মামুন খান : টানা দুই সপ্তাহের উপরে গৃহে অন্তরীণ থাকার পর সেদিন ওরা দুজনে ওয়ালমার্টে গেল গ্রোসারী করতে বলতে গেলে বাধ্য হয়েই। নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছুতেই ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। এধরনের বড় মার্কেটগুলো স্বাস্থ্যবিধি অর্থাৎ সামাজিক দূরত্ব মেনেই অপারেট করার কথা কিন্তু বাস্তবে সোস্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করা কাঠালের আম সত্তের মত। ডাবল মাস্ক আর হ্যান্ড গ্লাভস পরে স্টোরের ভেতরে গিয়েছিল জান্নাত। তারপরও গ্রোসারী থেকে ঘরে ফিরে তার মনে হলো সারা গায়ে, কাপড়চোপড়ে যেন ভাইরাস কিলবিল করছে। ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ছোট ছেলে দৌড়ে আসে মায়ের কাছে।
– না না বাবা কাছে আসে না বাবা। আগে গোসল করে ক্লিন হয়ে নেই। তারপর কোলে নিব, ওকে বাবা?

মায়ের কথায় মাঝপথেই থেমে যায় জানটুস। বলে, কি এনেছ?
– এনেছি বাবা অনেক কিছু। আগে স্যানিটাইজ করতে হবে তারপর। যাও এখন ভাইয়ার সাথে খেলতে থাক। I’ll call you when sanitizing is done. অনিচ্ছা সত্বেও জানটুস ফিরে যায় ভাইয়ের কাছে।
– কই আস। হাতে হাতে জিনিসগুলি স্যানিটাইজ কর, তারপর পরনের কাপড় জামা সব লন্ড্রিতে দিয়ে গোসলে যাও।
– Don’t over react. মৃত্যুকে এত ভয় করলে চলে?
– কত্ত বড় ঈমানদার। মৃত্যুকে ভয় করবে না আলিঙ্গন করবে? ঈমানের এত জোর? তা সেদিন ব্যাক ইয়ার্ডে ছোট্ট, পুচকে একটা Garden snake দেখে তিন লাফ দিয়ে ঘরের ভিতর লুকাইছিলা ক্যান? কাজে হাত না লাগাতে চাও ঠিক আছে, কিন্তু দয়া করে ছেলে দুইটার দিকে তাকিয়ে হলেও অন্তত গোসল কর।

জান্নাতের শেষের কথাটিতে মাঝারি স্বাদের ঝাঁঝ মেশানো। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে আসন্ন এক ঝড়ের আলামত টের পায় নওশের। তাই কথা আর না বাড়িয়ে হুকুম তামিল করতে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। ভেতরের গোস্বা দমন করে সদ্য কিনে আনা গ্রোসারীগুলোকে যথা সাধ্য স্যানিটাইজ করে নিজেও ওয়াশরুমে ঢুকল জান্নাত। গোসল সেরে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে জান্নাত বলল- এই শোন না, আমার গলাটা কেমন যেন ব্যথা করছে। ব্যথা মানে কেমন যেন একটু চুলকাচ্ছে।
টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই নওশের বলে, বনের বাঘে ধরে নাই তোমাকে, মনের বাঘে ধরেছে।
– মানে কী? আমি বললাম আমার গলা ব্যথা। আর তুমি বলতেছ হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুক- এসব কী?
কথাটা ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল নওশের। আর এরকম ঠাট্টা মস্কারা বোঝার মত যথেষ্ট রস বোধ তার স্ত্রীর মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু আজকে পরিস্থিতি বেগতিক। পরিস্থিতি বেগতি থেকে স্বাভাবিক গতিতে আনতে সচেষ্ট হয় সে। বলে, আরে বোকা ও কিছু না। আদা দিয়ে এক কাপ গরম চা খাও, দেখবা সব ঠিক হয়ে গেছে।
উস্মার দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বেডরুমের দিকে চলে যায় জান্নাত। যাওয়ার আগে ছোট্ট করে বলল, থ্যাংকস ফর ইওর এডভাইস।
বেডরুমে এসে মিনিট পাঁচেক থম ধরে বসে থাকে জান্নাত। রাগ দমন করার চেষ্টা করছে সে। কেমনতর মানুষের সাথে ঘর করছে সে? গলা ব্যথা হচ্ছে শুনে একটু সহানুভুতি কি প্রকাশ করা যেত না? বলতে তো পারত, জানু বসো, আমি কুইক আদা চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। শুধু আজকের ঘটনা বলে কথা না। এরকম অবহেলা সে বহুবার পেয়েছে মানুষটার কাছ থেকে। নিজেকে নিজে অনেক প্রশ্ন করেছে জান্নাত- এই মানুষটিকে কি দেখে সে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিল?
একটা ফোনের আওয়াজে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে জান্নাত। বাংলাদেশ থেকে মা করেছে।
– হ্যালো, মা কেমন আছ?
– আমি মা না, আমেনা খালা।
আমেনা খালা জান্নাতের আপন খালা না, গ্রামতুত খালা। জান্নাতের মায়ের সাথে থাকে।
– খালা কেমন আছ? কি করতেছ?
– আর কইস না রে মা টিভিতে লকডাইন দেখি।

