অনলাইন ডেস্ক : অর্থনৈতিক অস্থিরতা আর চরম ডলার সংকটের সময়ে আশা-জাগানিয়া খবর এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফরেই অন্তত পৌনে সাত বিলিয়ন ডলারের অর্থ জোগাড়ের প্রাথমিক সাফল্য পাওয়া গেছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই বড় অঙ্কের ডলার পাওয়ার আশ্বাস এসেছে। ফলে শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

এর বাইরেও চীনের প্রস্তাবে বড় বিনিয়োগের সোলার প্লান্ট স্থাপন, নেপালের পক্ষ থেকে জলবিদ্যুৎ, জ্বালানি আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে সহায়তারও আশ্বাস এসেছে বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে। অর্থনীতিবিদরা এটাকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তবে এ জন্য ঋণের শর্ত মেনে নানা খাতের সংস্কারগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এখন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

ক্ষমতার পালাবদলে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব নিয়ে প্রথমবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিলেও স্বল্প সময়ে তিনি সেখানে এখন বিশ্বনেতাদের মনোযোগের কেন্দ্রে। আগে থেকেই খ্যাতি ও সমীহ পাওয়া ড. ইউনূস এবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন নতুন পরিচয়ে। এবার তিনি বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এরই মধ্যে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবা, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং উইসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

যাঁর সঙ্গেই তাঁর বৈঠক হচ্ছে, সেখানে অর্থনৈতিক সহায়তা ও বাংলাদেশের উন্নয়নে তাঁদের পাশে থাকার আহ্বানকে এগিয়ে রাখছেন। এখনো জাতিসংঘ মিশন শেষ হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছেন বলে জোর আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের জন্য ২০ কোটি ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সংস্কারের যেকোনো উদ্যোগে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এটিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রাথমিক সাফল্য হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রাথমিক সাফল্য। কারণ এখনো আমাদের কাঙ্ক্ষিত রিজার্ভ বাড়ছে না। কাজেই রিজার্ভ বাড়াতে হবে। তা না হলে মুদ্রা অবমূল্যায়িত হবে। এতে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে। আমদানি কমে যাবে। ফলে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে। এর প্রভাব পড়বে উৎপাদনে। এমন পরিস্থিতিতে বড় অঙ্কের ডলার যদি আমরা আনতে পারি, তা অবশ্যই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।’

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসের জাতিসংঘে উপস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিশিষ্টজনরা উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এটা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁরা নতুনভাবে চিন্তা করবেন। তাঁরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের খ্যাতি ও ইতিবাচক ইমেজকে মূল্যায়ন করেই সাড়া দিয়েছেন। এভাবে যদি উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তিনি যোগাযোগ বাড়ান, তবে এ থেকে দেশ লাভবান হবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা।

জানা যায়, ড. ইউনূস বৈঠক করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার সঙ্গে। বৈঠকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সংস্কারে খরচের জন্য সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। এর মধ্যে দুই বিলিয়ন ডলার দেবে একেবারে নতুন ঋণ হিসেবে আর বাকি দেড় বিলিয়ন ডলার দেবে আগের প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেওয়ার অংশ হিসেবে। মোটাদাগে সরকার এই অর্থ ডিজিটাইজেশন, তারল্য সহায়তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং পরিবহনে খরচ করতে পারবে।

ড. ইউনূস বৈঠক করেছেন আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েবার সঙ্গে। এমন একসময় তিনি আইএমএফপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করলেন, যখন ঋণ দেওয়ার জন্য সংস্থাটির একটি মিশন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এরই মধ্যে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে আইএমএফ। এর পরও সংস্থাটি ড. ইউনূসের নেতৃত্বের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরো তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চায়। আইএমএফ মনে করে, একটি বিশেষ সময়ে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকার অনেক খাতে সংস্কার করবে। এ জন্য তারা পাশে থাকতে চায়। আইএমএফপ্রধান ড. ইউনূসকে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতেও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। সাধারণ এ অর্থ বাজেট সহায়তা হিসেবে সরকার খরচ করতে পারবে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডলার সংকট কাটাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেকোনো মূল্যে ডলারের মজুদ বাড়াতে চাচ্ছে। নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন। বরং রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়িয়ে ডলারের মজুদ বাড়াতে চাচ্ছেন। এরই মধ্যে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কিছুটা বেড়ে ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সংকটময় সময়ে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এক সফরেই পৌনে সাত বিলিয়ন ডলার জোগাড়ের আশ্বাস পাওয়া খুবই আশা-জাগানিয়া।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “এটা খুবই ইতিবাচক। বোঝা যাচ্ছে যে ড. ইউনূস সেখানে বেশ সমীহ পাচ্ছেন। তাঁকে সবাই আগে থেকে চেনেন, নতুন করে চেনানোর কিছু নেই। তবে এবার তিনি একটি বাড়তি পরিচয় নিয়ে সেখানে গেছেন। সেটি হলো বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটা তাঁর নেতৃত্বের সাফল্যই বলা যায় যে বেশ বড় অঙ্কের ঋণ সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুইভাবে আসবে এই সহায়তা। একটি নগদ সহায়তা, আরেকটি প্রকল্প সহায়তা। নগদ সহায়তাটি বাজেটে খরচ করা হবে। এটা তাত্ক্ষণিকই পাওয়া যায়। আর প্রকল্প সহায়তা পেতে একটু সময় লাগে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বগুণে উচ্চ পর্যায়ে একটা সাফল্য পাওয়া গেছে। এখন এই ঋণ পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশকে। আর্থিক খাত, জ্বালানি খাত, রাজস্ব খাত, ব্যাংকিং নীতিমালাসহ বেশ কিছু জরুরি সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। এ জন্য একটা ‘টাইমবাউন্ড’ কর্মসূচি তৈরি করে ওদেরকে দিতে হবে। অর্থ বিভাগকে এখন এটি করতে হবে।”

জানা যায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই ট্যুরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়েং উইসহ বেশ কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সবাই কমবেশি নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশে একটি বড় বিনিয়োগের সোলার উৎপাদন প্লান্ট বসাতে চান বলে প্রস্তাব দেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সোলার প্যানেল বানিয়ে সারা বিশ্বে রপ্তানির লক্ষ্য চীনের। এর ফলে এখানে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার জোগান বাড়বে। বহু লোকের কর্মসংস্থান হবে। চীন মনে করে, সোলার প্যানেলে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় রপ্তানিকারক হতে পারবে।

ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা দেশটির বিপুল জলবিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তিনি জ্বালানি, পর্যটন, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে উভয় দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন।

ইউএসএইডের প্রধান সামান্তা পাওয়ার ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। বিল ও মেলিন্ডা গেটসের সিইও মার্ক সুজম্যানও বৈঠক করেছেন। তিনিও পাশে থাকতে চান বলে জানিয়েছেন।

এর বাইরে ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের মঞ্চেও বক্তব্য দিয়েছেন ড. ইউনূস। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নিজেও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

প্রায় প্রতিটি ফোরামে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে সহায়তার আহ্বান জানান। যাঁরাই তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই আন্তরিকভাবেই বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ড. ইউনূসের প্রতি যে ইতিবাচক মনোভাব বিশ্বনেতারা দেখাচ্ছেন, তার ফলে সামনে এর সুফল পাবে দেশের অর্থনীতি।