ফরিদ আহমেদ : ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, প্রায় এক কোটি লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। এদের বেশিরভাগ অংশই ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের সামনে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খৃষ্টান কোনো অংশই নিরাপদ ছিলো না। তবে, পাকিস্তান বাহিনীর একটা বাড়তি আক্রোশ ছিলো হিন্দুদের উপরে। তাদের ভ্রান্ত ধারণা ছিলো যে হিন্দুদের কারণে, তাদের প্ররোচনায় এবং ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা দাবি করেছে।
যে এক কোটি লোক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে শরণার্থী হয়েছিলো, তাদের মধ্যে কানাই লাল চক্রবর্ত্তীও একজন। তিনি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার কুমিরা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। পেশায় ছিলেন একজন হোমিও ডাক্তার। তিনি শুধু একা নন, তাঁর পুরো বর্ধিত পরিবার নিয়েই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর কিছু ছিলো না। বিদেশের মাটিতে রিক্ত, নিঃস্ব অবস্থায় দুর্বিষহ এক জীবন যাপন তিনি করেছেন। শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে, এক কক্ষের মধ্যে সতেরো জন মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করতে হয়েছে, এর ওর কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে যেটা তাঁর ভাষায় আসলে ভিক্ষাবৃত্তি, সেটা করে তাঁকে টিকে থাকতে হয়েছে বৈরী সময়ে। এই পরিস্থিতিতে তিনি মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে তাঁর দুই শিশু পুত্রকেও হারিয়েছেন। সঠিক পথ্য এবং চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছে তাঁর দুই সন্তান। ভিটে-মাটি ছেড়ে বাধ্য হয়ে শরণার্থী জীবন বেছে নিতে না হলে হয়তো তাঁর ওই দুই সন্তান অমন অকালে হারাতো না।
কানাই লাল চক্রবর্ত্তী তাঁর এই শরণার্থী জীবনের ঘটনাসমূহ ডায়েরি আকারে লেখা শুরু করেছিলেন। সেই ডায়েরি পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। বইটার নাম ‘শরণার্থীর দিনলিপি’। প্রকাশ করেছে দ্য রয়েল পাবলিশার্স।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যাঁরা দেশ ত্যাগ করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লিখেছেন। তবে, সেই অংশটা প্রধানত শিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত অংশ। তাঁদেরকে শরণার্থী শিবিরে থাকতে হয়নি। কেউ হোটেলে থেকেছেন, কেউ বা বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থেকেছেন। সমাজের একেবারে নীচুতলার মানুষ, যারা একেবারে শূন্য হাতে ওপারে গিয়েছে, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচিয়েছে তাদের দুর্দশার কথা আমরা অন্যদের মুখ থেকে শুনেছি, অন্যদের লেখা থেকে জেনেছি। সরাসরি তাদের কাছ থেকে জানা হয়নি। কানাই লাল চক্রবর্ত্তীর বইটা আমাদেরকে সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
