ভজন সরকার : ভবেশ প্রামানিকের কিছুতেই বোঝ আসে না, নিজের ভাই কিভাবে শত্রু হয়! সারা জীবন কোলে পিঠে করে মানুষ করলো অথচ এখন এই বয়সকালে এসে সেই ভাই নরেশ নাকি ভবেশেরই শত্রু হয়ে গেছে। অথচ অনেক দিন থেকে নরেশের কোনো খোঁজই নেই। শাস্ত্রে নাকি আছে বারো বছর নিরুদ্দেশ থাকলে তার আত্মার উদ্দেশ্যে পিন্ড দিতে হয়। নরেশ নিখোঁজ আজ পনের বছর।
সেদিন রাতের কথা ভবেশ আজো ভুলতে পারে না। দেশ স্বাধীন হয়েছে তখন মাত্র তিন বছর। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের টালমাটাল অবস্থা তখনো এলাকা জুড়ে। অনেকের হাতেই অস্ত্র। কোথাও কোথাও সে সবের অপপ্রয়োগও হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে হঠাৎ-মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যাওয়া কিছু লোক সে সব অস্ত্র দিয়ে কোথাও কোথাও ডাকাতিসহ নানা অপকর্মও করছে। শোনা যাচ্ছে টাংগাইলের কাদেরিয়া বাহিনির একটা অংশ নাকি এই সব ডাকাতিতে সক্রিয়। কাদেরিয়া বাহিনির বীরত্ব মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বহুল প্রশংসিত আর আলোচিত ছিল। অথচ মাত্র তিন বছর যেতে না যেতেই এই অবক্ষয়!
মানিকগঞ্জের এই এলাকাটা তখন সদ্য গজিয়ে ওঠা গনবাহিনিরও বেশ বাড়বাড়ন্ত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের টগবগে ছেলেগুলো তখন গনবাহিনিতে নাম লেখাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চার নীতির মধ্যে একটা নীতি ছিল সমাজতন্ত্র। কিন্তু কিভাবে এই সমাজতন্ত্র স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে তা নিয়ে ছিল বিভ্রান্তি। তাছাড়া যে উপায়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে উপায়ে কি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়?
ফলে যা হওয়ার তাই হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ হঠাৎ করে অতি বিপ্লবী হয়ে গেল। ভারত উপমহাদেশের প্রচলিত রুশ ও চিনা এই দ্বিধাবিভক্ত সমাজতন্ত্রের বাইরে আরেক নতুন ধারার সমাজতন্ত্রের থিওরি এলো। নাম দিলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের সাথে বিজ্ঞানের সংযুক্তি দেখে অনেক তরুণ ঝুঁকে পড়লো এই দলের সাথে।
পাকিস্তানী বাহিনি যুদ্ধের ন’মাসে সব ধ্বংস করে গেছে। শরণার্থীরা ফিরেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস প্রায়। প্রশাসনিক দক্ষতাও নেই। সদ্য স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যেও অস্থিরতা। অনেকেই অস্ত্র জমা দেয়নি। সে সব অস্ত্র নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা সরকারের বিরুদ্ধে অলিখিত সশস্ত্র বিদ্রোহে নেমেছে। সরকারও এই গনবাহিনিকে সামাল দিতে গঠন করেছে রক্ষীবাহিনি। রক্ষীবাহিনি নিয়েও মানুষের মধ্যে চাপা উত্তেজনা। কারণ, সরকারী দলের নেতাদের অপকর্মের সহায়ক হিসেবেও অনেক জায়গায় রক্ষীবাহিনি কাজ করছে। ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে যে, এলাকায় সরকারী দলের অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই তাদেরকে রক্ষীবাহিনির অমানবিক অত্যাচারের শিকার হোতে হচ্ছে।
নরেশকে বারবার মানা করেও থামাতে পারেনি ভবেশ প্রামানিক। মাকে দিয়ে বলিয়েও কোন ফল হয়নি। ভবেশের বৌকে নরেশ মায়ের মতোই মান্যিগন্যি করে। বৌদির কথাতেও নরেশ থামে নি। বরং উল্টো তাদেরকেই বুঝিয়েছে নরেশ।
‘দেশটা কি এমনি স্বাধীন করেছি বৌদি? ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ গেলো। দুই লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম হারালো। কিছু মানুষ ভুল পথে গেছে; তাদের দমন করুক। অথচ সরকারী বাহিনি সরকারী দলের অপকর্মকেও সমর্থন করবে? সরকারী দলের নেতাদের অপকর্মের প্রতিবাদ করলেই তাদের রক্ষীবাহিনি দিয়ে অত্যাচার করাবে?”
