শাহীন হাসানের কবিতায় অবিরল ধারার এক অদ্ভুত মহাজাগতিক সুরের ঢেউ বয়ে যায়। এই ঢেউ উপচিয়ে উপচিয়ে আচ্ছাদিত করে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনের ব্যাপ্তিহীন সীমানা। আমাদের আশপাশের অতি সাধারণ সব বিষয়গুলো প্রবল আবেগীয় তী²তায় তিনি এমনভাবে তাঁর কবিতায় উপস্থাপিত করেন যে, আমরা অবলীলায় অনুধাবন করতে পারি কাব্যিক সত্ত্বার সৌন্দর্য কেন এত প্রচণ্ডভাবে আমাদের দেহমনকে অবিরাম নাড়া দিয়ে যায়। কবি শাহীন হাসানের কবিতায় আত্মিক ছন্দ আর লয়-এর এক অদ্ভুত গতি আছে, আর আছে আমাদের জীবন ক্যানভাসের অপূর্ব স্বচ্ছ এক ছবি। তিনি কবিতায় কথা বলে যান একেবারে সাধারণ শব্দ খেলায়, যে খেলায় মাতোয়ারা হয়ে যায় কাব্যিক পানীয় পান করা সব মগ্ন কবিতাপ্রেমী প্রাণ। আজীবন কবিতার পথে পথ চলা বৌদ্ধিক কবি শাহীন হাসান আমাদের প্রতিনিয়ত ধ্যানী করে তোলেন কবিতা প্রেমে, আর কবিতায় অবগাহনে।
– মনিস রফিক
কবি শাহীন হাসান কবিতা ও সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরেই সুখকে অনুভব করেছেন তাঁর অবিন্যস্ত জীবনের আনাচে-কানাচে। তাঁর হৃদয় নিংড়ানো সৃষ্টি ও লালনে জীবন পেয়েছে জার্মানী থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘নিস্বন’।
‘নিস্বন’ পত্রিকার সম্পাদক শাহীন হাসান ১৯৬৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর বাংলাদেশের নড়াইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পড়াশুনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। বাংলাদেশে একটি দৈনিক পত্রিকায় কিছুদিন সাংবাদিকতা করার পর তিনি জার্মানীতে প্রবাস জীবন শুরু করেন। কবিতায় আবেশিত ও ঋদ্ধ কবি শাহীন হাসান আনন্দ পান ভ্রমণ, গান শোনায় এবং গীত রচনায়।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ছয় : ‘অন্ধকার মানুষ’, ‘জোনাকির আবৃত্তি’, ‘হাওয়ার মুখে বাঁশি’, ‘চলে যাচ্ছি কাহিনীর মতো’, ‘এ আসন বয়ে যায় বুদ্ধগয়ায়’, এবং ‘নীল নাকফুল’।
অস্তরাগ
মস্ত-পক্ক-এক চেরির মতো গড়িয়ে গড়িয়ে
বনের ভেতরে
পথটায় এসে নামলো সেই পুরুষটি।
আর সে নারী মিলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল,
সবুজ পাহাড় থেকে ধীরে ধীরে নেমে
খুলে খুলে তার কালো কেশরাজি।
আকাশকে আঙুলে আঙুলে কালো, বসতি আর চরাচরকে
আভাসে ইংগিতে নি:স্তব্ধ হতে বলে, ক্রমশ নগ্ন হচ্ছেন দেবী।
এখন দুহাতে শিশির ছড়িয়ে, হেঁটে আসছেন ফাঁকা বিলের
একপ্রান্ত থেকে
মধ্যবিন্দুর দিকে।
তার আঁচলের ইশারায় কিছু পাখি আর কাকেরা
উড়ে গেল ঘরের দিকে।
মাঠের গরু-ঘোড়াগুলো কয়েকবার দেবীর
আগমনকে অভিবাদন জানিয়ে রব করলো।
সৌর-চাষিদের ত্রস্ত হতে বলে, মূর্ত হলেন দেবী!
