অনলাইন ডেস্ক : চেভি ওকলির জন্ম যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। বেড়ে উঠেছেন কর্ণওয়ালে। মাত্র ছয় বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে প্রায় শতভাগ শ্বেতাঙ্গ অধ্যূষিত এক শহরে আসার আগে পর্যন্ত কখনো বর্ণবৈষম্যর শিকার হননি চেভি। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমের কর্ণওয়ালের জনসংখ্যার ৯৮ দশমিক ২ ভাগই হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইংল্যান্ডের সবচেয়ে কম বৈচিত্র্যময় কাউন্টি।
সেখানে আসার পর চেভি ওকলিকে মারাত্মক সব বর্ণবাদ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া কোন গাড়ি থেকে কেউ ছুঁড়ে দিচ্চে বর্ণবাদী মন্তব্য। স্কুলে যখন পড়ানো হচ্ছে দাস ব্যবসার ইতিহাস, তখন যেন পুরো ক্লাসে চেভিকে যেন হঠাৎ আলাদা করে দাঁড় করানো হচ্ছে সবার সামনে। ২০ বছর বয়সী চেভি বিবিসির কাছে বর্ণনা করেছেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি শ্বেতাঙ্গ অধ্যূষিত এক শহরে কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তার বেড়ে উঠার কাহিনি।
‘প্রথম বর্ণবৈষম্যের স্মৃতি’
বিবিসি প্রতিনিধিকে চেভি ওকলি বলেন, আমার জন্ম লন্ডনে। জন্মের পর থেকে আমরা সেখানেই থাকতাম। যখন আমার বয়স ৬ বছর, তখন আমার মার সঙ্গে আমরা কর্নওয়ালের ক্যামবোর্ন শহরে চলে এলাম। আমার মায়ের পরিবার সেখানেই থাকতো। সেজন্য আমরা ক্যামবোর্নে চলে আসি যাতে মায়ের পরিবারের কাছাকাছি থাকতে পারি।
আমার মা শ্বেতাঙ্গ আর বাবা জ্যামাইকান কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আসলে আমি কোনদিন বর্ণবাদের শিকার হইনি।
স্কুলে একেবারে শিশু বয়সেই প্রথম বর্ণবাদী আচরণের শিকার হন চেভি ওকলি। তখন তিনি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স হয়তো সাত বা আট বছর। কর্নওয়ালে যাওয়ার এক বছর পরের ঘটনা।
স্কুলে একটা ছেলে আতাকে ব্রাউনি (বাদামী মেয়ে) বলে ডাকা শুরু করলো। ডাকটা শুনলে তিনি বিভ্রান্ত বোধ করতেন। ফলে ছেলেটি আরও বেশি করে তাকে ওই নামে ডেকে খেপাতো।
এটা শুধু আমার বর্ণবৈষম্যের প্রথম স্মৃতি নয়, এটা আসলে আমার জীবনেরও প্রথম স্মৃতি। আমার মনে আছে আমার মা স্কুলে এসে এই ছেলেটির মায়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই মহিলা তখন কাঁদছিলেন। তার ছেলে যে এরকম একটা কাজ করেছে সেটা নিয়ে তিনি খুব মন খারাপ করেছিলেন, আর অপরাধবোধে ভুগছিলেন।
আমি যখন লন্ডনে ছিলাম, তখনও স্কুলে যেতাম। তখন আমি নার্সারি ক্লাসে এবং স্কুলের একেবারে সবচেয়ে নিচের ক্লাশের ছাত্রী। স্কুলে আমার যারা সহপাঠী ছিল, তাদের মধ্যে বিশ্বের নানা দেশের লোকজন ছিল। কিন্তু যখন কর্নওয়ালে আসলাম তখন দেখা গেল সেখানে আমিই একমাত্র কালো মেয়ে। আমি এতে অভ্যস্ত ছিলাম না। এসব নিয়ে আমি আগে কখনো ভাবিওনি।
তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো, আমার মধ্যে সমস্যাটা কোথায়? তখন হঠাৎ করেই যেন আমার এই উপলব্ধিটা হলো যে, পুরো এলাকায় আমিই আসলে সবার চেয়ে আলাদা, ভিন্ন বর্ণের মানুষ।
