শারমীন শরীফ : আনিসা করিম ১৯৩৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানাধীন ইন্দ্রপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ও মাতার নাম মাজেদা বেগম। বাবা ও দাদা ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য, বাড়িতে একটি রাজনৈতিক পরিবেশ থাকার কারণে মনোরমা বসু, হীরালাল, স্বদেশ বোস, খোকা রায়সহ অনেক নেতৃবৃন্দের কাছাকাছি যাওয়ার সৌভাগ্য হয় তাঁর।

পিতা-মাতা দুজনই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আনিসা করিমের লেখাপড়ার হাঁতে খড়ি ৩ বছর বয়সে মায়ের স্কুলে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর দেড় বছর তিনি ঘরে বসে থাকেন কারণ তখন ও বাড়ির কাছাকাছি কোন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে। দাদা মরহুম সিরাজউদ্দিন মাস্টারের অনুপ্রেরণায় পূর্ব ইন্দ্রকুল বড় দীঘির পারে খালু মরহুম আবুল হাশেমের প্রচেষ্টায় একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই স্কুলে আনিসা করিম পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পরে তাঁর পিতা, ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ময়মনসিংহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং হোস্টেলে থাকার জায়গা পান। এই স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি বিভিন্ন ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন বিশেষ করে ভলিবল বাস্কেটবল ও শুটিংয়ে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন এবং সেই সাথে তিনি গার্লস গাইডও করতেন। দশম শ্রেণী পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়ালেখা করেন কিন্তু ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার অল্প আগেই তাঁর বাবা মারা যান।

১৯৫২ সালে ৫ই মে বাবা মারা গেলে তিনি ময়মনসিংহ থেকে দেশের বাড়িতে ফিরে আসেন। এই সময় তাদের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা মধ্যে পড়তে হয়। অনেক কষ্টে তিনি ১৯৫৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষা শেষে তিনি ময়মনসিংহে চলে যান এবং চাকরির চেষ্টা করেন। ৬০ টাকা বেতনে তিনি একটি স্কুলে বদলি শিক্ষকের চাকরি পান। তিন মাসের শিক্ষকতা করার পরে মুসলিম গার্লস হাই স্কুলে টিচার কাম সুপার পদে ২শত টাকা বেতনে চাকরি পান। এর কিছুদিন পরে তিনি আনন্দমোহন কলেজ থেকে আই এ ভর্তির ফর্ম নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটিতে চাচার বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হন। চাচা ১২ জন অপরিচিত লোকের একটি তালিকা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে একজনকে পছন্দ করে নিতে বলেন যার সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা হবে। নিরুপায় আনিসা করিম চাচার প্রস্তাবে রাজি হন একটি শর্তে, সেটা হল যাকে তিনি পছন্দ করবেন তার সাথে তাকে দেখা করবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে বিয়ের আগে। এ বিষয়টাতে চাচি অমত করলেও চাচা রাজি হয়ে যান। খুব দৃঢ়তার সাথে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আনিসা করিম একজনকে চিহ্নিত করেছিলেন, তিনি ছিলেন রাজনীতিবিদ আব্দুল করিম। আব্দুল করিম তখন যুক্ত ফ্রন্ট থেকে পাস করা এমএলএ এবং একজন মুক্তমনা মানুষ।

১৯৫৫ সালের ১৫ই জুন তিনি আব্দুল করিমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আব্দুল করিম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। সেই সাথে আনিসা করিম ও স্বামীর পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
বিয়ের পরে আনিসা করিম, রেবেকা মহিউদ্দ্নি, জোহরা তাজউদ্দীন, হাজেরা মাহমুদ, বদরুন্নেসা আহমেদ, মালেকা বেগম, কামরুন নাহার লাইলী, মিসেস বাহাউদ্দিন এবং আরো অনেকের সাথে ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় মহিলা সমিতি গঠন করেন। সেই সাথে তিনি ছিলেন বরিশাল জেলার মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা। আনিসা করিম গণনাট্য সংঘ আমরা ১১ জন ইত্যাদি অনেক প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলেন এবং এর সব কিছুতে তাঁর স্বামীর প্রবল উৎসাহ ছিল এবং সহযোগিতা ছিল।

আনিসা করিম

১৯৬০ সালে ১১ই ডিসেম্বর তার বড় মেয়ে নুপুরের জন্ম হয়। নুপুরের বয়স যখন চার মাস তখন আনিসা করিমের স্বামী জেলে। তিনি চার মাসের বাচ্চা এবং শাশুড়িকে নিয়ে বরিশালে এক রুমে একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানে তিনি নিয়মিত ছাত্র পরিয়ে সংসার চালাতে থাকেন। সেই সাথে চালিয়ে যান পড়াশোনা ও সমিতি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার স্বামী পটুয়াখালী জেলার মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক হিসেবে বিভিন্ন থানায় গ্রামেগঞ্জে তার দলবল নিয়ে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধের কাজ চালিয়ে যান এবং সেই সাথেনআনিসা করিমও স্বামীর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে কাজ করেছেন। এ সময় তাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন ডঃ রাব্বি এবং ডঃ হোসেন আহমেদ। এই দুই ডাক্তার তাঁকে প্রচুর ওষুধ, গজ, ডেটল, ইনজেকশন ইত্যাদি দিতেন যা তিনি প্রয়োজনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করতেন। ১৯৯৭ সালের ১০ই নভেম্বর সালেহা করিমের স্বামী মৃত্যুবরণ করেন।

এই জীবন যুদ্ধের মধ্যে দিয়েও ১৯৬৪ সালে সালেহা করিম প্রাইভেটে আইএ পাস করেন, ১৯৭১ সালে বিএ পাস করেন। ১৯৭৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। ১৯৬৫ সালে ৫ই মার্চ বাংলাদেশ টেলিভিশনে পাঁচশত টাকা বেতনে চাকরি পান এবং দীর্ঘদিন চাকরি করার পর ১৯৯৬ সালে ১৪ই মার্চ সিনিয়র স্টোর অফিসার পর থেকে অবসর গ্রহণ করেন।