ভবেশের বৌ মালতী বলে, ‘কিন্তু তুই একা প্রতিবাদ করলে সব ঠিক হবে ভাবছিস?’
নরেশের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘কিন্তু প্রতিবাদ তো করতেই হবে কাউকে না কাউকে। জয় বাংলা কি হয়েছে এর জন্য? বংগবন্ধুকে এরাই অপমান করছে। এদের জন্যই বংগবন্ধুর মান-সম্মান মলিন হচ্ছে। গনবাহিনির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দেখো না, কলেজের ব্রিলিয়ান্ট ছেলেগুলোর মাথা নষ্ট করছে। ভবিষ্যতে অন্যায় দেখলে আমি প্রতিবাদ করবোই, বৌদি।’
সে অন্যায় আসতে আর তর সইলো না। কয়েক দিনের মধ্যেই উত্তর পাড়ার মুকুল রায়ের বাড়িটা সরকারী দলের স্থানীয় নেতা দখল করে নিলো। মুকুল রায় সপরিবারে শরণার্থী হয়ে ভারতে গিয়েছিল যুদ্ধের সময়। ছোট ভাই বাবুল রায় ফিরেছিল দেশ স্বাধীন হলে। কিন্তু কিছু দিন পরেই কাউকে না বলে সেও নাকি ভারতে চলে গেছে। অথচ অনেকেই বলছে বাবুলকে ভয় দেখিয়েই ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছে মুক্তিবাহিনির কমান্ডার মিজানের লোকজন। এবার মুকুল- বাবুলদের বাড়িটাও দখল করে নিলো শত্রু সম্পত্তি নাকি কী এক আইনের আওতায়।
পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ববংগের মানুষদের হীনদৃষ্টিতে দেখতো। একই ধর্মবিশ্বাসী হলেও পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে মুসলমান হিসেবেই মনে করতো না। আর হিন্দুদের কী চোখে দেখে সে সহজেই অনুমান করা যায়। শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাকে তো ভারতের প্রেসক্রিপশন হিসেবেই দেখেছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। তাই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রথম আঘাত আসে হিন্দুদের উপরই।
২৫ শে মার্চের সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক হল জগন্নাথ হল তাই ছিল প্রথম টার্গেট। সেই সাথে হিন্দু-অধ্যুষিত পুরানো ঢাকা; তাঁতিবাজার, ল²ীবাজার, বাংলাবাজার সদরঘাট এগুলো ছিল আক্রমনের প্রধান অঞ্চল। ঢাকার বাইরে যখন পাকিস্তানী মিলিটারি ছড়িয়ে পড়ল, তখনও হিন্দুদের বাড়িঘর-দোকান-পাট এগুলোই ছিল টার্গেট।
ভবেশ-নরেশদের এলাকাতেও যে ক’টি হিন্দু গ্রাম ছিল, ছিল যতো হিন্দু পাড়া, সবখানেই আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল। আতঙ্ক ছড়ানো হলো ইচ্ছে করেই। এপ্রিল মাসের মধ্যেই গ্রামের প্রায় অর্ধেক হিন্দু ভারতে আশ্রয় নিলো। অনেক হিন্দু বাড়িতে স্থানীয় রাজাকার-আল-বদরেরা চলে এলো। সন্ধ্যা প্রদীপের ধুপধুঁনো আর শঙ্খের ধ্বনির বদলে আজান দিতেও শুরু করলো অনেকে।
