মণিজিঞ্জির সান্যাল : নানা নিয়ম-আচারের মাধ্যমে জামাই ষষ্ঠীর ব্রত পালন করেন শাশুড়ি মায়েরা। জামাই ও মেয়ের মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালন করেন তাঁরা।
বাঙালিদের কাছে জামাই ষষ্ঠী অত্যন্ত জনপ্রিয় উত্সব। নানা নিয়ম-আচারের পাশাপাশি পরিবারের সবার জন্যেই প্রচুর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
তবে পুজোর নিয়মের পাশাপাশি এমন কিছু নিয়ম রয়েছে যা জামাই ষষ্ঠীর দিন পালন করলে মেয়ে-জামাই সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাতে পারবে। আসলে মায়েদের মন সবসময়ই সন্তানের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। তাদের ভালোর জন্য পৃথিবীর যে কোনো নিয়ম নীতিই তাঁরা পালন করতে প্রস্তুত।
তাছাড়া এক একটা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সবাই একসাথে মিলিত হওয়া, একসাথে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া, হাসি ঠাট্টা আড্ডা।
এই দিনটিতে বিশেষ কিছু নিয়ম নীতি পালন করা হয়। মায়েরা মেয়ে এবং জামাইকে সুখী রাখতে, আনন্দে রাখতে কিছু নিয়ম, কিছু আচার পালন করে থাকেন। যেমন —
জামাই ষষ্ঠীর দিন জামাই যাতে একা শ্বশুরবাড়িতে না-আসেন। এ দিন জোড়ে প্রবেশ করার কথা বলা হয়।
আসলে মায়েদের মন সবসময়ই ব্যাকুল থাকে সন্তানদের জন্যে। তারা চেষ্টা করেন সেই নিয়ম নীতি সুন্দর করে পালন করতে। জামাই ষষ্ঠীর এক দিন আগে বাড়ির ঈশান কোণে গঙ্গাজল ভরতি তামার ঘট রাখেন কেউ কেউ। তাতে থাকে একটি তুলসি পাতা। জামাই ষষ্ঠীর দিনে মেয়ে-জামাই বাড়ি এলে সেই জল মেয়ে-জামাইয়ের ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
এই দিন পাঁচ বা সাত পাক করা সাদা সুতোয় হলুদ মাখিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে রেখে দেওয়া হয়। পুজোর পর বেঁধে দেওয়া হয় সেই সুতো জামাইয়ের হাতে। এই দিন ঠাকুরের সিঁদুর নিয়ে জামাই এবং মেয়েকে তিলক পরানো হয়। এতে সুখী হয় মেয়ে-জামাইয়ের দাম্পত্য জীবন।
এরপর জামাইকে বরণ করে মিষ্টি খাওয়ানোর পর সাদা জল না-দিয়ে কাঁচের গ্লাসে ডাবের জল দিলে নাকি ল²ী সন্তুষ্ট হয় এবং জামাইয়ের জীবন শুভ শক্তিতে ভরে ওঠে।
এইদিন জামাইকে হলুদ রঙের বস্তু উপহার দিলে ভাল।
জামাইকে বরণ করার পর তার হাতে একটা নীল অপরাজিতা ফুল দিলে ভাল হয়। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসে কীভাবে শুরু হয়েছিল জামাই ষষ্ঠী পালন? এই পার্বণের একটা পৌরাণিক কাহিনি আছে। ঘটা করে জামাইষষ্ঠী পালন অনেকেই করেন কিন্তু এর ইতিহাস জানেন কি?
এইদিনটির জন্য বাঙালি মায়েরা অধীর আগ্রহে বসে থাকেন। অন্যদিকে দূর দূরান্ত থেকেও মেয়ে, জামাই উপস্থিত হয়। ঝলমল করে ওঠে পুরো বাড়ি। চারপাশের পরিবেশেও খুশির ছোঁয়া। পাটভাঙা নতুন পোশাক, গায়ে সুগন্ধি। হাতে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে জামাই আপ্যায়ণের রীতির সঙ্গে বাঙালিরা ওতোপ্রোতোভাবে পরিচিত। থালা সাজিয়ে পাঁচ রকম ভাজা, নবরত্ন, নানান পদ, কচি পাঁঠার মাংস, পদ্মার ইলিশ, লাল দই, মিষ্টি। সাথে আম, লিচু তো আছেই। সুন্দর হাতের কাজ করা পাঞ্জাবী আর মালকুচি করা ধুতি পরে ও মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে জামাই হাজির হয় শশুর বাড়ী।
মেয়ে ও জামাইয়ের মঙ্গল কামনায় এ দিন মেয়ের বাবা-মা তাঁদের মনপ্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেন। পঞ্জব্যঞ্জনে তাঁদের আদর-আপ্যায়ন করেন। ষষ্ঠীর ফোঁটা কপালে দিয়ে, হাতে হলুদ সুতো পরিয়ে, পাখার বাতাস করে মেয়ের জামাইয়ের সুখী দাম্পত্য জীবনের কামনা করেন।
