অনলাইন ডেস্ক : শেখ হাসিনা সরকারের হুট করে পতনের পর এবার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক লিখিত বিবৃতিতে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের পরিবর্তিত ঘটনার ওপর নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বেইজিং। বাংলাদেশকে বন্ধুপ্রতীম দেশ ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে চীন জানিয়েছে দেশটিতে দ্রুত সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এটিই তাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তাকারী দেশগুলোর মধ্যে জাপান এবং রাশিয়ার পরই চীনের অবস্থান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় বাংলাদেশ ক্রমাগত চীনঘেঁষা হতে থাকে। ধারণা করা হয়, চীন ২০১৯-২০২০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশকে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। যা মোট ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ১৪টি প্রকল্প চীনের ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। খরব সাউথ এশিয়ান মর্নিং পোস্টের।
দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নির্দশন হচ্ছে, একটি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দিয়েছে। যাকে শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে একটি সফল অর্জন হিসেবে তুলে ধরা হয়।
এদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার চীনের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ঢাকার উত্তাল পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় কে পরবর্তীতে ক্ষমতার মসনদে বসবে সেটা ভারতের কাছে উদ্বেগের বিষয়।
জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপি ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি চীনের সঙ্গে আরও বেশি জোটবদ্ধ হতে পারে। সেই সময় ঘোলাটে পানিতে মাছ শিকারের কোন সুযোগ হাতছাড়া করবে না বেইজিং। এটি এই অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মোটেও সুখবর নয়।
বিগত কয়েক বছরে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে অস্থিরতা, সহিংসতা দেখা গেছে, তা শ্রীলঙ্কা হোক বা মিয়ানমার হোক বা আফগানিস্তান হোক আর এখন বাংলাদেশ।
চীন এবং পাকিস্তান এক ধরনের জোট গঠন করেছে এবং কিছু দেশে নতুন সরকার ব্যবস্থা এনে দিয়েছে, উদাহরণস্বরূপ মালদ্বীপ। জানা গেছে তারা (বিএনপি-জামায়াত) নয়াদিল্লির চেয়ে এই ব্লকের সঙ্গে বেশি জড়িত। আফগানিস্তানে কট্টরপন্থী তালেবান ক্ষমতায় আসার পর পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের যে দৃঢ় সম্পর্ক ছিল তা ভেঙে যায়।
এর মধ্যে, ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির যে দীর্ঘ কূটনৈতিক সুসম্পর্ক ছিল তা ৫ আগস্ট হুট করে পাল্টে যায়। ভারতকে এখন এই নতুন সংকট মোকাবিলায় নতুনভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।
শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে জরুরি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটির সঙ্গে তিনি এ বৈঠক করছেন। সোমবার (৫ আগস্ট) রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে আয়োজিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব রাজীব গৌবা, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের প্রিন্সিপাল সচিব পিকে মিশ্র, ‘র’-এর প্রধান রবি সিনহা এবং গোয়েন্দা বিভাগের (আইবি) পরিচালক তপন ডেকা। বৈঠকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ে মোদিকে অবহিত করা হয়। সোমবার দু’দেশের সীমান্তে সতর্কতা জারি করে ভারত। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রেন চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
বুধবার (৭ আগস্ট) বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় ইসলামাবাদ। দেশে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে বলেও বিবৃতিতে প্রত্যাশা করা হয়। বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। সেই সঙ্গে তারা বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ও দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার প্রত্যাশায়।
ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এর মধ্যে দিয়ে সোমবার (৫ আগস্ট) তার টানা ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের করুণ পরিণতি হয়। জুলাই মাস ধরে চলা বিক্ষোভ ওই দিন লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচির মাধ্যমে ভয়াবহ রূপ নেয়। হাসিনা সরকারের দমনমূলক নীতি ব্যর্থতায় রূপ নেয় এবং বড় ধরনের রক্তপাত এড়াতে সশস্ত্র বাহিনীর পরামর্শে পদত্যাগ করে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা।
চীনের শঙ্কা
শেখ হাসিনার সরকার ছাড়া চীনের শঙ্কা এবং সুযোগ দু’টিই রয়েছে। চীনা সরকারও এটি বুঝতে পেরেছে। বেইজিং এখনও এ ব্যাপারে কোনও বিশদ মন্তব্য করেনি। তবে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রকাশ করেছে। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া কেবল একটি সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশ করেছে। যাতে সেনাপ্রধানের শান্তি বজায় রাখার আহ্বানের কথা গুরুত্ব পায়।
স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে মূল উদ্বেগ তুলে ধরে চীন। চীন তার প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা চায় না। যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সীমান্তে নেই। তবু দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর স্টিমসনের চীনা প্রোগ্রামের পরিচালক ইয়ুন সান আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সাময়িকী দ্য ডিপ্লোম্যাটকে জানিয়েছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা মানে অস্থিতিশীলতা, যা চীন দেখতে চায় না। এটি চীনা প্রকল্পগুলোর জন্য আরও অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা নিয়ে আসবে।
ইয়ুন উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে স্বস্তিতে ছিল চীন। জুলাই মাসে শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের মধ্যে দিয়ে দু’পক্ষ তাদের সম্পর্ককে ‘ব্যাপক কৌশলগত সহযোগী অংশীদারত্ব’ স্তরে উন্নীত করেছে। একই সফরে, চীন ও বাংলাদেশ ২০টির বেশি চুক্তি সই করেছে।
তবে, চীন বাংলাদেশে কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে। শেখ হাসিনা এ অঞ্চলে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও ভারতের স্বার্থের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছিল। চীন বাংলাদেশে অর্থায়ন বাড়ালেও সোনাদিয়ায় একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ বাতিল করেছে ঢাকা। এটি একটি চীনা কোম্পানি নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ভারত মহাসাগরে চীনা কোম্পানির মাধ্যমে নির্মিত এমন বন্দর প্রকল্পগুলো ভারতের নিরাপত্তায় উদ্বেগের কারণ। দ্বৈত ব্যবহারের সুযোগ থাকা এসব বন্দরে চীন নজরদারি জাহাজ মোতায়েন করতে পারে।