যুদ্ধ যখন শুরু হয়, এর ভয়াবহতা কতোটুকু হতে পারে সে বিষয়ে কানাই লাল চক্রবর্ত্তীর কোনো ধারণাই ছিলো না। চট্টগ্রামে যখন বাঙালি সৈন্য এবং পাঞ্জাবি সৈন্যদের যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলো, তিনি ভেবে নিয়েছিলেন রাম এবং রাবণের যুদ্ধের মতো রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে মেশিনগান দিয়ে একে অন্যের প্রতি গুলি ছুড়বে আর তিনি দোতলায় তাঁর ঘরের জানালা দিয়ে সেই যুদ্ধ দেখবেন। বাস্তব যুদ্ধ যে সে রকম না, এর সাথে যে সাধারণ মানুষও জড়িয়ে যাবে সেটা তিনি টের পেলেন কুমিরাতে প্রথম যুদ্ধ শুরু হতেই। যুদ্ধটা শুরু হয়েছিলো ২৬শে মার্চ সন্ধ্যাবেলায়। কানাই লাল চক্রবর্ত্তীর নিজের ভাষাতেই সেই যুদ্ধের বর্ণনা দেই।
“হঠাৎ বিকট শব্দ ট্র-ট্র-ট্র- ট্র-ট্র-ট্র-ট্র-ঢুম-শোঁ-শোঁ, শোঁ-শোঁ, এতগুলি আওয়াজ ও এত অগ্নিকণা আর দেখি বা শুনি নাই। এমতাবস্থায় কি করা কর্তব্য তাহা জানিও না। গত বিশ্বযুদ্ধের সময় শুনিয়াছিলাম, ‘সাইরেন’ নামে বিপদ-সংকেত বাজিত, কিন্তু কই? কোথায় গেল আমার রোগীপত্র, কোথায় গেল হাটবাজার, ছোট বাচ্চাকাচ্চাসহ কোঠায় ঢুকিয়া পড়িলাম। …. আমি পূর্ব হইতেই ভীতু ছিলাম। আমার শরীরে কম্প দিয়া মাথা ঘুরা আরম্ভ হইল। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া কেহ কেহ মাথায় জল দিতে লাগিল।”
এমন একজন নিরীহ এবং ভীত মানুষ হবার পরেও কানাই লাল চক্রবর্ত্তী সাথে সাথেই ভারতে যাবার জন্য প্রস্তুত হন নাই। বরং এপ্রিল মাসের শুরুতে যখন অনেক হিন্দু পরিবারই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে তাঁর গ্রাম থেকে, তিনি সদম্ভে বলেছেন, “এক জন মুসলমানও যদি কুমিরা গ্রামে থাকে তবে আমি আমার বাড়ি ছাড়িয়া ভারতে যাইব না।”
নিজের ভিটে আঁকড়ে থাকার তাঁর অভিলাষ অবশ্য পূর্ণ হয়নি। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে। চারিদিকে যুদ্ধ, মৃত্যু আর ধ্বংস ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে। ফলে, একদিন তাঁদের বর্ধিত পরিবার পা বাড়ায় অনিশ্চিত যাত্রায়, অচেনা পথে অচেনা এক দেশের দিকে। সবকিছু ফেলে দিয়ে এক বস্ত্রে পালাতে হয়েছিলো তাঁদের। সেজন্য তাঁর কোনো আফসোস নেই। তিনটে জিনিসের জন্য শুধু আফসোস করেছেন তিনি। তাঁর হোমিওপ্যাথির সার্টিফিকেট, তাঁর ভাই হিরণ্ময়ের এম, এ-র সার্টিফিকেট এবং তাঁর সংগ্রহের যাত্রাপালার নাটকের স্ক্রিপ্ট। এক সময় শখের যাত্রা নাটকে অভিনয় করতেন তিনি। সেই শখ থেকে এইসব নাটকের স্ক্রিপ্ট সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
সেই যাত্রাটা ছিলো কষ্টকর এবং বিপদের ঝুঁকিতে পূর্ণ। ভারতে যাবার পরে বিপদের ঝুঁকি কমলেও টিকে থাকাটা হয়ে ওঠে বিশাল এক কষ্টসাধ্য কাজ। বেঁচে থাকতে গেলে মাথার উপরে চাল লাগে, চুলোতেও আরেক ধরনের চাল লাগে। ভারতে থাকা তাঁর আত্মীয়স্বজনরা যার যার সামর্থ্যমতো সাহায্য করছে। দেশের ভিতরের বন্ধু-বান্ধবরাও সাহায্য পাঠিয়েছে। তারপরেও এই বিশাল পরিবারের জন্য সেই সাহায্য ছিল সীমিত। পরিস্থিতির চাপে পড়ে শরণার্থী শিবিরে নাম লেখাতে হয়। একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয় তাঁদের জন্য যেখানে সতেরো জন মানুষকে থাকতে হতো ভেড়ার পালের মতো গাদাগাদি করে।