আকাশে অস্তরাগ: ভালোবাসার পোড়াকাষ্ঠ! দেবতার শেষ অস্তিত্ব।
জাগতিক অস্তিত্বের অন্তরালে দেবতা
আলিঙ্গন করলেন দেবীকে,
দেবীও অশ্বা-রোহিণী হলেন কয়েক বার
দেবতার অগ্নিতে।
শেষে নিসর্গ থেকে উঠে
নিজ নিজ অন্ধকারে প্রবেশ করলো:
দুজন মানব-মানবী,-
শরীর থেকে খড়কুটো, ঝাড়তে ঝাড়তে
মাটি আর ঘাসের গন্ধ …।
ফড়িংয়ের অমৃতস্বপ্ন
সবুজ পাতার উপর শুয়ে, মিশে গিয়ে সঙ্গে
সে কোন অমৃতের স্বপ্ন দেখে?
জিজ্ঞেস করেছিলাম : এসব নিবিষ্ট চিঠি,
কাকে লেখা হচ্ছে শুনি?
ফড়িংয়ের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি।
নির্জনতার প্রভাব ছাড়া কেউ কি কখনো
নিসর্গে প্রবেশ করতে পারে?
অথচ আমি মরিয়া হয়ে নির্জনতা দেখছি, শুনছি :
এতো ঘাস-ঘাসফুল, প্রজাপতি, পালের বাহার;
অজস্র কীট পতঙ্গ, পতঙ্গের গন্ধ-গুঞ্জন
পাখি আর তাদের বিক্ষিপ্ত কাকলি:
মহা-সংগীত না বলে পারিনি!
নিসর্গ যাকে বলে তারই মধ্যে ডুবে আছে আমার
লিখনি: কালির যোগান হয়ে বয়ে চলেছে
সান্ধ্য-ক্ষীণ খালের ধারা মহীয়ান-
আমি নির্জনতা দেখতে পারি,
এদের মাধ্যমে শুনতে পাচ্ছি ..
কিন্তু, সবুজ পাতার উপর শুয়ে, মিশে গিয়ে সঙ্গে,
সে কোন অমৃত লোকের স্বপ্ন দেখে?
এখনো জানতে পারিনি।
নাকফুল
এখনো সবুজ রয়ে গেছে
ব্যক্ত হয়ে উঠেনি,
মিহিদানার মতো বুটি বুটি
কুঁড়ির এই সুপ্ত রংগুলো দিয়ে
ঈষৎ বাঁকানো তোমার ভ্রæলতার কমলে
আপাতত আলপনা আঁকা চলে ..
চেরী ফলের সবুজ-গুটিগুলো
সূর্যের দিকে মুখ করে আছে,
রঙ ধরবে একদিন ওদের শরীরে
গোপনে গোপনে সেই কাজগুলোই চলছে:
লাল-টকটকে, নীল-জবজবে হবে ওরা।
জানোই-তো-মেয়ে, বসন্তের প্রভাবে
কৃষ্ণ আসে শরীর আর মনে!
তোমার নাসিকার জন্য এখনো
পরিপূর্ণ ফুল হয়ে ফোটেনি,
নীল-নাকফুলগুলো। আমার মনের
সুন্দর সূ² চূর্ণগুলো আপাতত ওর
উপরই কীটের মতো উড়ছে ..
ফুলোতিনা
আমি দেখিনি কখনো, কেমন দেখতে কবিতা?
কবিতার কি তোমার মতো লম্বা কালো চুল
কাজল আঁকা চোখ, বাঁকান ভুরূর ধনু
চোখের ভেতরে ভাসমান এলোমেলো মেঘ
কবিতা কি তোমার মতো
অধরা ঊর্মিলা?
তোমাকে দেখেই আমি থমকে গেছি ফুলোতিনা,
তুমি কি কবিতা? নাকি মৌসুমি ফুল, ফুলবতী?
কবিতা কি পরে তোমার মতো লাল টিপ
লাল-খয়েরি নোখ-পালিশ,
কবিতার গায়ে জড়ানো কি
লাল রঙের উপর সাদা লতান
তোমার রাবীদ্রিক চাদর?
কবিতা কি তোমার মতো
লীলাবতী রহস্যের খনি!
অই সুদূর সমুদ্র থেকে উঠে আসে
লাল রক্তের মতো পৃথিবী,
তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে
আমি সৈকতে পাখির মতো
নির্জন কোন ঝিনুকের মতো
থেকে যাই সারাদিন সারাবেলা!
