মামুন খান : মারা গেছে জান্নাতারা বেগম। তার মরদেহ গলা থেকে পা পর্যন্ত লাল কাফনে মোড়া, শুধু মুখমন্ডল উম্মুক্ত। খাটিয়া করে না নিয়ে তাকে চ্যাং দোলা করে কবরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লাল কাফন এবং চ্যাং দোলা করে লাশ বহন- এ দুটোই জান্নাতের কাছে অভিনব এবং আপত্তিকর। সে চিৎকার করে এর প্রতিবাদ করছে, বলতে চাইছে মৃত হিসেবে তাকে তার ন্যুনতম মর্যাদা টুকু অন্তত দেওয়া হোক। কিন্তু কেউ কর্নপাত করছে না। পরিচিত, অপরিচিত অনেকেই তার চ্যাং দোলা শবযাত্রার আগে পিছে হাঁটছে। সবার হাতে একটা করে স্মার্ট ফোন। সবাই ব্যস্ত ব্রাউজিং এ- আল্লাহখোদার নাম কেউ নিচ্ছে না।
কে একজন চেঁচিয়ে বলল, সবাই রেডি? উই আর ইন লাইভ না’ও। বাকি সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে বলল, আহা বেশ, বেশ, বেশ! কে লাইভ করছে তা’ বোঝা যাচ্ছে না, তবে জনপ্রিয় একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কন্ঠই মনে হচ্ছে। লাইভ শবযাত্রার ধারাভাষ্যকার তার স্বভাবজাত সুললিত কন্ঠে বলছে- শুভ সকাল বন্ধুরা। টরন্টোর বাংলা কমিউনিটির প্রিয় মুখ, আমাদের প্রাণপ্রিয় জান্নাতারা বেগমের অনন্ত যাত্রার লাইভ টেলিকাস্টে সব্বাইকে স্বাগত। বাইরে Temperature এখন হিমাংকের সামান্য উপরে। ধবল বকের পালকের ন্যায় শুভ্র তুষারে ছেয়ে আছে চারিধার, সেই সাথে নৃত্যের তালে তালে- এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার দর্শক শ্রোতা যোগ দিয়েছেন আমাদের লাইভ শব যাত্রায়।
এতক্ষণ যা বলছিলাম, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ঝিরি ঝিরি তুষার পাত হচ্ছে , ঠিক যেন ধবল পরীদের নৃত্য। এরই মাঝে লাল কাফনে মোড়া জান্নাতের মরদেহ দৃপ্ত প্রত্যয়ের সাথে ধীর লয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আপানারা যারা প্রোগ্রামটি লাইভ দেখছেন তাদের কাছে নিশ্চয়ই দৃশ্যমান হচ্ছে- সাদার মাঝে এক টুকরা লাল, রঙের কী অসাধারণ কম্বিনেশন, বর্ণনাতীত, অভুতপূর্ব, অমায়িক করুন এক দৃশ্য। সাদার বদলে লাল কাফনের রহস্য পরিষ্কার হল জান্নাতের কাছে। এক ফাঁকে খাটো মত কেউ এক একজন সেলফি তুলল তার সাথে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে তার নিজের হাতেও একটা ডিভাইস, মরার আগ আগ দিয়ে কিনেছিল- আই ফোন ১১প্রো। তা’ ফোন থাকলেই বা কি যায় আসে? কবরেতো ওয়াইফাই (WiFi) নাই। আর ওয়াইফাই থাকলেও পাসওয়ার্ড তো জানে কেবল হুজুররা।
