মামুন খান : কোন জ্বর নাই, ভাল লক্ষণ। ঘরের ভেতর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় দরজার বাইরে ফ্রেইম ধরে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বাবার ডাক্তারী কার্যকলাপ অবলোকন করছে দুই ভাই।
প্রথম দিন ভালোয় ভালোয় কেটে গেলেও পরের দিন টের পেল জান্নাত যে সে কোন গন্ধ পাচ্ছে না, জিহ্বায় কোন স্বাদ নেই। রান্না ঘরে নওশের খুব একটা যায় না, তবে রান্নার হাত খুব ভাল তার। বীফ দিয়ে আচারী গোস্ত নওশেরের সিগনেচার ডিশ- এক কথায় দুর্দান্ত। সন্ধ্যায় নওশের সেই ডিশটা বানিয়ে সামনে রাখল। খুব আগ্রহ নিয়ে খেতে বসল জান্নাত। এক টুকরা মুখে দেবার পরই বমি ভাব চলে আসল। মুখেরটা কোনমতে গলা দিয়ে নামিয়ে সে বলল, আর খেতে পারছি না, বমি আসছে।
– সেকি? তুমিতো এইটা লাইক কর। আরেকটু খাও।
– না, না, প্লীজ নসু। সামনে থেকে প্লেটটা নিয়ে যাও। খাবার দেখলেই বমি আসছে।
কপালে চিন্তার রেখা টেনে বাধ্য হয়ে খাবারের প্লেট কিচেনে রেখে এসে বলল, আমার মনে হয় হেল্প লাইনে কল করা উচিৎ।
গভীর রাত। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে জান্নাত, ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত নওশের বসা ছিল, বিছানা থেকে একটু দূরে, চেয়ারটাতে। নওশের চলে যাবার পর একা হয়ে যায় জান্নাত। ভয়টা ফিরে আসে সাথে সাথে। যে ভয় থেকে এতদিন পালিয়ে বেড়াচ্ছিল সেই ভয়ের সামনাসামনি এখন সে। টেস্ট এখনও করেনি, তবে অফিসিয়াল হেল্প লাইনের সাথে কথা বলে কনফার্ম- যে সে পজিটিভ। সোস্যাল মিডিয়ায় অমুক-তমুকের আক্রান্ত হওয়ার পোস্ট না, পত্রিকার পাতায় ছাপা সংবাদ না অথবা টিভিতে স্ক্রল করা করোনা আপডেইট না। এটা তার নিজের কথা- করোনায় আক্রান্ত জান্নাতারা বেগম। আপাতত মেইন সিম্পটম হচ্ছে জিব্বায় কোন স্বাদ নেই। নাকি সাথে জ্বরও আছে? সেরকমই তো মনে হচ্ছে। শীত শীত লাগছে, একটু কাঁপুনিও বোধ হচ্ছে। পায়ের কাছে জুবু থুবু পড়ে থাকা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ডান কাত হয়ে আবার শুয়ে পড়ল জান্নাত। এ পাশের খোলা জানালার বাইরের নীল আকাশে অগণিত নক্ষত্রের মেলা। অপরূপ ভাল লাগা জ্যোৎস্নার হাসি।
আমি কী মরে যাচ্ছি? করোনায় বিদায় নেওয়া লাখো নামের সাথে আমার নামটাও যোগ হয়ে যাবে আজ, কাল, পরশু অথবা যে কোন সময়? যেদিন আমি চলে যাবো সেদিনও হয়ত বা আকাশ সাজবে তারাদের মালা পড়ে, যেমনটি সেজেছে আজ। সেদিন অথবা সেদিনের পর আরও অনেক অনেক যুগ পর্যন্ত প্রকৃতি তার স্বরুপে বার বার ফিরে আসবে, সাজিয়ে দিবে, রাঙ্গিয়ে দিবে বর্ণহীন জীর্ণ মলিণ এ ধরিত্রীকে। ফুলে ফুলে ভরে যাবে উঠোন। লাল, নীল, বেগুনী পরাগ রেণু পাখায় মেখে এ ফুল ও ফুল উড়ে বেড়াবে প্রজাপতির দল। বাগানের কচি লাউয়ের ডগা মাচান বেয়ে তরতর করে বেড়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে জানিয়ে দেবে তার উপস্থিতি। গোধূলী লগ্নে ডানায় মিষ্টি সোনালী রোদ্দুর মেখে নিশ্চিত মনে নীড়ে ফিরে যাবে পাখিরা। মাথায় গিজগিজ দুঃশ্চিন্তা নিয়ে হাইওয়ে ৪০১ এর ট্রাফিক জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকবে ঘরে ফেরা কর্মজীবী আদম