মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
সাতান্ন.
সাংবাদিকদের সাথে ওমন এক মুহূর্তে অল্প কথায় বিশেষ কিছু বলতে গেলে অনেক সময় কবিতার কিছু শব্দ বা একটা লাইন খুবই কাজে লাগে। আমার মনে হয়, কানাডার প্রায় সব বয়স্ক মানুষই আমার বাবার ‘শুধু আমাকে লক্ষ্য করো’- কথাটির সাথে পরিচিত। সংবাদ পাগল সাংবাদিকরা বাবার পিছে লেগে বিশেষ কোন সংবাদের জন্য বাবাকে ব্যতিব্যস্ত করে দিতেন, তখন বাবা সাধারণত ঐ কথা বলতেন। ওভাবে কথাটি বাবা প্রথম বলেছিলেন ১৯৭০ সালে, যখন একজন সাংবাদিক নাছোড়বান্দা হয়ে বাবার কাছে জানতে চাইছিলেন, ‘ফ্রন্ট দ্য লিবারেশন দ্যু কুইবেক’ এর হাত থেকে তিনি কানাডার মানুষকে কিভাবে রক্ষা করবেন। সেই সময় এফএলকিউ’রা প্রাদেশিক এক মন্ত্রীকে হত্যা করেছিল এবং এক ব্রিটিশ কুটনীতিক’কে অপহরণ করেছিল। সিবিসি’র সাংবাদিক টিম র্যালফে হাতে মাইক্রফোন নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, বাবার গাড়িটি ওখানে আসা মাত্রই তিনি তাঁকে ঐ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলার জন্য ধরবেন। এখন যখন আমরা এমন কোন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বলতে গেলে আগে থেকেই ঠিক হয়ে প্রস্তুতি নিয়ে তারপর সাংবাদিকদের সামনে কিছু বলি, কিন্তু সেই দিন সেই কথাগুলো হয়েছিল একেবারে স্বতস্ফূর্তভাবে। সেই দিনের সেই কথোপকথনের ভিডিও’টি এখন ইউটিউব এ পাওয়া যায় এবং যে কেউ ইচ্ছে করলেই দেখতে পাবে, এমন একটি জাতীয় প্রতিরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাবা কিভাবে সেই সাংবাদিকের সাথে কথা চালিয়ে গিয়েছিলেন। টিম র্যালফ একদিকে যেমন উত্তেজিতভাবে বাবাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলছিলেন এবং বারবার তর্কটা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন যাতে প্রতীয়মান হয় যে, প্রধানমন্ত্রী নিজেই কানাডার নাগরিকদের নাগরিক-নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যর্থ এবং তাঁর বিভিন্ন পদক্ষেপের জন্যই এই নিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটচ্ছে। বাবা সেদিন সেই অপ্রস্তুত বিতর্কে এমনভাবে টিমের সাথে কথা বলেছিলেন যে, টিম শুধু একজন বলিষ্ঠ বক্তা ও যৌক্তিক মানুষকেই তার সামনে পেয়েছিলেন না, বরং প্রধানমন্ত্রীর কথায় তিনি তার সব প্রশ্নের চুলচেরা উত্তর পেয়ে গিয়েছিলেন।
আমি যখন জনপ্রতিনিধি হয়ে অটোয়ায় প্রথম পৌঁছেছিলাম, তখনই আমার মস্তিস্কে গেঁথে নিয়েছিলাম, যে কোন বিষয় নিয়ে সাংবাদিক আর রাজনীতিবিদদের আলোচনা খোলাখুলিই হওয়া উচিৎ, আর আমি আমার সম্ভবমত সবার সাথেই কথা বলবো। কিন্তু সময় অনেক কিছুই পরিবর্তন করে দিয়েছে। টুইটার আর যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক পরিবর্তনের যুগে প্রধানমন্ত্রীতো দূরে থাক, বরং কোন রাজনীতিবিদই এমন কোন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রস্তুতি না নিয়ে বা আগে থেকেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের নমুনা না দেখে কখনো গণমাধ্যমের সামনে কিছু বলাকে নিরাপদ বা শ্রেয় মনে করেন না। এখন সাধারণত রাজনীতিবিদরা সাংবাদিকদের প্রশ্নের সংক্ষিপ্তভাবে সরাসরি উত্তর দিয়ে থাকেন এবং নিজের মত না দিয়ে নিজের দল কি বলছে বা এ ব্যাপারে নিজের দলের অবস্থান কী, সেটাই শুধু তারা তুলে ধরেন। আজকের অটোয়ায় সাংবাদিকদের সাথে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলার পরিবেশটা আর আমার বাবার সময়ের মত নেই। এই মুহূর্তেতো অন্তত একেবারেই নেই।