‘নিজেকে নিয়ে বিব্রত আমি’
আমার মা তখন বেশ সমস্যায় পড়ে গেলেন, কীভাবে তিনি এই বিষয়গুলো আমার কাছে ব্যাখ্যা করবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হয়ে আমাকে বুঝিয়ে বললেন, আমাকে হয়তো সারাটা জীবন এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। লোকজন আমাকে নিয়ে যা বলছে, আমার সম্পর্কে যা ধারণা করছে, তার সবকিছুই তারা করছে আমার গায়ের রঙ দেখে।
আমি যত বড় হচ্ছিলাম, আমার ততই অসুবিধা হচ্ছিল বিশেষ কোনও গ্রুপের সঙ্গে মিশতে। আমি কালো হওয়ার কারণেই এটা ঘটছিল কীনা আমি জানি না। আর মানুষ হিসেবেও আমি যেন অনেকটা একাকী ছিলাম। আমি বার বার আমার বন্ধুদের দল বদলাচ্ছিলাম। আমি মোটেই স্কুলে যাওয়াটা পছন্দ করছিলাম না।
মাধ্যমিক স্কুলে আমাদের কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস মোটেই পড়ানো হতো না। যখন আমার বয়স ১৪ বা ১৫, তখন একবার শুধু দাস ব্যবসা নিয়ে কিছু পড়ানো হয়েছিল। এটা পড়ানোর সময় আমার শিক্ষক হঠাৎ আমাকে পুরো ক্লাশের সামনে আলাদা করে জিজ্ঞেস করলেন, ক্লাশে আমিই যে একমাত্র কালো ছাত্রী, সেটা আমার কেমন লাগে।
আমার মনে আছে, তখন আমার মাটির ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমি জানি যে, পুরো ক্লাশে একমাত্র আমিই ভিন্ন রঙের মানুষ। আমি খুবই বিব্রতবোধ করছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমাকে যেন উলঙ্গ করে ফেলা হয়েছে। আমার মনে আছে, এই ঘটনা শুনে আমার মা খুব রেগে গিয়েছিলেন।
‘তুমি তো সাদাদের মতোই চলছো’
আমার মনে আছে পাশ দিয়ে ছুটে চলা গাড়ি থেকে আমাকে ‘নিগার’ বলে গালি দেয়া হয়েছে। এটা বহুবার ঘটেছে। আমার নিজেকে যে কী ভীষণ অপমানিত লাগতো।
কোন কোন লোক আবার বলতো, ‘আমি কখনো কোন কালো মেয়ের সঙ্গে ছিলাম না।’ কেউ কেউ আবার আমাকে নানা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতো। আমি আমার বন্ধুদের বাবা-মার মুখোমুখি হতে ভয় পেতাম। আমার মনে এমন আশংকা কাজ করতো যে তারা হয়তো আমাকে পছন্দ করবে না, বা আমাকে ভিন্ন চোখে দেখবে।
কর্নওয়াল খুব সুন্দর জায়গা। সেখানে অনেক সুন্দর মানুষও আছে যাদের মনে কারো প্রতি কোন ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই, সব মানুষকে যারা সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু তারপরও মন-মানসিকতায় কর্নওয়াল এখনো বেশ পশ্চাৎপদ, এখনো আগের যুগে পড়ে আছে।
আমি যে মিশ্রবর্ণের মানুষ, সেটাও আমার যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ মন্তব্য করবে, ‘তুমিতো প্রায় সাদা, তুমি তো সাদাদের মত করেই চলছো।’
আমি ‘সাদাদের মতো করে চলি’ কথার মানেটা কী? আমি তো আমার মতো করে চলছি। সাদাদের মতো করে চলা বা কালোদের মতো করে চলা বলে তো কিছু নেই। আমি একজন ব্রিটিশ।
‘আমি লোকজনে বর্ণবাদী কথা বলতে দেই’
যখনই আমি কারও বর্ণবাদী মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাই, তারা বলবে, ও, তুমি এখন ‘বর্ণবাদের কার্ড’খেলছ। আমি তো আসলে প্রতিবাদ করছিলাম তারা বর্ণবাদী কথা বলছিল বলে।