টুং করে একটি শব্দ হল ইমোজি আসার। দাঁত ক্যালানো হাসির রসড়লর দেখতে পেল জান্নাত ফোনের মনিটরে। যাক নেটওয়ার্ক আছে তাহলে। কিন্তু লাশের সাথে মস্করা কে করল? খুবই নাখোশ হয় জান্নাত। এরা মানুষ হবে কবে, মরলে পরে? গালি দিতে মন চায় তার। লাশের পক্ষ থেকে গালি দেওয়া বারণ বিধায় এই কর্মটি থেকে নিজেকে বিরত রাখলো। তবে সে জিন্দাদের নসিহতের উদ্দেশ্য বলল, ওহে জগতের মানবকুল, মরে আগে আমার মত মুর্দা হউ, তারপর বুঝবা কত মরিচে কত ঝাল।
এমনসময় ফোন বেজে উঠল। হ্যালো, গায়েবি কণ্ঠে কেউ একজন উত্তর দিলো। কণ্ঠটা তার খুব চেনা মনে হচ্ছে। আরে! এ তো নসুর গলা। নওশের ওরফে নসু- তার একমাত্র হাজব্যান্ড। কিন্তু ওকে দেখা যাচ্ছে না কেন? চিৎকার করে সাহায্য চায় সে- নসু, তুমি কোথায়? হেল্প মি, প্লীজ। গলা দিয়ে চিৎকার বেরোয় না। শুধু গোঙ্গানির মত শব্দ বেরোয়। ধারাবিবরণী হঠাত থেমে গেল। হেই ও, হেই ও করে তার চ্যাংদোলা দেহ খানি দোলনার মত আগ পিছ বার কয়েক দুলিয়ে শূন্যে ছেড়ে দিল শব বহনকারীরা। ভয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করল সে। তবে চিতকারের শব্দ বের হলো না, কেমন যেন গোংগানীর মত শব্দ হলো মাত্র। ক্ষণকাল পরে চোখ খুলে জান্নাত নিজেকে আবিষ্কার করল কবরে, সামনে দাঁড়ানো পাহাড়ের মত উঁচু এক দানব, হাতে তার বিশাল মুগুর। ভয়ে ভয়ে দানবের চেহারা পরখ করার প্রয়াস চালায় সে। খুব চেনা চেনা মনে মনে হচ্ছে, কার মত যেন দেখতে, কার মত যেন! ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, এতো দেখি Rodney, তার কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার। মানুষ হিসেবে মন্দ না। মন্দের মধ্যে শুধু মাঝে মাঝে তার হো হো অট্রোহাসিতে পুরো বিলডিং প্রকম্পিত হয়। আর সেই সময় আশে পাশে অধঃস্তন যারা থাকে তাদেরকেও তার চেয়ে লোয়ার স্কেলে হো, হো বা হি হি করে হাসতে হয়। গেল রোজার ঈদে আস্ত এক বাটি সেমাই এনে খাওয়ালো সে রডনিকে। চেটে পুটে খেয়ে সে কী খুশি রডনি। কবরের ভয়াভহ জীবনে রডনির মত একজন পুরোপুরি না হলেও মাঝারি মানের ভাল মানুষের দেখা পেয়ে ভয় অনেকটা কেটে যায় তার।
ইংরেজীতে বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করে জান্নাত, রডনি, হাউ কাম ইউ আর হিয়ার? হোয়াট’স দ্যাট ইন ইওর হ্যান্ড?
-এটা দিয়ে তোমাকে বানানো হবে। এটাকে বলে মুগুর, বাংলায় উত্তর দেয় সে।
-একি, তুমি দেখি চোস্ত বাংলা জানো।
-বাংলা, উর্দু, হিন্দি, হিব্রু সব ভাষাই আমার জানা। শুধু চাইনিজটা জানিনা। হো, হো, হো…, রডনির অট্রহাসিতে কবর প্রকম্পিত হয়।
-প্লীজ রডনি। ঘন দুধের সেমাইর দোহাই লাগে তুমি আমাকে মেরো না, আর্তি জানায় জান্নাত। দূর থেকে বিউগলের সুর বেজে ওঠল। এখনই হয়ত তোপধ্বনি শুরু হবে। মনে মনে প্রীত হল জান্নাত- যাক তাকে তাহলে জাতীয় মর্যাদায় দাফন করা হচ্ছে।
গায়েবি নকিব ঘোষণা দেয়, Attention!
