শারমীন শরীফ : ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতই ছিল গণসাধারণের যুদ্ধ। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও যুদ্ধ করেছেন সমানভাবে। ২৫ শে মার্চের সেই ভয়ংকর রাতের পরে পাক বাহিনী যখন বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে, নির্দ্বিধায় গুলি করে মারতে শুরু করে নারী পুরুষ শিশু, লাঞ্ছিত করতে শুরু করে মা-বোনদের, নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে পুরো বাংলাদেশের তখন মুক্তিযোদ্ধারা এবং গ্রামে গঞ্জে প্রতিবাদী জনতা প্রতিহত করতে শুরু করে পাক সেনাদের আক্রমণ এবং অত্যাচার। নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতাঁর ঘটনা ঘটেছে বাছবিচারহীনভাবে। নারীরা ধর্ষণের শিকার বা অত্যাচারিত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটা যেমন সত্য, তাঁর চেয়েও বড় সত্য এই যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নারীসমাজ লড়াই করেছে, দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছে, রক্ষা করেছে।
গীতা মজুমদার ১৯৫৫ সালের ২ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার গোয়ালচামোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অজিত মজুমদার পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন এবং মা ছিলেন গৃহিণী। চার বোন পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে গীতা মজুমদার ছিলেন দ্বিতীয়।
১৯৭২ সালে ঈশান গার্লস স্কুল ফরিদপুর থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৬ সালে সারদা সুন্দরী কলেজ ফরিদপুর থেকে এইচএসসি পাস এবং ১৯৯২ সালে তিনি ইডেন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এইচ এস সি পাস করার পর পরই ১৯৭৭ সালের ১৭ই জানুয়ারি তরুণ চক্রবর্তীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। গীতা মজুমদারের স্বামী ছিলেন একজন চাকরিজীবী।
স্কুলে পড়াকালে তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখেন তিনি। ৭১-এ তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। যুদ্ধের সময় তিনি দুই নং সেক্টরে কাজ করেছেন, সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল ওসমানী। দেশের প্রতি ভালোবাসা এবং কর্তব্য পরায়ণতাঁর কারণে গীতা মজুমদার স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
১৯৭১ সালের এপ্রিলে যখন পাক সেনাদের আগমন সংবাদ পেয়ে লোকজন দলে দলে ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিল তখন তাঁর মা-বাবা ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাবার। একজন মুসলিম লোক তাদের জমিজমা দেখাশুনা করতেন, তাঁর সহায়তায় যেটা মজুমদার ও তাঁর পুরো পরিবার ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কলকাতায় পালিয়ে গেলেও গীতা মজুমদারের মন পড়েছিল বাংলাদেশে, কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা যায় সেই চিন্তায় তিনি সারাক্ষণ আচ্ছন্ন থাকতেন। কলকাতায় এসে গীতা মজুমদার তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদীর সাথে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তাকে গোবরা ক্যাম্পের সন্ধান দেন। এই ক্যাম্পের সংবাদ পেয়ে গীতা মজুমদার দ্বিধাহীন ভাবে সেখানে চলে যান। গোবরা ক্যাম্পে তিন মাস প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী সকলকে মুক্তিযুদ্ধে কাজ করবার জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। গীতা মজুমদার তখন চলে যান গুপ্তখালী ক্যাম্পে। সেখানে অবস্থানকালে সংগঠিত একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একদিন একটি ট্রাকে করে ২০ থেকে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যুদ্ধ করতে যাচ্ছিল। অপারেশনে যাওয়ার পথে গুপ্তখালীর কাছেই উল্টে যায় ট্রাকটি এবং একটি গ্রেনেড বিষ্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণে সেদিন অধিকাংশ মুক্তি যোদ্ধারা আহত হয়েছিলেন। তাদের কারো হাত উড়ে গিয়েছিল কারণ পা উড়ে গিয়েছিল, কারো বুক থেকে রক্ত ঝরছিল। এদেরকে যখন চিকিৎসার জন্য গুপ্তখালী ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় তখন গীতা মজুমদার এবং অন্যান্য নারী মুক্তিযোদ্ধারা এসব আহত যোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। হাত নেই, পা নেই। বিদীর্ণ বুক নিয়েও মুক্তিযোদ্ধারা অবিরত আকুতি করে যাচ্ছিল প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাদের আবার ফিল্ডে পাঠাবার জন্য। তাদের তীব্র চিৎকার, ‘ আপা, আমাদের ব্যান্ডেজ করে দেন। আমরা আবার যুদ্ধে যাব, এখনো আমাদের যে শক্তি আছে তা দিয়ে আমরা অন্তত দু’টো পাক সেনা মারতে পারবো। তাঁরপর মরেও শান্তি পাবো এই ভেবে যে অন্তত দুটোকে মেরে মরেছি।’
২ নং সেক্টরে তাঁর সঙ্গী নারী মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন ছায়া, গীতা, ইরা কর, অনিলা, শেফালী, রঞ্জিতা, যুথিকা, অঞ্জলি, শোভা ও বাসনা। এ সময়টাতে তাঁরা সারাক্ষণ প্রতীক্ষা করেছেন কবে দেশ স্বাধীন হবে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাঁর খবর পেয়েছিলেন তারা। অসুস্থ শরীর নিয়েও সমস্ত মুক্তিযোদ্ধারা সবাই হৈ হুল্লায় মেতে উঠেছিল সেই দিন। এই সময় আগরতলার হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন গীতা মজুমদার।
আগরতলা হাসপাতালটি ছিল সম্পূর্ণ বাঁশের তৈরি, উপরে ছিল শনের ছাদ। এমনকি অপারেশন টেবিলটিও ছিল বাঁশের। যখন গুপ্তখালী ক্যাম্পে ছিলেন তখন সে ক্যাম্পেরই একজন তাকে আগরতলা ক্যাম্পের সন্ধান দিয়েছিলেন। সেখান থেকে গীতা মজুমদার আগরতলায় সাজেদা চৌধুরী সাথে যোগাযোগ করলে সাজেদা চৌধুরী তাকে আগরতলা ক্যাম্পে আসবার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
দুই সন্তানের জননী গীতা চৌধুরী এখনো নিজেকে মহিলা মুক্তিযোদ্ধার সংসদ, উবিনীগ নারী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তিনি, স্বপ্ন দেখেন দলমত নির্বিশেষে একই প্লাটফর্মে সকল মুক্তির যোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করবার।
দীর্ঘ সময় পেরিয়ে ইতিহাস বদলাতে শুরু করেছে। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিনজন। ১৯৭২ ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভ‚মিকা সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে সময় লেগেছে তিন দশক।
নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও অসংখ্য। অজানা-অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন বহু নারী নিজের শ্রম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভ‚মিকা সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান গৃহীত হতে সময় লেগেছে তিন দশক। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আজও আমরা পিছিয়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভ‚মিকার সঠিক মূল্যায়ন করা সময়ের দাবি।