শারমীন শরীফ : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করা, অস্ত্র সংরক্ষণ ও বহন করা, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাদান, ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানো, গুপ্তচর বৃত্তির মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ার মতো অনেক কাজ করেছিলেন বাংলাদেশের নারীরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও কর্মরত ছিলেন অনেক নারী।
তারা সবাই-ই ছিলেন আসলে মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নারীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কলকাতার পদ্মপুকুর অঞ্চলে ‘গোবরা ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠা করে।
গোবরা ক্যাম্পে যে কয়জন নারী নিজ উদ্যোগে কাজ করেছেন কৃষ্ণা রহমান তাদেরই একজন। ১৯৫০ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর তিনি খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম তারাপদ দাস বসু, মাতার নাম রিনা দাস বসু। তিনি পিতা মাতার একমাত্র সন্তান।
কৃষ্ণর রহমান ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশে মানুষ হয়েছেন। তার বাবা ও কাকা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। লেখাপড়ার হাতে ঘড়ি মায়ের কাছে হলেও খুলনা পিটিআই স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯৬২ সালে স্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থায় তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ছাত্রী ইউনিয়নের একজন কর্মী হিসেবে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী খান এ সবুরের উস্কানিতে খুলনায় দাঙ্গা সৃষ্টি হয় এবং সেই দাঙ্গায় বহু লোক মারা যায়। ওই সময় তিনি শান্তি মিছিল করেন, গান গেয়ে টাকা তোলেন এবং রুটি বিতরণ করেন। ১৯৬৬ সালে খুলনায় ডায়রিয়া মহামারী আকার ধারণ করলে হাজার হাজার মানুষ মহামারী আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ওই সময় তিনি ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন। এইভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে একপর্যায়ে তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়ে পড়েন এবং পরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৯৭০ এর ভয়াবহ জলোচ্ছ¡াসে খুলনার দুবলার চর ডুবে যাওয়ায় প্রচুর লোক মারা যায়। সেই সময় তিনি সেখানে রিলিফ বিতরণের কাজ করেছেন।
৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে কৃষ্ণা রহমান খুলনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সেই সময়ে তিনি ছিলেন খুলনা জেলার ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা। প্রচুর মিটিং মিছিল করার দায়ে তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হয় কিন্তু তিনি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে কাজকর্ম চালিয়ে যান।
৭০-এর নির্বাচনে খুলনার গ্রামগঞ্জে গিয়েও কাজ করেছেন তিনি। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথেও জড়িত ছিলেন কৃষ্ণা রহমান। সেই সময় একদিকে যেমন ট্রাক মিছিল করেছেন অন্যদিকে গানের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন। কৃষ্ণা রহমান ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার কারণে ১৯৬৮ সালে পাইওনিয়ার স্কুল থেকে তাকে বন্ড সই করতে বলা হয়। শর্ত ছিল যে রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে, কিন্তু তিনি বন্ড সই না করার কারণে ১৯৬৮ সালে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়। অতঃপর তিনি ৬৯ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭২ সালে বয়রা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন এবং ৭৪ সালে খুলনা সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ খুলনা শহরে পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ড শুরু করলে কৃষ্ণা রহমান তার পরিবারের সাথে প্রথমে শ্রীফল থানা হয়ে কারাপাড়ায় যান। কারাপাড়া থেকে চিতলমারী যাওয়ার পথে খরচ খালি গ্রামের মালেক মোল্লার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই সময় চিতলমারিতে বিডিআর