সন্তান। রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে ধাতব চাকায় ডাইনোসরের ক্রন্দনের মত বিকট শব্দে নগরীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত থেকে ছুটে যাবে সাব ওয়ের রেল গাড়ি। গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কোন এক মধ্য বয়সি যুবক সিগারেটের ধোঁয়ায় কুণ্ডলী পাকাবে আর জীবনে চাওয়া, পাওয়া, লাভক্ষতির জটিল হিসেব মেলাবে। গ্রাম্য নববধূ বিদেশ চলে যাওয়া স্বামীকে বুক ভরা অভিমান নিয়ে ভুল-ভাল বানানে ভরা দীর্ঘ চিঠি লিখবে। মায়ের কোলে খিল খিল করে হেসে উঠবে মানব শিশু। থাকবে সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, মান, অভিমান। পৃথিবীর সবকিছুই চলবে ঠিইক আগের মতই। সেদিন আমিই শুধু থাকব না। নিজের স্বামী সন্তান হয়তবা কিছু দিন মনে রাখবে। তারপর আমার কতাহ কেউ মনে রাখবে না। জান্নাত নামের একজন মানুষের নাম গন্ধ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তোমাকে কেন মনে রাখবে জান্নাতার বেগম? মনে রাখার মত তুমি কি করেছ? বুকে হাত দিয়ে বলতো-তুমি নিজে কি একজন মানুষ? অল্প ক’দিনের ছোট্ট এ মানব জীবনে নিজের বুঝ ষোল আনা বুঝে পেতে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেড়িয়েছ দেশ থেকে দেশান্তরে। মানুষ হয়ে মানুষের ভালোর জন্য এ জীবনে কিছু করেছ- এমন একটা প্রমাণ দিতে পারবে? মহামারী প্রতিষেধক দূরে থাক, মামুলি শরীর ম্যাজম্যাজের ওষুধ আবিষ্কারে তোমার কি কোন ভূমিকা ছিল? জাহাজ-উড়োজাহাজ দূর অস্ত- একটা ছোট্ট কম্পিউটার চিপস জাতীয় কিছু একটা বের করার কথা তোমার মনে মিলি সেকেন্ডের জন্য কখনও কি উদয় হয়েছে? দা, শাবল, কুড়াল, কাঁচি, জুতার ফিতা, সুই-সুতা অথবা তার চেয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোন কিছুর কথা কি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছ কোনদিন যা দিয়ে মানুষের কল্যাণ হতে পারে? খাওয়া, পড়া, থাকা, ভোগ বিলাসিতা- প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছ আজ অবধি। কখনও কি শুনতে চেয়েছ, বুঝতে পেরেছ হতদরিদ্র, হতভাগা, জীবনমৃত আদম সন্তানদের কষ্টের কথা? তোমার জন্মটাই ছিল মানুষের- বাকিটুকু পোকামাকড়ের, কীটপতঙ্গের।
দূর থেকে কে যেন ডাকছে, জানু, ও জানু। আওয়াজের উৎস খুঁজে পেতে চায় জান্নাত। সে কি মরে গেছে, নাকি বেঁচে আছে? চোখ মেলার চেষ্টা করছে সে। অনন্ত কাল পেরিয়ে যায় যেন। আছে বেঁচে আছে সে এখনো। মাথার ভেতর ধারালো কিছু একটা দিয়ে কে যেন আঘাতের পর আঘাত করে যাচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন যেন চাপ ধরে আছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কপালে একটা হাতের স্পর্শ। আঙ্গুল গুলো ধীরে ধীরে চুলের মধ্যে বিলি কাটছে। আহ! মাথার ভেতর আঘাতের যন্ত্রণাটা একটু কম লাগছে। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে নওশেরকে দেখতে পায় সে- মুখে মাস্ক, তার উপর ফেইস শীল্ড, কপালে চিন্তার ভাঁজ। কাত হয়ে দরজার দিকে তাকায় এবার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ছেলে দুটো মায়ের দিকে। এখন দিন কি রাত কিছুই বোধগম্য হয় না তার।
– এখন কেমন লাগতেছে জানু?
