শারমীন শরীফ : ১৯০৫ সালে বরিশাল শহরে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা পুলিশ অফিসার রাজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়; মাতা ল²ীসুন্দরী। বরিশাল শহরের কাউনিয়া ব্র্যাঞ্চ রোডে ছিল বাবা রাজেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি। গৃহিনী ল²ীসুন্দরী দেবীর চার সন্তানের মধ্যে চারুবালা ছিলেন জ্যেষ্ঠ।
নারীনেত্রী ও সমাজকর্মী চারুবালা গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন মনোরমা মাসিমার সহযোদ্ধা। একান্ত কাছের মানুষ হিসেবে যার নাম সর্বাধিক উচ্চারিত তিনিই চারুবালা গঙ্গোপাধ্যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার সুযোগ পাননি তিনি। ১৯২৪ সালে মনোরমা বসু সপরিবারে বরিশাল শহরের কাউনিয়া রোডে স্থায়ীভাবে বসবাস করলে চারুবালার সঙ্গে প্রতিবেশী হিসেবে প্রথম পরিচয় ঘটে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনবোধ ও কার্যক্রম চারুকলাকে উদ্বুদ্ধ করে। মনোরমা বসু ১৯২৫ সালের যে কয়েকজন নারীকে নিয়ে মহিলা সমিতি গঠন করেন চারুবালা গঙ্গোপাধ্যায় তাদের মধ্যে অন্যতম। মহিলা সমিতির হয়ে চারুবালা গঙ্গোপাধ্যায় চাঁদা তুলতেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টি ভিক্ষা করতেন, ঠিক এই সময় তিনি কংগ্রেসের যোগ দেন এবং বিভিন্ন মিছিল-মিটিং এর অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে নেত্রী স্থানীয় পুরুষেরা গ্রেফতার হন। তখন পুলিশের আপত্তি সত্তে¡ও তিনি মনোরমা বসুর নেতৃত্বে ৩রা ফেব্রুয়ারির হরতালের প্রচার করতে বের হন। এর ক’দিন পরে মনোরমা বসু গ্রেফতার হলে চারুবালাই সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে নেন।
আইন অমান্য আন্দোলনের শাস্তির মেয়াদ শেষে, মনোরমা বসু ১৯৩২ সালে নিজের বাড়িতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে চারুবালা গঙ্গোপাধ্যায় সর্বাধিক সহযোগিতা করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী ও স্কুল চালানোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করাসহ তিনি শিক্ষয়িত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত হন। ১৯৩৩-৩৪ সালে মনোরমা বসুর উদ্যোগে মাতৃমন্দিরে সমাজের পরিত্যক্ত মেয়েদের জন্য অনাথ আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলেন। তিনি আশ্রয় কেন্দ্রে অনাথ মেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্বের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন।
এই এক নিষ্ঠ নারী ১৯৪৩ সালে কালেক্টরিতে চাকরিরত ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ ও মহামারী শুরু হলে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। তখন খাদ্য ও বস্ত্রের দাবিতে মিছিলে অংশ নেন এবং লঙ্গরখানায় কাজ করেন। লঙ্গরখানা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য চাঁদা ও ওষুধপত্র সংগ্রহ করেন।
এ সময় দুর্ভিক্ষ ও মহামারের কারণে আশ্রয়চ্যুত মেয়েদের জন্য গঠিত নারী কল্যাণ সমিতিতে কাজ করেন। তিনি মনোরমা বসুর সঙ্গে গ্রামে গ্রামে গিয়ে গৃহবধূদের সংগঠিত করেন এবং বরিশাল জেলা ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৪৩ সালে গর্ভবতী অবস্থায়ও তিনি তার কর্মকান্ড থেকে বিরত হননি। ১৯৪৪ সালে অক্টোবরে তার প্রথম কন্যার জন্ম হয়। ১৯৪৭ সালে তিনি সাম্যবাদের মন্ত্রের দীক্ষিত হন এবং মনোরমা বসু যে সময়গুলোতে কারারুদ্ধ ছিলেন তখন চারুবালা গঙ্গোপাধ্যায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করতেন এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতেন। এ কারণে তিনি তখন প্রায়ই পুলিশি হয়রানির শিকার ও প্রতিক্রিয়াশীলদের হুমকির মুখোমুখি হতেন কিন্তু দমে যানিনি তাতে।
১৯৫১ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে বরিশালে অনুষ্ঠিত মিছিল থেকে চারুবালা গ্রেপ্তার হন এবং কয়েকদিন পরে ছাড়া পান। ১৯৬৯ এর গণআন্দোলনেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। এ সময় মহিলা পরিষদ গঠনের কাজেও অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বরিশাল সদর গার্লস স্কুলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্রীদের যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাতে তিনি সাধ্যমত সহযোগিতা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের রাতে তিনি বরিশালের ছিলেন এবং ঢাকার গণহত্যার খবর শুনে বরিশালে মুক্তিবাহিনী গঠনের কাজের ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী বরিশাল আক্রমণ করলে বরিশাল ত্যাগ করে ঝালকাঠিতে আত্মগোপন করে থাকেন এবং নভেম্বর মাসে বরিশাল ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে আবার মাতৃ মন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয় পুনর্গঠনের কাজে নামেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র হয়ে নারীদের সংগঠিত করতে থাকেন।
চারুবালা নিজের একমাত্র ছেলে ও একমাত্র মেয়েকে নিজ আদর্শে গড়ে তোলেন। তারা সাম্যবাদের আন্দোলনে সামিল হয়েছে মায়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে। চারুবালা গঙ্গোপাধ্যায় যতদিন কর্মক্ষম ছিলেন নারী মুক্তির আন্দোলনে তিনি ছিলেন প্রথম কাতারে। ১৯৯৯ সালের ২২ শে জুন নারায়ণগঞ্জে পুত্রগৃহে ৯৪ বছর বয়সে এই সংগ্রামী নারী মৃত্যুবরণ করেন।