মামুন খান : ভয় জিনিসটা জান্নাতারা বেগমের অভিধানে কোনদিনই ছিল না। সেই ছোট বেলার কথা, তখন জান্নাতরা থাকত গ্রামের বাড়ি। ভীষণ ডানপিটে ছিল সে । বাড়ির ঠিক পশ্চিম পাশ ঘেঁষে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে যমুনার শাখা নদী। শুকনো মৌসুমে যে নদীতে কোথাও হাঁটু পানি কোথাও বা কোমর সমান পানি- ভরা বর্ষায় সেই নদীর অন্যরকম ভয়াল চেহারা। সে বছর বানের পানি বাড়ছিল বেশ তরতর করে। নদী ভরা টুই টুম্বুর পানি, সেই সাথে ভীষণ স্রোত। স্রোত আবার জায়গায় জায়গায় ঘূর্ণি পাকের আকার নিয়েছে। পাড়ার একদঙ্গল ছেলে মেয়ের সাথে জান্নাতও নেমেছে ঘোলা জলে সাঁতার কাটতে। তবে ছেলে বুড়ো কারও সাহস হয়না খুব একটা গভীরে যেতে। জান্নাতের সাধ হলো একটু বীরত্ব দেখানোর। তীর থেকে বেশ খানিক দূর পর্যন্ত সাঁতরে পেছন ফিরে সাথীদের উদ্দশ্যে দুই হাত উঁচু করে বলে, হে, হে আমি কতদূর আইছি দ্যাখ, দ্যাখ। ঠিক পরমুহূর্তেই জান্নাতের উচ্চকিত হস্তদ্বয় আর গোচরীভূত হয় না। খেলার সাথীদের চিত্কার করে বলে, গেল জানু গেল! কেউ বা বলে, জানু পাকে পড়ছে! কেউ বা বলে, হায় আল্লাহ্, জান্নাত পানিতে ডুইবা মরল রে মরল!
জান্নাতারা বেগম ওরফে জানু সে যাত্রা মরল না, অতি আশ্চর্য জনক ভাবে বেঁচে গেল। বৈশাখী ঝড়ে বায়ু কুড়ানিতে খর-খুটো আর শুকনো পাতারা যেমন চর্কির মত ঘুরতে ঘুরতে চোখের নিমিষে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে আছড়ে পরে, পাকে আটকা পড়ার সাথে সাথে জান্নাতও তেমনি পলকের মধ্যে এক চক্করেই সা করে তলিয়ে যায়। চরকাটারীর আড়ত থেকে চাল বোঝাই নৌকা নিয়ে ইউনুস ব্যাপারী উজান পথে বাজারের দিকে ফিরছিল। স্রোতের টানে প্রায় আধা মাইল খানেক যাওয়ার পর জান্নাতের ছোট্ট শরীরখানি যখন বাজারের ঘাট ছাড়িয়ে মাঝ নদীতে ইউনুস ব্যাপারীর চাল বোঝাই নায়ের এক বৈঠা দূরত্বে ভেসে ওঠেছিল তখন সে মৃত না জীবিত তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিল না। আর দশজনের বেলায় ঘটনাটি ঘটলে আজীবন তার মধ্যে হাইড্রো ফোবিয়া অর্থাত পানি ভীতি কাজ করত। কিন্তু জান্নাতের বেলায় ঘটেছে উল্টোটা। শুধু পানি ভীতি কেন, ভুত-প্রেত ভীতি, সর্প ভীতি, গুন্ডা-বদমায়েশ ভীতি, মোটের উপর সেই ঘটনার পর থেকে ভয় শব্দটা তার অভিধান থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। টানা হরতাল অবরোধে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। চাচাতো, ফুপাতো ভাই বোনরা মিলে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে জান্নাত। জান্নাতদের বাড়ির দক্ষিণ পাশে বেশ খানিকটা জুড়ে বাঁশ ছোপ, বুনো ঘাস, লতা-পাতা আর ঘন জংগল। জঙ্গল যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু হয়েছে আনিসুল মুন্সীর আবাদী জমি। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা এক সরু পথ কোনাকুনি মিশে গেছে আবাদি জমির আইলের সাথে। দিনের বেলাতে এই পথ দিয়ে লোক জন যাতায়াত করলেও, সন্ধ্যার পর ভুলেও ওই পথ মাড়ায় না। তার কারণ জঙ্গলের মাঝামাঝিতে বিশাল এক তেঁতুল গাছের অবস্থান। গাছটির তেঁতুল অতিব মিষ্ট, আর ধরেও বারো মাস। বৃক্ষের পরিচিতি ফলের কারণে হওয়ার কথা থাকলেও এই বৃক্ষটির নাম ডাক ছিল ভূতের কারণে। তাও আবার যেন তেন ভূত না, নিঃস্কাইন্দা ভূত। নিঃস্কাইন্দা ভূত হচ্ছে এমন এক ভূত, যার কুচকুচে কালো শরীরের উপরিভাগ, অর্থাত কাঁধের অংশ মিসিং। তাই এর নাম নিঃস্কাইন্দা। তিতার মা সহ পাড়ার অনেকেই এই ভূত দর্শনে চিত্কার করে অন দ্যা স্পট জ্ঞান হারিয়েছে। পারত পক্ষে তাই সন্ধ্যার পর কেউ ওমুখো হয় না।