তবুও আমার দেখা হয়নি তোমার
ঊর্মিলচোখ জোড়া, ঢেউ ভাঙ্গা ঠোঁট।
কবিতার কি তোমার মতো ঊর্মিলচোখ,
কবিতা কি তোমার মতো সৈকত সুন্দরী?
রাতের আকাশে তারার উঠনে আমি
হঠাৎ নিজেকে হাঁটতে দেখি,
নাক্ষত্রিক আগুনে সিগারেট জ্বালিয়ে নি
শুনি কার যেন পায়ের পায়েল আওয়াজ
যতো আলোকবর্ষ দূরেই থাকো তুমি
কষ্ট শিষ্টে আমি পৌঁছে যাই সেখানেই
আর ততো সরে সরে যাও তুমি!
তুমি কি নীহারিকা নাকি কবিতা?
তুমি কি ভোরের পাখি, রোদেলা সকাল
কবিকে চিনেও যেন চেন না চিরকাল!
কবিতা কি পরে তোমার মতো, সাদা নকশি
আঁকা লালা-ভো আলপনা শাড়ী?
কবিতা কি ঢেকে রাখতে জানে
সমস্ত বসন্ত, তোমার মতো
তুলতুলে নরম উষ্ণ ঐশ্বর্য
আর রাতের রহস্যের মতো
নাক্ষত্রিক রূপোলি আগুন স্তন!
কবিতার কি তোমার মতো
পায়ের নখ থেকে নন্দনের শুরু
নন্দনের সে স্বাদ জানে কবির জিহŸা শুধু!
কথা আর সুরের হার দিয়ে বেঁধেছ ফুলোতিনা,
কিন্তু তোমার মন কবিতাটি এখনো গোপন, অজানা?
বিন্দু বিন্দু গোমতী
পৃথুলার মতো বহুবার শাড়ি ছিঁড়েছে তোমার
সমতট চাদরে একদিন ঢেকেছিলে মুখ প্রাচীন
হরিকেল রাজ দরবারে ছিলে দর্পে সগৌরবে
তুমিই ছিঁড়েছ ত্রিপুরার নাভিমূল
রোদ-বৃষ্টি সবুজ অঙ্গ অঞ্চল-
যুগ হাওয়া হল উত্তাল
দেশ বিভাগের ডামাডোল বাজল
বিচ্ছেদের করুন বিষাদময় ধ্বনি
তুমি বাংলার পক্ষ দিলে সম্মতি
পরলে লাল-সবুজ সার্বভৌম শাড়ি!
কে তুমি সমতট কন্যা, তিলোত্তমা
পদ্ম দীঘি, নাকি গোমতী?
তুমিই তো ধরো অঙ্গে অঙ্গে গোমতীর জল
কমলাঙ্কের রূপ লাবণ্য মাটির ঘ্রাণ
তিতাস-ডাকাতিয়ার খরস্রোত
মেঘনার ভাঙান ঘোলা জল
তুমিই তো ধরো কবির
এক ফোটা উষ্ণ অশ্রæজল!
তুমিই তো ধরো অঙ্গে অঙ্গে
ভাব তরঙ্গে ঢেউয়ের কলস।
ময়নামতি- শালবন বিহার,
সহজিয়া সংগীত, বৌদ্ধ মঠ-মন্দির
লালমাই পাহাড়, নীলাচল।
তুমিই তোল সরোদে সুর বিশ্বরূপ
মাইহার ঘরানার জ্বেলে দাও
আলাউদ্দিন খাঁ- সুরদীপ!
তুমিই তো ধরো ডাকাতিয়া বাঁশির গান
শচীন দেব সূতিগৃহ, প্রমীলা নার্গিস
পৃথুলা কবি রাণীদের আবাস।
কে তুমি, কমলাঙ্কের কমল,
কবির হৃদ-কাননে ফোটা ফুল
নাকি তুমি বিন্দু বিন্দু গোমতী?
হাসপাতাল (Offenbach Klinikum)
তোমার লাল টিপ
তোমার লাল টিপ এখনো রয়েছে সবুজ
এখনি বলো না বিদায় হয়ো না তুমি অবুঝ।
দুপুর বাজায় ঝুমুর স্বর্ণের ঘোর লাগা রোদ
এখনো গড়ে নি পাতার মুকুট, লতার
বিছাহারে খোঁপা জুড়ে ফুল তবে ফুটুক?
ঘরিয়ে ঋদ্ধ মুখ থেকো না নিশ্চুপ!