নয় মাস যুদ্ধের পরে দেশ স্বাধীন হলো। অনেকেই ফিরে এলো ভারত থেকে। শরণার্থী জীবনে কার থাকতে ইচ্ছে করে? মুকুল-বাবুল রায়দের বাড়িতেও উঠেছিল এক প্রভাবশালী রাজাকার। দেশ স্বাধীন হলে রাজাকারকে দখলছাড়া করা গেলেও, মুক্তিযোদ্ধা এক নব্য নেতার দৃষ্টি পড়লো রায় বাড়িতে। মুকুল রায় তো ভয়ে ফিরলোই না ভারত থেকে। ছোট ভাই বাবুল ফিরলেও তাকে দেখানো হলো নানান হুমকি। বড় ভাই মুকুলের যে সম্পত্তি সেটুকু নাকি শক্র-সম্পত্তি হয়ে গেছে। বাবুল এ সবের কিছু বুঝছে না।
বাবুল রায় নরেশকে বললো, ‘দাদা কিছু করা যায় না? তোমরা না যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছ। সেই স্বাধীন দেশে নিজের ভিটে থেকেই চলে যেতে হবে? আমার ভাই তো আর নিজের ইচ্ছেয় ভারতে যায়নি। আমার ভাই তো আমার শত্রু নয়। ভাইয়ের সম্পত্তি আমি পাব না কেন? এ কেমন আইন? এখন তো আমাকেও ভিটে ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে।’
নরেশ বাবুলকে সান্ত¡না দেয়। মুক্তিযুদ্ধ কেবল শেষ হলো। শেখ মুজিব এ সব কালো আইন রহিত করবেন। একটু সময় দিলেই শেখ মুজিব দেশটাকে স্বপ্নের সোনার বাংলা করে গড়ে তুলবেন।
দিন যায়। বছর চলে যায়। শত্রু সম্পত্তির নামের সেই আইনে একে একে অনেক হিন্দু পরিবারের বাড়ি-ঘর জমি-জেরাত বেদখল হতে থাকে। বাবুল রায়েরা নেতাদের পেছনে, থানায়,কোর্ট-কাছারির বারান্দায় ঘুরতে থাকে। নরেশ প্রামানিকের সব সান্ত¡না শুধু সান্ত¡নার বাণীই রয়ে যায়। নরেশ বাবুল রায়দের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সেই সাহস ক্রমেক্রমে নরেশের বুক থেকে সরে যেতে থাকে।
হঠাৎ করেই একদিন খবর রটলো কমান্ডার মিজানের কাছে বাবুল রায় জমি-বাড়ি বিক্রি করে নাকি ভারত চলে গেছে। অথচ নরেশের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। যে বাবুল রায়কে সে চেনে, সে বাবুল রায় ভারতে যেতে পারে না।
নরেশ তার বৌদিকে বলে, ‘ বৌদি, আমার মনে হচ্ছে মিজান জোর করেই বাবুলকে দেশ ছাড়া করেছে।‘
বৌদি বলে, ‘তুমি কী করবে? তুমি এর মধ্যে যেও না ঠাকুরপো। ওরা ভয়ঙ্কর। থানা-পুলিশ সব ওদের কথায় নরেশ বসে থাকার মানুষ নয়। মিজান কমান্ডারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। থানা সদরে বাবুল রায়ের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ জানিয়ে ডাইরি করে। এলাকায় বামপন্থীদের যে ক্ষীণ সমর্থন আছে তাদেরকেও অনুরোধ করে। বাবুল রায়ের আসলেই ভারতে গেছে নাকি নিখোঁজ হয়েছে, সে নিয়ে এলাকায় চাপা গুঞ্জন। সব প্রতিবাদের পেছনের মানুষটি নরেশ প্রামানিক।
ভবেশ-নরেশের বাড়িতে একরাতে রক্ষীবাহিনি আসে। নরেশ মহুকুমা শহরে ছিল সেদিন। ভবেশ প্রামানিকের কাছে জানতে চায় ছোট ভাই নরেশ গনবাহিনিতে নাম লিখিয়েছে কিনা?