জান্নাত তার চাচাতো, ফুপাতো ভাই বোনদের সাথে বাজি লাগল যে সে সন্ধ্যার পর গিয়ে গাছ থেকে টসটসে পাকা ডোল তেঁতুল ছিড়ে নিয়ে আসবে। আগে ভাগেই একখানা মই তেঁতুল গাছের সাথে হেলান দিয়ে রেখে আসা হলো, সেই সাথে সাব্যস্ত করা হলো কোন ডালের কোন গোছা তেঁতুল পেড়ে আনতে হবে। যে কথা সেই কাজ। অন্ধকার নামার পর পরই হাতে এক হাতে এক লাঠি, আর অন্য হাতে ফ্ল্যাশ লাইট নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল জান্নাত। ফিরল মিনিট দশেক পর, হাতে এক গোছা ডোল তেঁতুল। এমন অকুতোভয় জান্নাতারা বেগম আজকাল ভয় পাচ্ছে। ভয়টা মৃত্যু ভয়।
এ যাত্রায় জান্নাতের অভিধানে মৃত্যু ভয়ের পাশাপাশি আরেকট শব্দের পূণর্জন্ম হয়েছে- তা হচ্ছে ‘অবসর’। সেই কবেকার ধুসর হয়ে যাওয়া ইউনিভার্সিটি লাইফ- বন্ধুদের সাথে আড্ডা, একটু আধটু পড়া লেখা, সেই সাথে নওশেরের হাত ধরে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করা, আর বাকি সময় অখন্ড অবসর। এক সমুদ্র ভালবাসা আর সাথে এক পৃথিবী স্বপ্ন নিয়ে নওশেরের সাথে মালা বদল করেছিল জান্নাত। ফুল দিয়ে গাঁথা মালার পাপড়িরা তখনও শুকায়নি, দুই হাত জোড়া মেহেদীর রাঙা লাল তখনও ফিকে হয়নি। বিয়ের তিন দিনের মাথায় শাশুড়ি তাকে রান্না ঘরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল। পনের সদস্যের একান্নবর্তি পরিবারের বড় বউ জান্নাত। জীবনে অবসরের বিদায় ঘন্টা বেজেছিল তখন থেকেই। তার শাশুড়ি ছিল মোটা দাগের পাঁজি মহিলা, আর তার সাথে যোগ হয়েছিল এক ননাস। মা মেয়ে মিলে তিন তিনটা বছর জান্নাতের জীবনটাকে দৌড়ের উপর রেখেছিল। সেসব তিক্ত স্মৃতি দীর্ঘ দিন তুষারাবৃত থেকে আজ বিলুপ্ত প্রায়। ক্যানাডায় আসার পর সেই দৌড় থামেনি অবশ্য। দেশে থাকতে ছিল বড়জোর দুইশ মিটার স্প্রিন্ট, ক্যানাডায় সেটা এক হাজার মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে শুরু হলো। নতুন দেশ, নতুন জীবন -দৌড় ঝাপ তো একটু আধটু করতেই হবে। একবার থিতু হয়ে বসার অপেক্ষা মাত্র। তাছাড়া এই দৌড়ের মাঝেও আলাদা এক প্রশান্তি ছিল, শীতের সকালে শিশিরের পরশের মত। নিজের সংসার, স্বামী, সন্তান- সব নিজের। কেউ ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস নেবার নেই।
দেখতে দেখতে দিন, মাস, বছর ঘুরে যুগ ছুঁয়েছে। হাজার মিটার স্প্রিন্ট বেড়ে কয়েক হাজারে ঠেকেছে। এ কাজ,ও কাজ, এ কোর্স, ও কোর্স, মা হওয়া, মা হওয়ার পরের দায়িত্ব, আবার কর্ম জীবনে ফেরা- সব মিলিয়ে অবসর শব্দটা ডায়নোসোরের ফসিল পর্যায়ে ঠেকেছিল যেন। দেশ জোরা লকডাউনের ফসল, সেই কাংখিত অবসর আজ বিনা নিমন্ত্রনে হাজির। স্বামী স্ত্রী আর দুই ছেলে- জুবা্যরে ,আবরারএই নিয়ে জান্নাতের সংসার। বড় ছেলে আবরার, বয়স তের- গ্রেইড এইটে যায়। আর ছোটটা জুবায়ের ওরফে জান্টুস। এখনো মাটির সাথে কথা বলে, বয়স মাত্র সাত। বড় জন আগা গোড়াই বাপ ভক্ত। কিন্তু ছোট জান্টুস মা অন্ত প্রাণ। মা কাজে যায় না, বাড়িতে থাকে- এটা জানটুসের কাছে একাধারে অতি আশ্চর্য, সেই সাথে অতি সুখকর একটা বিষয়। সারাদিন সে মায়ের গা ঘেঁসেই কাটাতে চায়। হয়ত জান্নাত সোফায় বসে টিভি দেখছে অথবা কাত হয়ে শুয়ে স্মার্ট ফোন ব্রাউজ করছে। এমন সময় পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরবে জান্টুস।
-কেরে এইটা? আমার জান্টুস বাবা, আমার কলিজা বাবা! একি তুমি কান্না করসো কেন? হোয়াট হ্যাপেনড?