সটান হয়ে দাঁড়ায় রডনি।
-মুগুর মারতে হবে। মুগু—র মার।
এবারে ব্যাক গ্রাউন্ডে অর্কেস্ট্রা আর ব্যান্ডপার্টি বেজে ওঠে একসাথে। পূব আর পশ্চিমা মিউজিকের ফিউশন। সেই সাথে কোরাসে গণ সঙ্গীতঃ
যেমন কুকুর, তেমন মুগুর।
ঘোরাও মুগুর, মারো কুকুর।।
সংগীত চলার মধ্যেই রডনি দুই হাতে মুগুর উঁচু করে। তারপর বিশেষ কায়দায় তিনশ ষাট (৩৬০) ডিগ্রী এঙ্গেলে মুগুরটিকে ঘোরায় বার কয়েক- সাঁ সাঁ। যেন হাইওয়েতে দুইশ কিলো মিটার বেগে স্পোর্টস কার ছুটে চলছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দেয় জান্নাত। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না, আগের মত শুধুই গোঙ্গানি।
বুম! সজোরে আঘাত হানে রডনির মুগুর। চোখ, মুখ, নাক, ঘিলু, খুলে সব চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
ওঠো, ওঠো– — , সেই গায়েবি আওয়াজ।
নাক, মুখ, খুলি, ঘিলু যে যার জায়গায় একসাথ হয়ে আবার পূর্ণ জান্নাতের আকার ধারণ করলো। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল সে। সামনে দাঁড়ানো ছোট, খাটো একজন চাইনিজ। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কে যেন, কে যেন! ও হ্যাঁ চিনেছে। ওর নাম Walt. যদিও এটা তার আসল নাম না। চাইনিজ নামের ক্যানাডিয়ান ভার্সন। নিরেট ভদ্রলোক। গেল সামারে জান্নাতদের সুইমিং পুল ক্লিন করেছিল ওয়াল্ট। ভাগ্যিস পৃথিবীতে থাকতে চাইনিজ ভাষায় কিছুদিন তা’লিম নিয়েছিল সে। এখন মোক্ষম এস্তেমাল করা যাবে।
-নি হাউ ওয়াল্ট ( হাই ওয়াল্ট), হাওজিউ বুজিয়ান ( লং টাইম নো সী)– পুরোটা শেষ করতে পারে না সে, বুম ম!
-ওঠো, ওঠো, সেই সাথে মৃদু ধাক্কা।
ধড়মড় করে শোয়া থেকে উঠে বসে জান্নাত।
-এত জোরে নাক ডাকছো? এবার একটু ক্ষান্ত দাও দয়া করে। আর ঘুমানোর আগে ফেইস বুক থেকে লগ আউট হয়ে ঘুমাতে যেও প্লীজ। টুং টাং করে সারাক্ষণ শুধু – – –
অন্য যে কোন সময় হলে সামান্য একটু নাক ডাকার অপরাধে শান্তির নিদ্রায় ব্যত্যয় ঘটানোর জন্য আর ফেইস বুকিং নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য রাখার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় একটা মামলা ঠুকে দিত জান্নাত। তা হোক না বিবাদি তার আপন স্বামী। কিন্তু এই মুহূর্তে তৃতীয় বারের মত মুগুর পেটা থেকে রক্ষা করার জন্য স্বামীর প্রতি অন্তরটা ভক্তি ভরে সিক্ত হয়ে উঠল। তবে মুখে শুধু ছোট্ট করে বলল, সরি।
মাথার কাছে জানালাটা খোলা থাকায় সোঁ সোঁ শব্দ আসছে হাইওয়ে থেকে। উঠে জানলা বন্ধ করে পাশ ফিরে শোয় জান্নাত। ইতমধ্যে উপযুক্ত অর্ধাংগ হিসেবে স্বীয় স্ত্রীর অসমাপ্ত নিদ্রা এবং নাক ডাকা দুটো কর্মকেই অবশিষ্ট রজনী চালিয়ে নেওয়ার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করল নওশের। কখনও মৃদু, কখনও বা মাঝারি আবার কখনও বা ভারি মাত্রায় নাসিকা গর্জনে বাকি রাত ঘর প্রকম্পিত হতে থাকলো।
বলাই বাহূল্য অবশিষ্ট রজনী বিছানায় এপাশ ওপাশ করে নির্ঘুম কাটিয়ে দিল জান্নাতার বেগম। সেই নির্ঘুমতার পেছনে নওশেরের নাসিকা গর্জন যতটুকু না দায়ী, তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী মৃত্যু ভয়।
জান্নাতের স্বপ্নে এমন বিভীষিকাময় ঘটনার অনুপ্রবেশের পেছনে ছোট্ট একটা ইতিহাস আছে।