দীর্ঘ দিন যাবত টরন্টোর মত পশ্চিমা শহরে থাকলেও অর্ধ শিক্ষিত এই খালাটির সাথে তার এক দিকে খুব মিল আছে। খালা আর সে দুজনেই সোনি টিভি, জি-টিভিসহ আরও কত কি টিভির সিরিয়ালগুলোর একনিষ্ঠ দর্শক। ‘লকডাউন’ নিশ্চয়ই নতুন কোন সিরিয়াল হবে, যেটা সম্পর্কে সে এখনও ওয়াকিবহাল না। নিজের অজ্ঞতায় নিজে নিজে যারপরনাই শরমিন্দা হয় জান্নাত। অতঃপর লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে শুধায়, ও খালা, নতুন সিরিয়াল না? কোন চ্যানেলে? অর্ধশিক্ষিত আমেনা খালা, বসনে-ভূষণে অতি পশ্চিমা এই ভানজিটির মূর্খতায় খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে, মানুষ মইরা সাফা। তুই আছস সিরিয়াল নিয়া। বাংলাদেশে আইজ থিকা মিলিটারি নামছে। বাড়ির বাইরে দরকার ছাড়া বাইর হওন মানা, সারা দ্যাশে লকডাউন। তোগো অইহানে কী অবস্থা? খালার বকুনি-ঝাঁকুনিতে জান্নাত বেগমের হূশ ফিরে আসে। যে খালা ভারতীয় টিভি চ্যানেল, আর সিরিয়ালের ভাষায় কথা বলা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কথা বলা জানত না, সে আজ কী ভাষায় কথা কইছে!

ওই প্রান্ত থেকে খালা তখনও বকবক করে চলছে, চীন দ্যাশ থিকা কি অচিন পোকা না জানি ভাইরাস আসল রে মা খালি চোখে দেখাও যায় না। একটা জিনিস আমি বুঝি না- এত ছুডো জিনিস মাইনষেরে কামড়ায় ক্যামনে? আমেনা খালার কথা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার উপক্রম- ব্যাপক বিনোদন। এই বিনোদন ফেইসবুকে শেয়ার না করলেই নয়। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং তা থেকে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, বিনোদনের ধাক্কায় আবারও ফিরে আসার অঙ্গীকার করে আপাতত ইতি টানল।

তিন.
বাচ্চারা আর তাদের বাবা মিলে ব্যাকইয়ার্ডে একটা তাবু টানিয়েছে। বাড়ির আঙ্গিনায় ক্যাম্পিঙ্গের আবহ- সবাই বেশ উচ্ছ¡সিত। সদ্য কেনা আই ফোন ১১-প্রো দিয়ে একের পর এক বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলছিল জান্নাত। দিন রাত মিলে, বিশেষত রাতের বেলায় প্রপেইন চালিত হ্যাজাক বাতি হাতে তাঁবুর সামনে দাঁড়ানো ছবি গুলি দেখলে যে কেউ ভাববে অরিজিনাল ক্যাম্পিং।
– নসু, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে বুঝলা?
– কী?
– একটা পোস্টিং দিব ফেইসবুকে এই ছবি, সাথে আরও কয়েকটা ছবি দিয়ে। টাইটেল হবে- “করোনার দিন রাত্রি”।
– অরণ্যে দিন রাত্রি স্টাইলে?
– ঠিক ধরেছ।
– তুমি ফেইস বুক সেলিব্রিটি মানুষ। ভালই হবে।
স্বামীর খোঁচা এই মুহূর্তে গায়ে মাখার ইচ্ছা নাই তার। মাথায় তার আরেকটা আইডিয়া এসেছে। লকডাউন শুরু হওয়ার মাত্র তিন দিন আগে নতুন সোফা সেটটার ডেলিভারি এসেছে। হাতলে বেইসে আর পেছনে মেহগনি কাঠের সুক্ষ কারুকাজ, অফ হোয়াইট ফেব্রিক্সের উপর সোনালি কাজ- বেশ একটা রাজকিয় ভাব আছে। লিভিং রুমের সাথে মিলিয়ে বেডরুমের সেটও কিনেছে- Astoria Grand ব্র্যান্ডের।

খাজনা পাতি দিয়ে দাম পরেছে পনের হাজারেরে মত। দুঃখ এই যে এত দামি আর সুন্দর ফার্নিচার এখনও কাউকে দেখাতে পারেনি সে, শুধু প্রতিবেশি নাহার ছাড়া। ডেলিভারির সময় নাহার তার বোরকার আড়াল থেকে উঁকি মেরে দেখে বলেছিল, খুব সুন্দর হয়েছে ভাবি।
অন্য কেউ হলে ফেইস বুকে সাথে সাথে পোস্ট দিয়ে দিত। কিন্তু জান্নাত আদেখলাদের মত যত্র ছবি পোস্ট করার বিপক্ষে। তবে এখন একটা মওকা এসেছে বটে। (চলবে)