এটা যখন চলতেই থাকে, তখন একটা পর্যায়ে আমি হাল ছেড়ে দেই। লোকজনকে যা খুশি বলতে দেই। আমি আর এসব কথার প্রতিবাদ করি না। আমি লোকজনকে নিগারের মতো শব্দও বলতে দেই। যদি আমি এসব কথা বলতে না দেই তারা আমাকে গ্রহণ করবে না।
এখন যখন আমি পেছন ফিরে তাকাই, আমার মনে হয়, আমি যদি আরেকটু শক্ত হতে পারতাম! যদি আমার নিজের জায়গায় শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম! আমার মনে হয়, আমি তখন ভয় পেতাম যে আমাকে হয়তো কেউ মেনে নেবে না, কেউ আমার বন্ধু হবে না। সেজন্যেই এসব বর্ণবাদী কথাবার্তা আমি মেনে নিয়েছিলাম।
আজকের আমি যে ধরনের মানুষ, আমি যদি ছোটবেলায় সেরকমটি হতাম, কখনোই আমি আমার সঙ্গে কাউকে এরকম ব্যবহার করতে দিতাম না।
‘বর্ণবাদ থেকে মুক্তি সম্ভব’
সম্প্রতি আমি আর আমার কাজিন লন্ডনে এক বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলাম। এটি ছিল আসলেই এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। সব বর্ণের এত মানুষকে এক সঙ্গে জড়ো হতে দেখে আমার মনে হলো, এটি আসলে কালোদের সঙ্গে সাদাদের লড়াইয়ের ব্যাপার নয়, এটা আসলে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। জর্জ ফ্লয়েড এবং অন্য যারা জীবন হারিয়েছে, তাদের জন্য মানুষ যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছে, তা আসলেই এক অবাক হওয়ার মতো।
বিক্ষোভের এক পর্যায়ে আমরা সবাই মাটিতে হাঁটু গেড়ে নীরবতা পালন করছিলাম। আমরা সবাই তখন একই সমতলে। এখানে কেউ কাউকে বাছ-বিচার করছে না, সবাই সমান। সেই অনুভূতিটা ছিল চমৎকার।
এই আন্দোলন, যা এখন চলছে, যেভাবে মানুষ এখন সামনে এগিয়ে এসে তাদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছে, সেটি আমাকে এখন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সরব হতে সাহস যোগাচ্ছে।
আমি আশা করছি অন্য মানুষদেরও আমি সোচ্চার হতে সাহায্য করতে পারবো। আমার মনে হয় শিক্ষার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লোকজনকে এটা বোঝাতে হবে যে, কোন জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যখন সাদা বা কালো, সেখানে যখন আপনি ভিন্ন গাত্রবর্ণের কোন মানুষ দেখছেন, তার সম্পর্কে ভিন্ন কিছু ভাবার কোন অবকাশ নেই।
আমি একটা জিনিস করার চেষ্টা করি। সেটা হলো, যখন কেউ আমার সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করে, তখন রেগে না যাওয়া। কারণ তারা তো আসলে এই বর্ণবাদ শিখেছে, এটি তাদের জন্মগত নয়। তাদেরকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে এটি থেকে মুক্ত করা সম্ভব। এটা তাদেরকে বোঝানোর ব্যাপার।
আমি মিশ্র বর্ণের মানুষ। আমার ভেতরেই যেন দুটি সত্ত্বা। আমার যে অংশ সাদা, তাকে আমি শেখাতে পারি। আর আমার যে কালো অংশ, তাকে আমি আরও বলিষ্ঠ হতে বলতে পারি, যাতে আমি সবার সমান হয়ে উঠি।
আমি জানি, আমি দুই বর্ণের মানুষকেই সাহায্য করতে পারি। সূত্র: বিবিসি বাংলা