পুজোর সময় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য পৃথক মালসার মধ্যে নতুন বস্ত্র, ফলফলাদি, পান-সুপারি, ধান-দূর্বা ও তালের পাখা রাখা হয়। ভক্তরা উপোস রেখে মায়ের পূজা করেন। মালসা থেকে নতুন বস্ত্র পরিধান করে ফলফলাদি খেতে হয়। চোখ বন্ধ করে ভাবতেই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। আহা! থালায় সাজানো রকমারি পদ। ইলিশ-চিংড়ি থেকে শুরু করে থরেথরে সাজানো সব সুস্বাদু খাবার। শেষপাতে মণ্ডা-মিঠাই কী নেই! ওদিকে শাশুড়ির ষষ্ঠী নিয়মও রয়েছে। তা এই যাদের জন্য এত আয়োজন, মানে জামাই, তাদের এই ষষ্ঠীপালনের রীতির সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল জানতে ইচ্ছে করে বৈকি। জামাইষষ্ঠী আদতে লোকায়ত প্রথা। ষষ্ঠীদেবীর পার্বণ থেকেই এই প্রথার সূচনা। সেই বৈদিক সমাজ থেকেই জামাইষষ্ঠী পালন করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের ষষ্ঠী তিথির প্রথম প্রহরে ষষ্ঠীদেবীর পুজোর আয়োজন করা হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস, ষষ্ঠীদেবী আসলে মাতৃত্বের প্রতীক। তাঁর বাহন বিড়াল। মূলত সন্তানের কল্যাণ ও সংসারের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করাই এই পুজোর উদ্দেশ্য। বঙ্গসমাজে ‘জামাইষষ্ঠী’ উত্সবের সামাজিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষ করে যে পরিবারে সদ্য বিবাহিতা কন্যা রয়েছে, সেই পরিবারে তো রীতিমতো ঘটা করে পালন করা হয় এই পার্বণ।
কিন্তু কীভাবে সূচনা এই আনন্দ-পার্বণের? লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, এক গৃহবধূ স্বামীগৃহে নিজে মাছ চুরি করে খেয়ে দোষ দিয়েছিল বিড়ালের উপর। এরপর হঠাত্ই একদিন তার সন্তান হারিয়ে যায়। একে তার পাপের ফল মনে করে। তখন সে বনে গিয়ে ষষ্ঠীদেবীর আরাধনা শুরু করে। দেবী তুষ্ট হন। যার ফলে বনেই সে নিজের সন্তানকে ফিরে পায়। এই জন্যই ষষ্ঠীদেবীর অপর নাম অরণ্যষষ্ঠী। এদিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার অপবাদে মেয়েটির শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে তার বাবার বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এমতাবস্থায় মেয়েকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে তার মা-বাবা। একবার ষষ্ঠীপুজোর দিন মেয়ে-জামাইকে সাদরে নিমন্ত্রণ জানান তারা। পুজোর দিনে সস্ত্রীক জামাই শশ্বরবাড়িতে উপস্থিত হলে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় পরিবারে। আর সেই থেকেই ষষ্ঠীপুজো রূপান্তরিত হয় জামাইষষ্ঠীতে। যা সুদীর্ঘকাল ধরে পালন করে আসছেন বাঙালিরা। এই ঘটনা গল্প হোক বা সত্যি হোক, জীবনে কোনো কিছুর তো একটা সূচনা থাকে, বা অন্যভাবে বলা যায় সবকিছুর তো একটা উত্স থাকে। ধরে নেওয়া যাক এই উত্সবের পেছনে এমনই একটা গল্প ছিল।
আবার দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গায় এই উত্সবের পেছনে একটু অন্যরকম গল্প আছে। সেখানেও এই অনুষ্ঠান জামাইকে কেন্দ্র করে হলেও মনের মধ্যে প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। জামাইদের উদ্দেশ্যে কেন করা হয় এই পুজো? আসলে অনেক আগে দক্ষিণ এশিয়ার বহু জায়গায় এক সংস্কার ছিল যে, বিবাহিত মেয়েরা তার বাপের বাড়িতে আসতে পারবে না যতক্ষন না সে সন্তানসম্ভবা হচ্ছে।
এর ফলে দীর্ঘ দিন কেটে যেত কিন্তু মেয়ের সাথে মা, বাবার কোনও যোগাযোগ হতো না। এই প্রথার সমাধান করতেই ধীরে ধীরে তার স্বরূপ বদলে গেল। নতুন একটা প্রথা চালু হল। বিবাহিত মেয়ের মা ও বাবা মেয়ের শশুর বাড়িতে এক বছর না হওয়া অবধি কোনো কিছুই খেত না। তবে জামাই ও মেয়ে তার বাবার বাড়িতে আসতে পারে। জামাই ও মেয়ে আসার কারণে বাড়িতে এক খুশির জোয়ার নেমে আসে এবং জামাই ও মেয়ের শুভ ও দ্রুত সন্তান কামনায় এই ষষ্ঠী দেবীর পুজোর ব্যবস্থা করা হয়।
জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম শুক্লা ষষ্ঠীর দিনটিকে বেছে নেওয়া হয় এই পুজোর জন্য। শাশুড়ীরা খুব ঘটা করে জামাই এর হাতে হলুদ মাখানো সুতো পরিয়ে আশীর্বাদ করে। হিন্দু সমাজে এই উত্সবের মাহাত্ম অনস্বীকার্য।
জামাই ষষ্ঠী একটি লোকায়ত প্রথা যা কেউ কেউ ঘট স্থাপন করে করেন। কেউ বা প্রতিমায় পুজো নিবেদন করেন। এই ছিল জামাই ষষ্ঠীর কাহিনি।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