কিছু বলতে চেষ্টা করে জান্নাত, পারে না। চোখের দু’কোন বেয়ে অশ্রু ধারা বয়ে যায় শুধু।
টিসু দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলে নওশের, কাঁদে না জান, তুমি ভাল হয়ে যাবা। নাও, এখন টাইলানল দুইটা খেয়ে নাও তো। নওশেরের হাতে ভর করে অনেক কষ্ট করে কোনমতে উঠে ট্যাবলেট দুটো খেয়ে আবার শুয়ে পড়ে জান্নাত।
– জানালাটা একটু খুলে দাও, অনেক কষ্টে কথাটা বলে সে। তাড়াতাড়ি জানালা খুলে দেয় নওশের।
– নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে জানু? আল্লাহকে ডাকো জান। আমি এক্ষণ ইমার্জেন্সিতে ফোন করতেছি।
ফোন করার জন্য পাশের রুমে চলে যায় নওশের, পেছনে আবরার। অসহায়ের মত দরজা ধরে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে জুবায়ের।
আহারে, সোনা আমার, মানিক আমার, আমার জানটুস। মুখটা কেমন এতটুকু হয়ে গেছে। খিদা পেয়েছে? মায়ের কাছে আসবি? একটা গল্প শুনবি বাবা? আমারও যে খুব মন চাইছে একটাবার তোদের বুকে জড়িয়ে ধরি।
– আয় আয় চাঁদ মামা, টি ই প দিয়ে যা …
ঘুম পাড়ানি মাসী পিসী …
মাথার ভিতর ভীষণ যন্ত্রণা, বুকে জগদ্দল পাথর। আল্লাহর বিশাল এ দুনিয়ার অফুরন্ত বাতাস থেকে কেউ কি পারে আমার জন্য এক বুক ভরা বাতাস এনে দিতে? আল্লাহ্ আমাকে একটু বাতাস দাও প্লীজ। আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। জুবায়েরের পেছনে এবার আবরার এসে দাঁড়িয়েছে। মুখটা এমন মলিন কেন বাবা? তোমার উপর অনেক অন্যায় করে ফেলেছি বাপ। তোমার বয়স যখন এক বছর তখন আমরা ক্যানাডায় আসলাম। আসার পর থেকেই এই বেবিসিটার, অই ডে কেয়ার- মায়ের আদর যতটুকু পাওয়ার তার কিছুই তুমি পাওনি। এটা আমার ব্যর্থতা, আমার অক্ষমতা। আমাকে তুমি মাফ করে দিও মানিক। ছেলেটা দেখতে হুবহু নওশের, মাশাল্লাহ একেবারে বাপ কা ব্যাটা। ভাল, বাপের মত হয়েছ খুব ভাল কথা। তোমার বাপ আগা গোরা একজন ভাল বানুষ। এই ভাল মানুষটাকে সারাজীবন আমি কষ্ট দিয়ে এসেছি। এ সব কিছুই চিৎকার করে বলতে চাইছে জান্নাত। কিন্তু বলতে পারছে না, শুধু কাঁদছে সে। দু চোখ বেয়ে বারি ধারা অঝরে ঝরে পরছে, যেন বাঁধ ভাঙ্গা জলোচ্ছ্বাস। বুকের ভেতর, মাথার ভেতর যন্ত্রণা, ভীষণ যন্ত্রণা।
জান্নাতের চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে সান্তনার কথা শোনায় নওশের, কাঁদে না জানু, কাঁদে না। কাঁদলে তোমার শ্বাস কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। এ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে এখনি। হসপিটালে নিয়ে অক্সিজেন দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ- no worries, নওশেরের গ্লোভস পড়া হাত খানা নিজের দু’হাতে টেনে নিয়ে নিজের গাল আর চিবুকে প্রতিস্থাপন করে জান্নাত। আলগোছে আরেকটা হাতও বাড়িয়ে দেয় নওশের স্ত্রীর দিকে। সে হাতটিকে আরেক গাল আর চিবুকে স্থাপন করে জান্নাত। ভেতরের যন্ত্রণা এইবার বুঝি কমল একটু। আবার ভাবনার জগতে ফিরে যায় সে।
“নসু, আমার জান। তোমার এই হাত দুটো কতদিন এমনি করে জড়িয়ে ধরিনি। এই হাতের ছোঁয়া যে আমার খুব আপন, ভীষণ ভাল লাগার, খুব ভরসার। এই হাত দুটি ধরে জীবনের কতটা পথ পারি দিয়ে এলাম- জগত সংসারের বন্ধুর পথ। আমাকে হসপিটালে নিও নাগো। আজারাইল যদি নিতে চায়, তবে তোমার হাত থেকেই নিয়ে যাক। তোমার হাত আমার তপ্ত কপাল স্পর্শ করলে কষ্ট কমে যায়। আচ্ছা জান, আমিকি তোমাকে বলিনি কখনও- এই জানুর জান তুমি? আমিকি বলিনি, তোমায় বড্ড ভালবাসি জান। না বলে থাকলে এখন বলি- ভাল বাসি, ভাল বাসি, এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায়, বাজায় বাঁশি ভালবাসি ভালবাসি….