-ভাইয়া pushed me.
-ভাইয়া পুশ করেছে? এত বড় সাহস। দেখি বাবা দেখি কোথায় পুশ করেছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিবে জান্নাত। ততক্ষণে জানটুসের কান্না থেমে গেছে।
-Mom, are you going to work tomorrow? মায়ের গালে গাল ঘষে প্রশ্ন করবে জুবায়ের।
-No, baba. I am not going to work. Happy? মায়ের মুড আজকে ভাল বুঝতে পারবে ছোট্ট জান্টুস। তাই টুস করে তার আর্জিটা মায়ের কাছে পেশ করবে। বলবে, Mom, can I get a Bey blade?
-সব স্টোরতো এখন বন্ধ বাবা।
-অর্ডার অনলাইন।
ছেলের আবদার ফিরিয়ে দিতে পারে না জান্নাত। এমনি করে অনেক রকমের দাবি দাওয়া, ছেলেটা এ’কদিনে একে একে আদায় করে নিয়েছে। বেশ কঠিন মনের অধিকারি জান্নাত এই ছোট্ট মানুষটির সাথে কেন যেন কঠিন হতে পারে না। কেনই বা হবে? প্রথম বার হবার পর তাকে দশটা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে দ্বিতীয় বার মা হবার জন্য। বিশ্বাস না থাকলেও, তাবিজ-কবজ, পড়া পানি, এমনকি স্কাইপে ঝাড়ফুঁক পর্যন্ত নিয়েছে আরেকটি বার মা হবার জন্য। বংশিয় নামের ধারাবাহিকতায় জান্নাতের শ্বশুর সমশের নেওয়াজ, নাতির নাম রেখেছে জুবায়ের নেওয়াজ। কিন্তু জান্নাতের কাছে সে জানটুস- আর কিছু না। যথেষ্ট অন্যায় সে করে ফেলেছে বাচ্চাগুলোর উপর। বড়টা তো এখন ডাকলেও কাছে আসে না। ওর বয়স যখন এক তখন জান্নাতরা প্রবাস জীবন শুরু করেছিল কেবল। হাজার মিটার স্প্রিন্টের সময়- ডাবল শিফট কাজ। ডে কেয়ার অথবা বেবি সিটারের কাছেই কেটেছে ছেলেটার শৈশব। সে সময় নওশের পড়াশোনা করত, বিকেলের পর সে বাসাতেই থাকত। তাই বাপের সাথে বন্ধন কিছুটা হলেও মজবুত। ছোটটার জন্মের পর এক বছর ম্যাটার্নিটি লীভ পেয়েছিল। সেই সুবাদে মায়ের সাথে ছোটজনের বন্ধন ভাল।
স্বামী, সংসার, সন্তান ফেইস বুক, হিন্দি সিরিয়াল- সব মিলিয়ে লকডাউনের দুইটা সপ্তাহ মোটামুটি মধুচন্দ্রিমা মুডে কাটল জান্নাতের। কিন্তু পাতিল দুইটা একসাথে করলে যা হয় আরকি- ঠোকাঠুকি। শুরু থেকে হালকা পাতলা গড়নের ঝামেলা হলেও, মূল বিপত্তি শুরু হলো তৃতীয় সপ্তাহ থেকে, যখন নওশের কাজে ব্যাক করল। কাজে ব্যাক বলতে হোম অফিস। বরাবরই নওশের একটু অলস প্রকৃতির। কথিত মধুচন্দ্রিমায় সব কিছু তৈরী পেতে পেতে সেই আলসেমির মাত্রা বহুগুণে বেড়ে গেছে। সকাল আটটায় কম্পিউটারের সামনে বসে আর ওঠে সেই পাঁচটায়। এর মধ্যে নাস্তা, খাবার, কফি সব টেবিলে দিয়ে আসতে হয়। পানির পিপাসা ধরলেও ডেস্ক থেকে চেঁচিয়ে বলবে, জানু, এক গ্লাস পানি দাও না প্লীজ।
জান্নাত যেন তার প্রাইভট নকরানী। হোম অফিস করে যেন স্বর্গটা কিনে নিয়েছে। অফিস আওয়ার শেষ হলে সোফার মধ্যে আসন গেড়ে বসবে টিভির সামনে। সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরা আর সাথে লোকাল সিবিসি বা সিপি টুএন্টি ফোর। ঘুরে ফিরে একই খবর। কত জন আক্রান্ত, কত জন মারা গেল, কোন দেশে লাশ রাস্তায় পরে আছে- এই সব। এসব নিউজ জান্নাতের মৃত্যু ভয়কে আরও উসকে দেয়, আগুনে ঘি ঢালার মত। (চলবে)