পার্লামেন্ট এ আমি প্রথম দিকে যে কয়েকটি বিশেষ কাজ করেছিলাম তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যুবসেবা নিয়ে একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো। পেছনের সারির প্রায় সব এমপি’ই এই বিষয়ের ওপর নিজেদের মত দিয়েছিলেন এবং বিষয়টা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলেছিল। পরে এই বিষয়টি বিল আকারে উত্থাপিত হলে সবাই নিজের নিজের ভোট দিয়েছিলেন সেটাকে আইনে পরিণত করার জন্য।
যুবসেবা বা যুবকদের কাজকর্ম নিয়ে হাউস অব কমন্স এর সদস্যরা কী ভাবেন বা কিভাবে তাঁদের মস্তিষ্কে এই বিষয়টা আরো ব্যাপকভাবে ঢুকিয়ে দেয়া যায়, সেটাই ছিল আমার মূল লক্ষ্য। আমি যখন ‘কাতিমাভিক’ এর হয়ে কাজ করতাম তখন আমি লক্ষ্য করেছি, যুব সমাজ নিয়ে পার্লামেন্ট সদস্যদের ভাবনা কি পরিমাণ অসাঢ় আর ভাসাভাসা ছিল। তাঁরা বুঝতে পারতো না, যুবকদের যথোপযুক্ত কাজের মধ্যে জড়িয়ে ফেললে সেটা শুধু তাদেরই ক্ষমতায়নে প্রভাব ফেলবে না বরং সেটা সমাজের যে কোন সংগঠন, রাষ্ট্রযন্ত্র আর সমাজে খুবই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কোন কৃতিত্ব নেয়ার জন্য বা কাউকে বিব্রত করার জন্য আমি এই বিষয়টা পার্লামেন্ট এ তুলিনি, বরং আমি মন থেকেই চেয়েছিলাম যুবকদের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের বিষয়টা সবায় ভালোভাবে চিন্তা করুক এবং জাতীয়ভাবে এ বিষয়ে একটা কার্যকরী সিদ্ধান্ত নেয়া হোক যাতে যুবশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়; যাতে নিজেদের উন্নয়নের সাথে সাথে যুবকরা সমাজ ও দেশ গড়ায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। এমন ভাবনা থেকেই ‘ইয়ুথ ভলান্টিয়ার্স সার্ভিস’ বিষয়ে জাতীয় নীতি গ্রহণ করার জন্য আমি এম-২৯৯ বিল এর আলোচনাটা উপস্থাপন করেছিলাম।
আমার প্রস্তাবটা যখন কনজারভেটিভ পার্টি ও বøক কুইবেকোইস দ্বারা নাকচ হয়ে গেলো, তখন আমি যুবকদের ব্যাপারে অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের মনোভাবটা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম। যুবকরা সাধারণত ধরেই নেয় যে, রাজনীতিবিদরা তাদের সম্পর্কে তেমন ভালো কিছু ভাবেন না এবং ভাববেও না। ফলে যুবকদের নিয়ে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে রাজনীতিবিদরা অনীহা দেখালেও তাদের পক্ষ থেকে তেমন কোন সাড়াশব্দ আর হয় নি। ঠিক তেমনি যেহেতু খুব বেশী সংখ্যক যুবকরা নির্বাচনের সময় নিজেদের ভোট দেয় না, সে জন্য রাজনীতিবিদরা তাদের নিয়ে বেশী সময় ও শক্তি ব্যয় করার পক্ষে কখনও থাকে না। এই দুই ধারা চলতে থাকায় রাজনীতি থেকে যুব সমাজ সব সময় একটু দূরেই থাকে। বলা যেতে পারে, এটা একটা চাকার মত ঘুরছে অর্থাৎ এটা হয় না তো ওটা হবে না। সেই সময় আমার মনে হয়েছিল, এই যে এক নেতিবাচক চক্রের খেলা চলছে আমার দেশে, এটা ভাংগার জন্য আমাকে ব্যক্তিভাবে উদ্যেগ নিতে হবে যাতে এই অবস্থার একটা পরিবর্তন হয়।
আমার এই অভিজ্ঞতা সারা দেশের যুব সমাজের পক্ষে কথা বলা আর লড়াই করার জন্য আমাকে আরো মরিয়া করে তুলেছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, অন্তত সবায় দেখুক যুব সমাজের পক্ষে কথা বলার জন্য সারা কানাডায় একজন রাজনীতিবিদ হলেও কেউ আছেন।