পুলিশ এবং সাধারণ জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাবিব বাহিনী নামে একটি মুক্তিবাহিনী গঠন করে। কৃষ্ণা রহমান চিতলমারি পৌঁছলেই ওই হাবিব বাহিনীর লোকজন তার সাথে যোগাযোগ করলে কৃষ্ণা রহমান তাঁদের সাথে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সেখানেই তাদের বাহিনীর সাথে রাজাকার রজব আলি ফকির বাহিনীর সাথে প্রচন্ড লড়াই হয়। পরে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন কমরেড ভবানী সেন। কৃষ্ণা রহমান তাঁর সাথে দেখা করেন এবং তার চিঠি নিয়েই বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নাম লিখেন এবং সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী সাথে যোগাযোগ করেন।
সাজেদা চৌধুরী তখন নারীদের আশ্রয় ও প্রশিক্ষণের জন্য গোবরা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত ছিলেন। জুন মাসে তিনি গোবরা ক্যাম্পে যান এবং তখন থেকেই তিনি কাজ করতে শুরু করেন। গোবরা ক্যাম্পে অবস্থানকালে তিনি তিন ধরনের কাজ করেছেন। প্রথমতঃ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করণ, দ্বিতীয়তঃ নার্সিং প্রশিক্ষণ, নার্সিং প্রশিক্ষণ তিনি নিয়েছেন গোবরা ক্যাম্পে এবং নীলরতন হাসপাতালে এবং তৃতীয়তঃ সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। এই তিন রকমের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন গোবরা ক্যাম্পে সবাই। এছাড়াও তার নিজস্ব দক্ষতা ও যোগ্যতার গুনে তাকে বাড়তে কিছু দায?িত্ব পালন করতে হয়েছে যেমন যে সমস্ত মেয়েরা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিল তাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব ছিল তার ওপরে। এ প্রসঙ্গে তিনি গীতা কর এবং ডাক্তার লায়লার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। এছাড়াও দিনাজপুরের ডলি যার সামনেই তার পিতা-মাতাকে হত্যা করা হয়েছিল।
গোবরা ক্যাম্পে অবস্থানকালে কৃষ্ণা রহমানকে মুজিবনগর সরকারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ৮ নং থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যেতে হতো। ক্যাম্পের ৪০০ জন মেয়ের নিয়মিত বাজার করতে হতো। তখন আব্দুর রাজ্জাক রাফি, আক্তার ডলি, আইভি রহমান, ফনি ভূষণ মজুমদার, বদরুন্নেসা আহমেদ, নুরজাহান মুরশিদ, মনোরমা মাসিমা, ক্যাম্পে নিয়মিত আসতেন। ইলা মিত্র, মিরা দে, ফুলরেনণু গুহ, প্রতিভা বসু এদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।
১৯৬২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা আন্দোলন নারী আন্দোলন গণতান্ত্রিক ও সা¤প্রদায?িকতাবিরোধী আন্দোলনে কৃষ্ণা রহমান সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। এখনো তিনি আন্দোলন ও সংগ্রামের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন।
নারী হিসেবে পরিবারে কোন কুসংস্কার গোঁড়ামীর সম্মুখীন না হলেও রাজনীতিতে প্রচুর বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। গোবরা ক্যাম্পে থাকাকালীন সাজেদা চৌধুরী কৃষ্ণা রহমানকে নিয়ে অনেক কাজ করাতেন যা ছাত্রলীগের মেয়েরা কিছুতেই অংশগ্রহণ করতে পারছিল না। অনেকগুলো স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সেটা হল একদিন প্রশিক্ষণ চলাকালীন গোবরা ক্যাম্পের ছাদে তাজা বোমা পাওয়া যায়। যেহেতু বাইরে তার যাতায়াত ছিল সেহেতু পুলিশ তাকে সন্দেহ করল সাথে সাথে সাজেদা চৌধুরীকে ফোন করা হয়। ভারতীয় পুলিশ ৭-৮ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁকে এক ধরনের মানসিক টর্চার করে কিন্তু দুইদিন পরে বোমাটা যে রেখেছিল তাকে পুলিশ আটক করতে সক্ষম হয়।
তবে তিনি এখনো ঋণী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং কামরুজ্জামান হেনার কাছে। তাঁরা পরের দিন ফোন করে তার সাথে কথা বলেছেন সাহস দিয়েছেন সান্তনা দিয়েছেন। এছাড়াও ক্যাম্পের মেয়েরা সারারাত তার জন্য জেগে বসে ছিল।
কৃষ্ণা রহমান ২২শে এপ্রিল ১৯৭৪ সালে সৈয়দ মতিউর রহমানকে বিয়ে করেন। দুই পরিবারে প্রগতিশীল হওয়াতে কোন পরিবার থেকে কোনরকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। তার স্বামীও একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি তিন সন্তানের জননী।