তোমার কারণে আমি তোমার কারণে, হয়েছি ফুলকার
নতুন তারা নীলিমার রূপকার! তবু সাজানো হয় না
তোমাকে আমার, ভেঙ্গে-চুরে যায় বারবার তাসঘর।
আমি সাজাই তোমাকে তুমি খুলে ফেল সেই বেশ,
কোন নিখিল বিষে মিশেছ তুমি হয়েছ এমন বেহুশ!
নিসর্গে কি নেই ল²ী, তোমাকে যাবে না সাজানো
পুরোপুরি? এই হাতে আছে একজোড়া পুষ্প-অঙ্গুরি,
লাল গোলাপ টিকলি আর আছে কর্ণের দুল,
নিখিল কবিতার মৃদু-নীল ঝিলমিল!
তোমাকে সজাতে চাই, সম্মতি দাও সাজাই?
অঞ্জলিতে জ্বলছে আমার হৃদয়, বাসর অথবা
হোক-বিসর্জন, এই নাও বন-দীপ আর এই
গোধূলি-টিপ, এখনি বলো না বিদায় মর্মান্তিক!
আমরা পেলিক্যান পাখির মতো
আমার মাথার উপর বোধের ভেতরে হঠাৎ একদিন দেখি
হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে আকাশ,
অর্ধ-শতাব্দীরও পুরনো পাণ্ডুর এক চাঁদ
পাক ধরেছে চুলে
ভাজ পড়েছে গ্রীবায়
ভেতরে ঢুকে গেছে চোখ
চোখের নদীতে ভিড়েছে
মৃত ঝিনুকের নৃলোক!
যৌবন ঢুকে গেছে নিজের ভেতরে, পেলিক্যান পাখি যেন
নিজ শরীরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে চঞ্চু,
এই প্রচণ্ড শীত রাতে নিজের রক্ত
পান করে বেঁচে থাকতে হবে তাকে!
আমি যেন সেই পেলিক্যান পাখি
মরা আর বাঁচার সংগ্রামে সরব-সরস রেখেছি,
রক্তের আলোড়নে নিজের ভেতরে কবিতার এক খামার বাড়ি!
তুমি এলেই সে জমিনে পড়বে চাষ!
কিন্তু হে প্রিয়তমা কবিতা আমার
ভালোবাসা তুমি দিলেও না!
ভালোবাসা তুমি নিলেও না!
ভেবেছি কতবার ছেড়ে দেব এইসব
নিষ্ফল হৃদয়ের কারবার
আকাশ ভেবে যায় যাক
বাতাস ভেবে যায় যাক
আমি ভাববো না আর
সাত পাকে তবু বাঁধা
পড়ে আছি কবিতার ..
সুনামি
সেদিন প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে আমার মাথার উপর ভাগ-
হয়ে গেল নীলিমা- একই মুহূর্তে ফাটল ধরল হৃদয়ে আমার!
সেখান থেকে ঝরছে জল, ঝরছে অবিরাম অশ্রু। সেই-
জলে স্নান-সিক্ত, অশ্রুতে অভিষিক্ত পবিত্র হলাম আমি।
এক সময় মাটিতে খুঁজে পাওয়া গেল আমার পা-জোড়া।
ধীরে ধীরে আমি উঠে দাঁড়াই, তাকাই আকাশের দিকে-
আকাশের রূপ-বিপর্যয়- বোঝে কি মানুষের হৃদয়?
সুনামি আসছে সুনামি, দূরে শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের- মহা-গর্জন!
পর্বতের চুড়োয় দাঁড়িয়ে আছি আমি। ওরা কি আমার দিকেই
আসছে, আমিই কি নির্ভুল লক্ষ্যবস্তু ওদের? হে পর্বতমালা-
দয়া করে তোমার পাথুরে আবরণে আবৃত- করো আমায়।
সত্য হল ভয়ঙ্কর, মুখোশ ফেটে বের হয়েছে- যেন আগ্নেয়গিরি
দূর থেকে দেখাই ভাল কাছে যেতে নেই। পাহাড়টা কি টলে-
যাবে একসময়, আমার পা-দুটো কি আর ধরে রাখতে পারবে না-
পৃথিবী? ভেসে যদি যাই, আমি কি পাব ঠাই নূহের নৌকায়?