যুট হামসুন প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মের সাথে। জুড়ুর স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবেন এবং সব ব্যবস্থাপনা অনেকটা শেষ হয়েও এসেছিল কিন্তু ১৯৪১ সালের ৯ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের খবর পত্রিকায় পড়ার পর তাঁর শান্তিনিকেতনে পড়ার পরিকল্পনার সম্পূর্ণ ভেস্তে যায়।
এ সময় কুড়িগ্রাম থেকে বদলি হয়ে জুড়ুরা চলে আসেন লালমনিরহাটে এবং সেখানে এসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত হন। লালমনিরহাটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার সেন্টার ছিল না বলে তিনি পরীক্ষা দেন রংপুর থেকে। রংপুরে নামজাদা উকিল আজিজুল ইসলামের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন। ১৯৪২ সালের দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাস করে তিনি ভর্তি হন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে। ১৯৪৪ সালে ওই কলেজ থেকেই তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতাঁর লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে তিনি বিয়ে পাস করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ফুল ব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় যান এবং সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রী লাভ করেন। দেশে ফিরে এসে ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এম এ পাস করেন।
রংপুরে থাকাকালীন উকিল আজিজুল ইসলামের বাড়ির উল্টো দিকের বাড়িটি ছিল মৌলভী মোঃ আলী উকিলের এবং মোহাম্মদ আলী উকিলের কনিষ্ঠ ছেলে শরীফ। এই শরিফের সঙ্গে জুড়ুর পরিচয় হয় এবং সেই পরিচয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা পায়। সে সময় তরুণ-তরুণীর প্রেম ব্যাপারটি এখনকার মত এতটা সহজ স্বাভাবিকভাবে দেখা হতো না। বিষয়টি উভয় পরিবারে আলাপ আলোচনার পর পারিবারিকভাবে স্বীকৃতি পায়। শরিফ ইমাম তখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৪৮ সালের ৯ই আগস্ট শরিফুল আলম ইমাম আহমেদের সঙ্গে জাহানারা ইমামের বিয়ের সম্পন্ন হয়।
জাহানারা ইমামের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী গার্লস স্কুল, ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, বুলবুল ললিত কলা একাডেমী শিশু স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেন টানা ১৪ বছর। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল এই দুই বছর ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যাপনা করেন।
ষাটের দশকে জাহানারে ইমাম লেখালেখির জগতে আসেন এবং তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু হয় শিশু সাহিত্যিক হিসেবে। ছোটদের জন্য খুব প্রয়োজনীয় কয়েকটি বই তিনি অনুবাদ করেন যেগুলো পাঠক সামাদৃত হয়। তবে ‘একাত্তরের দিনগুলি’ রচনা করে তিনি পৌঁছে যান জনপ্রিয়তা শীর্ষে। জাহানারা ইমামের লেখা বই গুলোর মধ্যে ‘তেপান্তরের ছোট্ট শহর’ (১৯৬৪), ‘নদীর তীরে ফুলের মেলা’ (১৯৬৬) ‘সাতটি তাঁরার ঝিকিমিকি’ (রূপকথা ১৯৬৭) ‘নগরী’ (দা টাউনের অনুবাদ ১৯৬৮) ‘গজ-কচ্ছপ’ (১৯৬৮) ‘বিদেশীদের বাংলা শেখার বই’ (অ্যান ইন্সট্রাকশন টু বেঙ্গলি’ (১৯৮৩) ‘অন্য জীবন’ (১৯৮৫) ‘বীর শ্রেষ্ঠ’ (১৯৮৫) ‘একাত্তরের দিনগুলো’ (১৯৮৬) ‘জীবন মৃত্যু’ (১৯৬৮) ‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ (একাত্তরের দিনগুলির কিশোর সংস্করণ ১৯৮৮) ‘চিরায়ত সাহিত্য’ (শেক্সপিয়ার ট্রাজেডির কিশোর সংস্করণ ১৯৯০) ‘দুই মেরু’ (১৯৯০) ‘নিঃসঙ্গ আইন’ (১৯৯০) ‘নয় এ মধুর খেলা’ (১৯৯০) ‘ক্যান্সারের সাথে বসবাস’ (১৯৯১) ‘অফ বøাড অ্যান্ড ফায়ার’ (একাত্তরের দিনগুলির ইংরেজি অনুবাদ ১৯৯০), ‘প্রবাসের দিনলিপি’ (১৯৯২) উল্লেখযোগ্য।
সংসার জীবন এবং লেখক জীবনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জাহানারা ইমাম নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। সাংবাদিকতার সঙ্গেও তিনি যুক্ত হন। দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলায় এবং সাহিত্য বিচিত্রায় তিনি টিভি সমালোচনা লিখেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে অর্থাৎ পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রায়শঃই তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, উপস্থাপনা করেছেন। ১৯৭১ সালের আগে একজন সফল টেলিভিশন উপস্থাপিকা হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে জাহানারা ইমাম আর আগ্রহ বোধ করেননি। (ক্রমশ)