শরণার্থী জীবনের পরিস্থিতি কেমন সেটার একটা বর্ণনা তাঁর লেখা থেকে দিচ্ছি আমি। আগরতলা থেকে ধর্মনগরের দিকে যাচ্ছিলেন তাঁরা। সেই যাত্রার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন এভাবেঃ
“ধর্মনগরের গাড়ীতে চড়িলাম বেলা এগারটার দিকে। এটা ওটা, গুনাগুনি, নানা কান্ডকীর্ত্তণের পর একটা ট্রাক ছাড়িল। কি ভীষণ রাস্তা, কিছুক্ষণ পর পর মোড় ও উঠা না (১৮ মুড়া)। সেই রাস্তায় আর কোন দিন যাওয়া হইবে কিনা জানি না। ঘণ্টা খানেক চলার প্র যাত্রীদের বমি শুরু হইল। প্রথমে চৌধুরী বাড়ীর বড় বৌদি (বাবুলের মা) এবং তারপর ক্রমে ক্রমে অনেকেই বমি, পায়খানা করিতে শুরু করিল। নরককুন্ডই বটে! বমি ও পায়খানার উপরই চাপিয়া বসিয়া আছি এবং লেবু, লজেন্স ইত্যাদি বিলি করিতেছি। অবশ্য ভগবানের কৃপায় আমরা ২/৩ জন সে বিপাকে পড়ি নাই। কেহ বেহুঁসের মত হইল, মাঝে মাঝে জলের নিকট লরি দাঁড়ায়। জল খাওয়া ইত্যাদি চলে।”
আগেই বলেছি, শরণার্থী শিবিরেই তাঁর দুই শিশু সন্তান মারা যায়। এরা দু’জন মারা গিয়েছিলো মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে। এই শোককে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী কীভাবে সহ্য করেছিলেন, সেটা ভাবতে গিয়ে আমার নিজেরই গায়ের লোক খাড়া হয়ে গিয়েছিলো। মানুষ যখন শোকের সাগরে ভেসে যেতে থাকে, তখন শোককে আলাদা করে উপলব্ধি করার ক্ষমতাও হয়তো তার যায় হারিয়ে। নিয়তি হিসাবেই সব কিছুকে মেনে নেয়। দ্বিতীয় ছেলে তাপসকে কবরস্থ করার সময়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেনঃ
“একটু আগে এক পসলা বৃষ্টি হইয়াছে। সাধারণ বাতাস আছে, আকাশও মেঘাচ্ছন্ন। মধ্য রাত্রে ছেলেকে নিয়ে শ্মশানে যাইতে হইবে। অগ্নিসংযোগ হইবে না, ব্রাহ্মণের কোন চিহ্ন বর্ত্তমানে নাই। শ্মশানেরও দরকার নাই। কারণ এক সাইনবোর্ড আছে, আমরা শরণার্থী। লক্ষ্মীছাড়া ‘ইয়াহিয়া খান’।”
ইয়াহিয়া খানকে লক্ষ্মীছাড়া গালি দেওয়া ছাড়া কোনো কিছু নিয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ নেই। ক্যাম্পের ডাক্তার যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করে যে ‘আপনার ছেলে দুটো মারা যাওয়াতে আপনার কোনো অভিযোগ আছে কি?” এর উত্তরে তিনি বলেন, “না। অভিযোগ কিসের? আমি নিজে মরিয়া গেলেও কোন অভিযোগ নাই।”
কানাই লাল চক্রবর্ত্তীর বইয়ের তেমন কোনো সাহিত্য মূল্য নেই। তিনি সুললিত ভাষায় সাজিয়ে গুছিয়ে তাঁর শরণার্থী জীবনের কাহিনি পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন নাই। নিজে যার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, নিজের বিদ্যাবুদ্ধিতে যেটা তিনি বুঝেছেন, সেটাকেই অকপটে বলে গিয়েছেন তিনি। আর এখানেই বইটা হয়ে উঠেছে অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধের এক অসাধারণ দলিল। একটা দেশের ইতিহাসে এই ধরনের অবদানের মূল্য অপরিসীম। একটা দেশের জন্ম দিতে গিয়ে শুধু যোদ্ধারাই আত্মত্যাগ করেনি, কিছু না বুঝে পরিস্থিতির শিকার হয়ে সাধারণ মানুষরাও করেছে। যুদ্ধ তাদেরকে বাধ্য করেছে অপরিমিত পরিমাণে ত্যাগ করতে। সেই অবদানকে, সেই ত্যাগটাকে আমরা যেন ভুলে না যাই।