পার্লামেন্টের ঐ কমিটিতে কাজ করার ফলে আমি এটাও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলাম সংসদীয় রাজনীতির কাজের প্রক্রিয়া কি ধরনের। কোন এক পার্লামেন্টারী কমিটির মূল কাজ হচ্ছে, কোন একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিচার করা এবং সেটার ব্যাপারে কোন আইন করতে হলে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। হাউস অব কমন্স এ কোন বিল উপস্থাপিত হলে তা শুরুতেই একটা ভোটাভোটির মধ্য দিয়ে তা পরবর্তী পর্যায়ে যাবে কি না সেটা ঠিক হয়। যদি সেটা ইতিবাচক হয় তাহলে সেই বিষয়টা দেখভাল করার জন্য যে কমিটি আছে, সেখানে পাঠানো হয়। তারপর সেটাকে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করার জন্য বিভিন্ন দলের সদস্য, অভিজ্ঞ ব্যক্তি, সংগঠন এবং এর সাথে জড়িত সবার কাছে পাঠানো হয় তাদের বিজ্ঞ মত নেবার জন্য। তারপর প্রয়োজনে সংযোজন বিয়োজন করে সেটা আবার হাউসে চুড়ান্ত ভোটের জন্য পাঠানো হয়।
অন্তত এমনভাবে কাজটা হয়। আমার অভিজ্ঞতায় বলে, কোন বিষয়ের ওপরে একজন প্রতক্ষ্যদর্শী, বিজ্ঞজন বা বিরোধী দলের কেউ কী মত দিল, সেটা খুব বেশী একটা গুরুত্ব পায় না, বরং এই বিষয়টা ঘিরে রাজনীতি কেমন ভূমিকা রাখবে, সেটাই বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। প্রথম বছরে আমি পরিবেশ বিষয়ক কমিটিতে কাজ করেছি আর পরের বছর কাজ করেছি সিটিজেন এন্ড ইমিগ্রেশন বিষয়ক কমিটিতে। প্রথমটাতে দেখেছি সরকার এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, এই বিষয় নিয়ে তারা খুবই চিন্তিত এবং এটা নিয়ে তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু আসলে কাজের কিছুই হয় নি। আর পরের টার কাজের প্রক্রিয়া দেখে মনে হয়েছে, সবকিছুই ঠিক আছে এবং কেউ যদি কোন ব্যাপারে বিপক্ষ মত দেয় অথবা কোন বিষয় যদি সংশোধন করতে বলে তবে সে সাধারণত বিরাগভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়।
আমার মনে পড়ে, কোন বিষয়ে এমন আলোচনার ক্ষেত্র তৈরী হলে আমি সব সময় বিষয়টা যাদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বা যারা এই বিষয়ে সুষ্ঠু জ্ঞান রাখেন, তাদের মতামতের ওপর গুরুত্ব দিতাম বা গুরুত্ব দেবার জন্য সুপারিশ করতাম। আমি লক্ষ্য করেছি, কনজারভেটিভরা কাজের কাজ না করে শুধু তাদের ভালো রেকর্ডের কথা বলতো এবং সেটাতেই তারা তাদের তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতো। এই বিষয়টা দেখে আমার মনে হয়েছিল, আমাকে সরব থাকতে হবে এবং যেটা প্রয়োজন সেটার জন্য নিরলস কাজ করতে হবে, এর জন্য যে কোন আপত্তি বা বাঁধা আসুক না কেন, সেটায় আমার দমে যাওয়া উচিৎ হবে না, বরং দেশ ও দেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য এটা আমার একটা পবিত্র দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবেই। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্তই কিছুটা নীরবে নিভৃতে হয়ে যাচ্ছে, যেটা নিয়ে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ বা তর্ক বিতর্ক হয় না। ব্যাপারটা এমনভাবে হচ্ছে যে মনে হচ্ছে, পুকুরের পানিতে একটা ধারালো তরবারী চ্যাঁই করে ঢুকিয়ে আবার টেনে নেয়া হলো। আমাদের নিশ্চয় জানা আছে, পুকুরের পানিতে কোন ধারাল তরবারী ওভাবে ঢুকিয়ে আবার বের করে নিলে শান্ত পানিতে শুধু একটু ঢেউ এর রেখা ফুটে উঠে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই রেখাটা মূল পানির সাথে মিশে বিলীন হয়ে হারিয়ে যায়, কোন রকম হৈ চৈ’এর অবকাশ না দিয়েই। (চলবে)