হিমাদ্রী রয় : ভালো আছি বলা যায় অবলিলায়, কতটা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি সবার সাথে যেমন ভাগ করা যায় না, তেমনি প্রাণ খুলে হাসা যায় সারাদিন অনেকের সাথেই কিন্তু বুক ভাসিয়ে সবার সাথে কাঁদা যায় না। কেননা বুকের কাছে ভাই বলে টেনে নিতে পারে এমন ভালোবাসার মানুষ সবার অদৃষ্টে হয় না; যে মায়ার ঝাপ্পি দিয়ে বলবে কেঁদো না সব ঠিক হয়ে যাবে, জীবনের চাকা তো ঘুরতেই হবে কখনো উঁচু নিচু কভু সমান্তরাল কখনো শিশির ভেজা নরম ঘাসে।

সৃষ্টি রহস্যে ঘেরা জীবনের দুখ-শোকের সাথে যেমন কান্না জুড়ে দিয়েছে আবার সময়ের সাথে সবকিছু ভুলিয়ে দেয়ার শক্তিও দিয়েছে। তবে মুছে দিতে পারে না কিছুই। কোন কোন শোক আড়াল হয়ে থাকে আমাদের যাপনের হাসিখুশির গভীরে। অতটা গভীরে আমরা কেউ হয়তো তলিয়ে দেখি না কিংবা দেখতে চাই না ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’।

গোটা পৃথিবী তিনটি বছর ধরে মরণ ঘুমে আচ্ছন্ন বাতাসে উড়ায় ধুপের গন্ধ আর বিন্নি ধানের খই, বুকের আকাশে বেহাগের সুরে বেজে উঠে মনের আড়ালের সমস্ত বিরহবেদনা, শ্রাবণের ধারার মতো পড়ে ঝরে। হিমের পরশ বেয়ে দিনের শেষে আলোয় ছায়ায় মাখামাখি হয়, মন ঘিরে থাকে অজানা সংশয়, কে বুঝি চলে যায়। এভাবেই দিনঘড়িটার কাটা বাঁধা কালের রথের চাকায়।

এমন বিষাদময় শুস্ক হৃদয়ে কান্নার বাঁধ ভাঙা সংবাদ দিলো ফেইসবুক। অতি আপনজনের মা মাহমুদা বেগম পরিস্কার চলে গেলেন সেই এক বৈকুন্ঠের দিকে যে পথে আমার মা বিন্দু বাসিনী খুকি গেছেন এগারো বছর আগে অনন্তের ডাকে। অজান্তেই চলে গেলাম কান্না নদীর কাছে দেখি সেও বিক্রি হতে হতে শুকিয়ে প্রায় মরা, বিনা দামদরেই বিক্রি হয়ে গেল আমার চোখের কাছে।

বিষাদের রাস্তা ধরে হাজির হলাম সেই ব্যাথার শামিয়ানা তলে এই গতকাল পর্যন্ত এখানে প্রশান্তি ছিল, হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে তবু পৌষের ঘ্রাণ মাখা পিঠা-পুলি আর মা মা গন্ধ ছিলো আজ শুধুই গন্ধ বিধুর ধূপ।
দুই অভাগা মিলে দুঃখের পাঁচালি ভাগাভাগি করে পেলাম ছোট ছোট সুখের মোতি যা মায়া নামের ধাগায় গেঁথে গেঁথে রাখা। মায়ার এই বেঁচে থাকায় ব্যাথা আছে কিন্তু উপশমের দাওয়া নেই শুধু সয়ে সয়ে যাওয়া।

সব পরিস্থিতিতে যে স্থিতি স্থির রেখে ধৈর্য ধরে থাকতে পারে, পাশে বসাতে পারে, সেই তো বন্ধু-ভাই, যাকে ভালো নেই বলা যায় যার কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদা যায়। সেই সদ্য মাতৃবিয়োগে ভাইটির পাশে গিয়ে বসলাম, ফোনের ওপার থেকে তার কোন বাল্যবন্ধু কেঁদে সান্ত¡না দিচ্ছে যার স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে সেই মমতাময়ী মায়ের হাতের বেলনা ঠেলা আটার রুটি কিংবা মাছের ছালন আমাদের ভাটীর দেশের খাওয়ন। হায় মমতা সাদা পালকে মোড়ানো মমতা, সময় এত কিছু ভুলায় তবু মুঠামুঠা কুড়ানো স্নেহ করে লালন।
সন্তানের গল্পে দেখা সেই মাকে প্রথম চোখে দেখি অবশ্যই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে গেল বছর যখন কবি দেলওয়ার এলাহী বাংলাদেশে। মায়ের কাছে বসে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘আম্মা ওই দেখ আমার আরেকটা ভাই হিমাদ্রী তার বাড়িও বিথঙ্গল’। সেদিন চেনা মমতাকে খুঁজে পেয়েছিলাম অচেনা হাসিতে, এগারো বছর যে হাসি ধরে আছে শুধু ছবিতে।
এক জলবায়ুর মানুষ এক মমতার ক্যানভাস, এক প্রকৃতিতে বাস। সর্ষে ক্ষেত, হেলেঞ্চার ঝুপ, কচুর লতি, ঈদ-পূজা আর পার্বণের প্রেমে যারা কাটিয়ে দেয় সারাটা জীবন তিনিও আমার ছবি হওয়া মায়ের মতই একজন। কারো কাছে কাবা আর জান্নাত কারো কাছে কাশী ঘাটে স্বর্গের মান্নত।

আজ যখন মাকে হারিয়ে কবি দেলওয়ার এলাহী কাঁদছিলেন হাপুস নয়নে আর ফোনে তার ছোট বোনটিকে বলছিলেন শেষ শয্যায় শোয়ানো মায়ের মুখটি দেখানোর জন্য, পাশে থেকে ভাবী আওয়াজ দিলেন ভাই আপনিও দেখুন- মনে হলো এই বিচ্ছেদ পর্বোটা তার মত আমারও এসেছিল, শুধু তখন হাতে হাতে প্রযুক্তি ছিলো না অসহায় হয়ে বসে ছিলাম। সম্বিত ফিরে দেখলাম সদ্য গোসল করিয়ে শোয়ানো প্রশান্ত মনোহর আবহমান কালের মায়ের মুখ।
এক বুক শূন্যতা দিয়ে চলে গেছেন এক জীবন থেকে অন্য জীবনে, সব চলে যাওয়া মায়েরা থাকেন যেখানে।

শূন্যতার হাহাকার নিয়ে দুই অভাগা একে অন্যকে জড়িয়েছি আলিঙ্গনে। কিন্তু একি জলের দামে কেনা শুকনো মরা নদী যা বয়ে চলে আমার চোখে সেই একই নদী থৈথৈ প্রবাহমান অভিভাবক-বন্ধু-বড় ভাই কবি দেলওয়ার এলাহীর বুকে।
বাসায় ফিরছি নিয়ে মন কেমনের দুপুর মাথায় তখনও বেহাগের সুর।
‘তোমারই সুরটি আমার মুখের পরে বুকের পরে
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে’।