গেল বছর ডিসেম্বরে প্রথম যখন করোনা ভাইরাস নিয়ে কানাঘুষা, নিউজ, ভিউজ ইথারে ভেসে বেড়াতে লাগলো তখন সে এটাকে মামুলী হাম জ্বরের মতই উড়িয়ে দিয়েছিলো। চীনে নতুন এক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বেশুমার মানুষ মারা যাচ্ছে। পোকা-মাকড়, সাপ-বিচ্ছু খাওয়া চিঙ্কুরা ভাইরাসে মরলে জগৎ সংসারের কি-ই বা যায় আসে? চীনের কর্তিত্ববাদি সরকার প্রদেশ ব্যাপী লকডাউন সহ নানারকম সাঁড়াশী পদক্ষেপ নিয়েছে। ভাইরাসের বাপের সাধ্য কী, সাগর সাঁতরে ইউরোপ, আমেরিকায় পাড়ি জমায়! কিন্তু বাস্তবে সাধ্যের অতীত কাজটাই করে ফেলল ক্ষুদে ভাইরাসটি। জানুয়ারীর পঁচিশ, ২০২০, টরন্টো শহরে প্রথম করোনাক্রান্ত রুগীর সন্ধান পাওয়া গেল।
জাতিগত নাম করোনা ভাইরাস, পুরো নাম কোভিড-১৯। উনিশের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশ থেকে Li Wenliang নামের এক ডাক্তারের কাছ থেকে সর্বপ্রথম মিউটেটেড এই ভাইরাসটির ভয়াবহতার কথা বিশ্ববাসী অবগত হয়। চলমান এই পৃথিবীতে পাল্লা দিয়ে ছুটে মানব সভ্যতার কাঁধে সওয়ার হয়ে মাত্র তিন মাস সময়ের মধ্যে, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, দূরপ্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, সিংহল সমূদ্র থেকে অন্ধকার মালয় সাগর- সব ততদিনে করোনা ভাইরাসের দখলে। যে ইউরোপিয়ানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে রক্তের হোলি খেলা খেলেছিল, সেই ইউরোপের অবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা। প্রতিদিন লাশের মিছিলে যোগ হচ্ছে হাজারো মুখ। পালাবার পথ নেই- উপায় নেই গোলাম হোসেন। পার্ল হার্বারে বোমা ফেলার জিঘাংসায় মাত্র দু’টি এটম বোমা মেরে হিরোসিমা, নাগাসাকি শহর ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছিল যে আমেরিকা, সেই আমেরিকার অবস্থা যেন ঢাল নাই তরোয়াল নাই নিধিরাম সর্দারের মত। করোনা প্রতিরোধ তো দূর অস্ত, শত্রু শনাক্ত করার পর্যাপ্ত সামগ্রী পর্যন্ত তার কাছে নাই। ক্ষুদে এক বাহিনীর কাছে দোর্দন্ড প্রতাপশালী, সৌর্য-বীর্যশীল মানব সভ্যতার (?) কী অসহায় আত্মসমর্পণ! ঠিক এমন সময় বহু কাল অভিধানের পাতায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা লকডাউন শব্দটির নায়কচিত আভির্ভাব ঘটল বিশ্বমঞ্চে।
দেশ থেকে দেশ, প্রদেশ থেকে প্রদেশ, শহর থেকে শহর, এমনকি পড়শীর সাথে আরেক পড়শীর যোগাযোগ বন্ধ। শুধু চাচা আপন প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া না, মামা, খালা, ফুপু, ভাই, বোন সবাই যার যার প্রাণ বাঁচাতে আদা জল খেয়ে যার যার গৃহে গৃহ বন্দি। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষ স্বামী স্ত্রীও- ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি। মানুষে মানুষে দেখা হতে থাকে ফোনে, ফেইসবুকে, ইনস্টাগ্রামে, ভাইবারে, স্কাইপে। যদিও বা কারও সাথে কারও সামনাসামনি দেখা হয়েই যায় সেখানেও দূরত্ব ছয় ফুট।
মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে সারা কানাডা জুড়ে মার্চ ব্রেক, স্কুল কলেজ সব বন্ধ। জান্নাত আর তার স্বামী নওশের দু’জনেই কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে, মেক্সিকোর ক্যানকুনে (Cancun) পুরো পরিবার ভ্যাকেশন কাটাতে যাবে। কিন্তু সেই ভ্যাকেশন আর বাস্তবের মুখ দেখে না। এরই মধ্যে নিউজ চ্যানেল আর ফেইসবুকে বিশ্ব জুড়ে করোনার সব ভয়াবহ ঘটনা শুনে এবং দেখে, অকুতোভয় জান্নাতের মনে প্রথম বারের মত ভয় বিশেষণটি প্রশ্রয় পেতে শুরু করল। মনের দেয়ালের ফাঁক ফোকড় গলে একটু আধটু ভয় উঁকি-ঝুঁকি মারা কেবল শুরু করেছে, এর মধ্যেই জাহানারা বু’র মৃত্যু সংবাদ আসে ন্যু ইয়র্ক থেকে। জাহানারা সম্পর্কে জান্নাতের মামাতো বোন, বয়সে বছর পাঁচেকের বড়। জাহানার বুবুর স্বামী এই তো গেল বুধ বার ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানালো, “আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী জাহানারা কোভিড পজিটিভ, আজকেই কর্নফার্ম করলাম। ওর জন্য সবাই দোয়া করবেন”। রবিবারে খবর আসল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, ভেল্টিলেশন দরকার, কিন্তু পাচ্ছে না। ন্যু ইয়র্ক সিটির হাসপাতালগুলোতে ভেন্টিলেটর নাকি শর্ট। তারও তিন দিন পর খবর আসল জাহানার বুবু আর নেই! খবরটা জান্নাতকে ভ‚মিকম্পের মত বড়সড় এক ঝাঁকুনি দেয়। খুব আদর করত জাহানারা বুবু তাকে। শোকাভূত জান্নাত সংবাদটা শোনার সাথে সাথে তার ফেইস বুকে এক আবেগঘন স্ট্যাটাস দিল। সে লিখল, “মনটা বিষাদে ছেয়ে আছে। জাহানার বুবু এই ধরণীতে নেই। চিৎকার করে কেঁদেছি বহুক্ষণ। দুঃখ বোধ কমেনি অনু পরিমাণ। এও কী সম্ভব? একজন সদা হাসিখুশি, সাদা সিদা, পুরোদস্তুর ভাল মানুষ। এক বুধ থেকে আরেক বুধ, ব্যাস সব শেষ! বাংলাদেশ হলে এক কথা ছিল। কিন্তু আমেরিকার মত দেশে ভেন্টিলেটর শর্ট পরে কিভাবে? চাঁদে, নাকি মঙ্গল গ্রহে, নাকি কোথাকার কোন মহাশূন্যে পাঠানোর স্পেইস সাটল আছে। ইরান-তুরান-আফগান উড়িয়ে দেবার, গুড়িয়ে দেবার মরণাস্ত্র আছে। আর ভাইরাস সনাক্তের kit নাই, প্রাণ বাঁচানোর ভেন্টিলেটর নাই? মানুষের জীবন এতটা মূল্য হীন? জাহানার ব্বুু, তোকে খুউব মিস করব রে। ওপারে ভাল থাকিস বুবু”।
শোকের কারণে লেখাটা লিখে পোস্ট করতে হয়ত কিছুটা বিলম্ব হয়েছিল বটে। কিন্তু লেখাটা পোস্ট করার পর ঝাঁকে ঝাঁকে কমেন্ট আর emojis এ সয়লাব হতে কাল বিলম্ব হল না। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে কমেন্ট আর ইমোজি মিলে সংখ্যা দাঁড়ালো প্রায় সারে চারশ- যা এ’ যাবত কালের সর্বচ্চ রেকর্ড। বেশির ভাগই হার্ট আর স্যাড সিম্বল। শুধুমাত্র একজন বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে লাইক দিয়েছে, আরেকজন দিয়েছে স্মাইলি ফেইস। যে সব হতভাগা শোকের খবরে সুখের সিম্বল দিয়েছে তারা ভুল করে দিলেও, সেই সব হতভাগাদের সাথে সাথে নিজ গুনে ক্ষমা করতে জান্নাত ভুল করলো না মোটেও। কারণ ফেইস বুকিংয়ের আদি জামানায় সে নিজেও একাধিকবার এই ভুল করেছিল। সে যাই হোক, দিনটা শুরু হয়েছিল শোক দিয়ে, অশান্তি দিয়ে। কিন্তু দিন শেষে রেকর্ড সংখ্যক কমেন্ট পেয়ে অশান্তির বদলে যথেষ্ট প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাতে গেল জান্নাত। আর সেই প্রশান্তির নিদ্রাতে বেরসিক দুঃস্বপ্নের আগমন ঘটল এবং ঘটল তার অভিধানে ভয় শব্দটার অশুভ মহরৎ। (চলবে)