আমার যে ভারী কষ্টগো। আমার ভেতরটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম! আমার সবচাইতে যে পড় শত্রু, সেই শত্রুরও যেন এমন অসুখ না হয়। মাথার ভেতর ধারালো ছুরির আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কত দিন বুক ভরে বাতাস নেইনা-এক বুক ঠাণ্ডা বাতাস। আমার যে ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। এক মুঠো গরম ভাতের উপর আধ চামচ ঘি, সাথে আলু ভর্তা- আহা, কত দিন খাইনি। তুমি কি কাঁদছ জান? কান্না করা তোমার সাজে না। কত ঝড় ঝাপ্টা, কত বিপদ আপদ, কত মান অভিমান- আমি কেঁদেছি বহুবার, তুমি কাঁদনি। আজ কেন কাঁদছ তবে? নিজের জন্য না হলেও আমাদের জুবায়ের, আবরারের জন্য তোমাকে যে আরও অনেক বছর পথ চলতে হবে একাকী। একাকী পথ চলতে পারবে না? তাহলে আরেক জোড়া হাত না হয় সাথে নিয়ে নিও। আমি মনে কিছু মনে করব না। হ্যাংলার মত এদিক ওদিক তাকাবে, স্যাবলার মত এ পাতে ও পাতে মুখ দিবে- তার চাইতে সব কিছু বৈধ থাক, সেই ভাল। শুধু আমার সোনা মানিক, আমার কলিজার টুকরা দুটাকে কষ্ট দিও না, ওদেরকে মানুষ করো। কীটপতঙ্গের মত মানুষ না, মানুষের মত মানুষ। প্যারামেডিক্স এসে গেছে। অক্সিজেন মাস্ক পড়া জান্নাতকে স্ট্রেচারে করে এ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাস্কের ভেতর থেকে অস্পষ্ট দেখতে পায় জান্নাত- আঙ্গিনায় অসহায় দাঁড়িয়ে নওশের, বাবার গায়ে গা ঘেষে এক হাত ধরে আবরার আরেক হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট জান্টুস। এই প্রিয় মুখ গুলো আর হয়ত দেখতে পাবে না সে। মাথার উপর খোলা নীল আকাশে এক ফালি বাঁকা চাঁদ। এমন পূর্ণিমা রাত আর হয়ত তার জীবনে আসবে না। অ্যাম্বুলেন্স স্টার্ট নেয়, সাইরেন বেজে ওঠে। স্বামী, সন্তান, কেরিয়ার, পাঁচ হাজার স্কয়ার ফীটের উপর সুইমিং পুল সহ বিশাল বাড়ি, শখের আঙিনায় বাহারী ফুলের বাগান, নতুন মডেলের গাড়ি, সদ্য কেনা দামি কাঠের ফার্নিচার- এসব ফেলে সে চলে যাচ্ছে। এগুলোকি তবে মিছে মায়ামরীচিকা? আহা, সে যে এই মরীচিকার পেছনেই ছুটে বেড়িয়েছে আজীবন। জীবনটা তার ষোল আনাই মিছে। ব্রাম্পটন