শারমীন শরীফ : সমাজ বদলের মানসে যেসব নারী ও পুরুষ স্বপ্ন দেখেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদেরই একজন উম্মেহানি খানম। এই অকুতোভয় সৈনিক উম্মেহানি খানম ১৯২৬ সালে ৭ই জানুয়ারি বগুড়া জেলার চন্দন বাইসা থানার লৌহদহ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মা হাসিনা বানু, বাবা মৌলভী দেলোয়ার আলী খানের সাত সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম। ধর্মীয় ও রক্ষণশীল বলয়ের মধ্যে কেটেছে উম্মেহানির বাল্যকাল। বাবা পেশায় ছিলেন সাব রেজিস্টার, অত্যন্ত ধর্মভীরু একজন মানুষ ছিলেন তিনি। অবসর সময় তিনি ধর্মীয় গ্রন্থ পড়তেন এবং সব সন্তানদের পাশে বসিয়ে পড়ে শোনাতেন। উম্মে হানি তাঁর শৈশবে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পিতাঁর ধর্মগ্রন্থ পাঠ শুনতেন এবং বুঝতে চেষ্টা করতেন। মাত্র ৮/৯ বছর বয়সেই তাঁর যুক্তিবোধের জায়গা থেকে উপলব্ধি করলেন বাবার ধর্মীয় আলোচনার সাথে তাঁর কাজের যথেষ্ট অমিল রয়েছে। এই বয়সেই তিনি বাবাকে প্রায়শই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতেন। প্রচন্ড রক্ষণশীল ও প্রতাপশালী বাবা উম্মে হানির প্রশ্নের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হতেন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও উম্মেহানির এই যুক্তিবোধকে সমর্থন করতেন। এই অল্প বয়সেই তিনি একটি গভীর চিন্তার অধিকারী মানুষ ছিলেন। যেমন পরিবারের যে কোন সমস্যায় বাড়ির লোকেরা তাঁর শরণাপন্ন হতো। বাড়িতে ভিক্ষুক এলে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতেন কেন সে ভিক্ষুক এবং অন্যরা কেন নয়? বৈষম্যের জায়গাটা কোথায় ধরতে চেষ্টা করতেন তিনি।
উম্মে হানি বগুড়ার ইয়াকুবিয়া মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে এটুকুই পেয়েছেন তিনি। তবে ঘরে বসে তিনি রাজনীতি সমাজনীতি ও সাহিত্যসহ নানাবিধ গ্রন্থ পড়েছেন এবং এখনো নিয়মিত পড়ছেন। ১৯৪০ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মোসলেউদ্দিন খানের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। মোসলেউদ্দিন খান তখন কলকাতায় চাকরি করতেন। তিনি স্বামীর সাথে কলকাতায় থাকতে শুরু করেন। এ সময় তিনি পরিচিত হন তৎকালীন মন্ত্রী হাবিবুল্লা বাহারের স্ত্রী আনোয়ারা বাহারের সাথে। প্রগতিশীল নারী আনোয়ারা বাহার উম্মেহানিকে উদ্বুদ্ধ করেন সভা সমিতিতে অংশগ্রহণ করবার জন্য। কলকাতায় সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁরা কয়েকজন নারী একত্রিত হয়ে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গঠন করেন।
উম্মেহানি খানম ছিলেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সহ-সম্পাদক এবং পরে সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। দাঙ্গার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা বিভিন্ন স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির উদ্যোগে এসব আশ্রিত মানুষদের জন্য চাঁদা তুলতেন এবং ঘুরে ঘুরে খাদ্য ওষধ কাপড় বিতরণ করতেন।
১৯৫০ সালে উম্মেহানি খানম কলকাতা থেকে ঢাকার সাভারে চলে আসেন। ঢাকায় তাঁর স্বামীর দুর্নীতিদমন বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি সাভারে ফিরেই এলাকার নারীদের সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত হন। শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের আপত্তি সত্তে¡ও গ্রামে গ্রামে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতেন মেয়েদের অবস্থা উপলব্ধি করবার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তিনি বুঝতে পারেন মেয়েদের মুক্তির একমাত্র উপায় শিক্ষা। আমাদের দেশের মেয়েরা যতদিন শিক্ষিত না হবে, অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী না হবে ততদিন পর্যন্ত দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভবপর নয়। এরপরে তিনি সাভারে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৫২ সালের প্রথম দিকে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তখন তিনি গোপীবাগে থাকতেন। মেয়েদেরকে কামরুন্নেসা স্কুলে ভর্তি করান পাশাপাশি এলাকার নারীদের সংগঠিত করে এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে কাজ করতে থাকেন। তাঁর উদারমনা স্বামী রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না থাকলেও তাঁকে উৎসাহ যোগাতে এবং কাজে সহযোগিতা করতেন। একটি শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন তাঁর স্বামী ও লালন করতেন। আর সে কারণেই তিনি একমাত্র পুত্র মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে (সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) শৈশব থেকেই শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মন্ত্রী উজ্জীবিত করেছেন। ছেলের যখন ৪-৫ বছর বয়স তখন তাঁর বাবা ছেলেকে চেয়ারের উপরে দাঁড় করিয়ে বক্তৃতা শেখাতেন; “আসুন আমাদের দেশটাকে নতুনভাবে গড়ে তুলি।” এভাবেই স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে সাত সন্তানকে সাম্যবাদ এর আদর্শে দীক্ষিত করেছেন। নারী আন্দোলন সহ প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছেন।
উম্মেহানি খানম নয়া পল্টনে নারীদের প্রথম সংগঠন গড়ে তোলেন। এসময় ইঞ্জিনিয়ার রজবালি ও তাঁর স্ত্রী সুফিয়া বেগম বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেন। সুফিয়া বেগম মাইকিং করতেন ঢাকা শহরে এবং উম্মেহানের নেতৃত্বে নারীদের সংগঠিত করে মিছিল মিটিং এবং বিভিন্ন সমাবেশ করতেন। ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনে প্রায় প্রতিটি সমাবেশে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭০ সালে দক্ষিণাঞ্চলে জলোচ্ছ¡াস হলে কবি সুফিয়া কামাল সহ বরিশালের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন। আর ঠিক এই সময় তিনি মহিলা পরিষদ গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর এলাকায় তিনি মহিলা পরিষদের প্রথম কমিটি গঠন করেন। এলাকায় তিনি একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে তিনি গৃহবধূদের স্বাক্ষর সহ হাতের কাজ শেখাতে শুরু করেন। সাত মার্চে রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জনসভার দিন তিনি বিশাল নারীদের এক মিছিল নিয়ে সভায় যোগ দেন।
২৫ শে মার্চ রাতে তাঁর বাড়ির ছাদে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত দেখে পাক বাহিনীর তাঁর বাড়িতে গুলি ছোড়ে। পরে তারা সপরিবারে সাভারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে বাধাগ্রস্ত হয়ে ব্যাংক কলোনিতে আশ্রয় নেন। বুদ্ধি করে তাঁরা যে বাড়িটিতে ছিলেন তারা বাইরে দরজায় একটি তালা ঝুলিয়ে দেন এমন ভাব বোঝানোর জন্য যে কেউ বাড়িতে নেই। একপর্যায়ে তাঁর একমাত্র ছেলে এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চলে যান। এই সময় তাঁর বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের অভয়স্থল হয়ে ওঠে। তাঁদের জন্য তথ্য সংগ্রহ সহ খাবার দাবার ওষুধপত্র বিভিন্ন জিনিস দিয়ে তিনি ও তাঁর স্বামী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি মহিলা পরিষদ ঢাকা নগরীর সভানেত্রী, জাতীয় পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি মহিলা পরিষদের উদ্যোগে গঠিত রোকেয়া সদনে আশ্রিতা সকল নারীর দেখভাল করতেন।
উম্মে হানি খানামের একমাত্র ছেলে রাজনীতি করার কারণে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে এবং জেল খেটেছে বহুবার। এজন্য তিনিও পুলিশে হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেকবার। কিন্তু এ নিয়ে তাঁর কোন ক্ষোভ নেই বরং আছে আত্মতৃপ্তি।
সময় তাঁর জন্য থেমে যায়নি কখনো। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি পরিপূর্ণভাবে সমাজসেবা মূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে। মহিলা পরিষদের আন্দোলনের পাশাপাশি নিজ এলাকায় গৃহ পরিচালিকাদের নিয়ে নিজ অর্থ ব্যয় ‘আঁধার আলো’ নামে শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে নিবেদিত প্রাণকর্মী উম্মেহানি খানম আজীবন চেষ্টা করেছেন মানুষের জন্য কল্যাণকর কিছু করার। প্রবীণ বয়সেও একটি সুন্দর সুস্থ সমাজের স্বপ্ন তাঁর চোখের তারায় ভাসতো। আর এই স্বপ্নকে ঘিরেই চলেছে তাঁর আজীবনের কর্মযজ্ঞ। আমৃত্যু তিনি চেস্টা করেছেন সাধারন মানুষের জন্য কিছু করবার ও পাশে থাকবার। এই মহিয়সী নারীর জন্য আমাদের শ্রদ্ধা অমলীন।