নরেশের বুঝতে বাকী থাকে না, মিজান কমাণ্ডার নরেশকে গনবাহিনি বানিয়ে রক্ষীবাহিনি দিয়ে অত্যাচার করাবে। মহুকুমা শহরে সরকারী দলের নেতাদের দ্বারস্থ হয় নরেশ। কিন্তু আশ্বাস মেলে না। আস্বস্ত হওয়ার মতো কোনো প্রতিশ্রুতিও পায় না নরেশ। যাদের সাথে জীবনবাজি রেখে মাত্র ক’বছর আগেও যুদ্ধ করেছে সেই সহযোদ্ধাদের অসহায়ত্ব নরেশকে ব্যথিত করে।
ভবেশ-নরেশের বাড়িতে পুলিশ-রক্ষীবাহিনির আনাগোনা বাড়তে থাকে। রাতে তো বটেই দিনের বেলাতেও খাঁকি পোশাকের লোকজন নরেশের খোঁজে আসে। এক সময় ভবেশ-নরেশের বাড়ি “দেশদ্রোহী গনবাহিনির চিহ্নিত ঘাটি” রটিয়ে দেয় কমান্ডার মিজানের লোকজন।
কিছুদিন আগেও নরেশ প্রামানিক মুক্তিযোদ্ধা নরেশ হিসেবে পরিচিত ছিল । এখন নরেশের পরিচয় গনবাহিনির নরেশ হিসেবে। অথচ নরেশ নিজেও জানে না গনবাহিনির সাথে তার সম্পৃক্ততা। নরেশ জানে বাবুল রায়ের ভিটে দখলের প্রতিবাদেই মিজান কমান্ডার সুপরিকল্পিতভাবে এ সব করাচ্ছে। সরকারী দলের এক প্রভাবশালী নেতা নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে নরেশকে সতর্ক থাকতে বলেন। নরেশ জানে না এই সতর্ক থাকার মানে কী?
বাড়িতে মা-বৌদি-দাদা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। মা আর বৌদি নরেশকে দেখে না সে অনেক মাস। মা অসুস্থ। বৌদি সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। ভবেশ নিজেও জানে না নরেশের অবস্থান। আগে লোক মারফত কিছু খবর পাঠাতো মাঝে মধ্যে। ক’সপ্তাহ সেটাও বন্ধ। হঠাৎ হঠাৎ খবর আসে গনবাহিনির সাথে রক্ষীবাহিনির বন্দুক যুদ্ধ। ভবেশের আত্মা কেঁপে উঠে। কিন্তু মনকে সান্ত¡না দেয় । মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে নরেশ নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। সেই দেশের বিরুদ্ধে গনবাহিনিতে নরেশ কিছুতেই যোগ দেবে না। তবে নরেশ কোথায় এখন? নাকি বাবুল রায়ের মতো একদিন কমান্ডার মিজান নরেশও ভারত চলে গেছে বলে রটিয়ে দেবে?
মাস যায়। রক্ষীবাহিনির বাড়িতে আসা কমে আসতে থাকে। কিন্তু নরেশ ফিরে আসে না। নরেশের খোঁজ মেলে না কোথাও। বছর ঘুরতেই মা মারা যায় অসুস্থ হয়ে। নরেশের সন্ধান মেলে না কোথাও।
একদিন থানা ভূমি অফিস থেকে নোটিশ আসে। নরেশ প্রামানিকের স্থাবর সম্পত্তি শত্রæ -সম্পত্তি হিসেবে ডিক্রি জারী হয়েছে। ভবেশ প্রমানিক ইচ্ছুক হলে উপযুক্ত প্রমান নিয়ে আদালতে এই ডিক্রির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে।
ভবেশের হিসেব মেলে না, নিজের ভাই কীভাবে শত্রু হয়ে যায়? একজন মুক্তিযোদ্ধা কীভাবে শত্রু হয়ে যায়? নরেশ যে ভারতে চলে গেছে সে প্রমানও নেই। নরেশ কি বেঁচে আছে? এতো বছর পরে যদি হঠাৎ নরেশ চলে আসে? এ সবের উত্তর মেলে না ভবেশ প্রামানিকের। শুধু জানে, মুক্তিযোদ্ধা নরেশ , নিখোঁজ নরেশ আজ দেশের শত্রু আর নরেশের সম্পত্তি আজ শত্রু-সম্পত্তি।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)