অনলাইন ডেস্ক : বুধবার (১ জুলাই) শতবর্ষে পা দিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। মঙ্গলবার (৩০ জুন) ৯৯ বছর পূর্ণ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়টির। ২০২১ সালের ৩০ জুন একশ’ বছর পূর্ণ হবে। একশ’ বছরে পা দেওয়ার প্রথম দিন আজ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ উদযাপন করবে উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, নতুন নতুন নানা গবেষণা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই পরিচিতি পায় বেশি। আশা আকাঙ্ক্ষার জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও তারা তাদের প্রত্যাশা নিয়েই তাকিয়ে আছেন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।
কোভিড-১৯ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বল্প পরিসরে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে সংক্ষিপ্ত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন প্রাঙ্গণে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন। পতাকা উত্তোলন ও বেলুন ওড়ানোর পর সকাল ১১টায় অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে অনলাইন সভা করা হবে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনলাইন ভার্চুয়াল সভায় জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সংযুক্ত হয়ে ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রসঙ্গ: আন্দোলন ও সংগ্রাম’ শীর্ষক মূল বক্তব্য দেবেন।
স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের অন্যতম লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নেটিজনেরা একে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলেও সম্বোধন করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী সব জনআন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। ১৯২১ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৯৯ বছর শেষ করে শতকের ঘরে পা দিচ্ছে আজ।
দিনটি উপলক্ষে ঢাবি উপাচার্য জানিয়েছেন, ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। ২০২০ সালের এই দিনে ৯৯ বছর শেষ করে শতবর্ষে পা দিলো আমাদের এই চিরতরুণ প্রতিষ্ঠান। করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লোকসমাবেশ এড়িয়ে প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীবিহীন স্বল্প পরিসরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন নিঃসন্দেহে আনন্দ, প্রশান্তি ও স্বস্তির ঘাটতি অনস্বীকার্য। তবে মুজিববর্ষের এই অলোকসামান্য কালপর্বে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। প্রকৃতপক্ষে, ‘বঙ্গবন্ধু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ বাংলাদেশ নামক আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির দুই অন্তহীন প্রেরণা-উৎস।
ঢাবি উপাচার্য বলেন, ‘শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার, মুক্তচিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নতুন ও মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালে আমাদের অস্তিত্বপ্রতিম এই প্রতিষ্ঠান শতবর্ষপূর্তি উদযাপন করবে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীও একই বছর উদযাপিত হবে। তাই বছরটি হবে আমাদের জন্য এক বিশেষ মর্যাদা, সম্মান, আবেগ, অনুভূতির সংশ্লেষে গৌরবদীপ্ত ও স্মৃতি-ভাবুকতার বছর।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের অদম্য এই যাত্রা নিয়ে সংহতি এবং ক্ষোভ দুই আছে অনেকের মনে। ‘ঢাকা বিশব্ববিদ্যালয় দিবসের’ আয়োজন ভার্চুয়ালি পালন করা হবে। সেটা কতটা অংশগ্রহণমূলক করা যাবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্বাচিত প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি এবং কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করেন, রাজনীতি চর্চার ব্যাপ্তি না থাকায় প্রগতি নেই। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষা ব্যয় নির্ধারণের জন্য সরকার ট্যাক্স নেয়। জনগণের টাকা নিয়ে সবার আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্য, শিক্ষা এগুলোই। এটার পেছনে খরচ করার নীতি যতক্ষণ না নিচ্ছে রাষ্ট্র, ততক্ষণ এরকমই হবে।’ তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থই হলো ‘নতুন জ্ঞান’ সঞ্চয় করা। গবেষণা কাজ ছাড়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ হতে পারে না। কিন্তু সেজন্য অর্থ বরাদ্দ নাই। বিশ্ববিদ্যালয় এখন অন্যান্য জায়গার মতো পেশিশক্তি এবং বাণিজ্যিক লেনদেনের মতো করুণ পরিণতি হয়েছে।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করেছেন সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান। তার মতে, নতুন নতুন গবেষণা এবং তা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ফলাও করে প্রচার করতে হবে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেকেই জানেন না নতুন নতুন গবেষণার তথ্য। এগুলো মানুষের চর্চা এবং ব্যবহারে কাজে লাগতে পারে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো উপস্থাপনে এখনও অনেক ঘাটতি আছে। ১০০ বছরের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, তার এতগুলো বিভাগ এতগুলো কার্যক্রম, কিন্তু শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঘটনা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে বের হয়। এমনকি ছোট ঘটনা হলেও তা পত্রিকায় জায়গা করে নেয়। কিন্তু অনেক গবেষণার সাফল্য কিংবা খবর সামনে আসে না। আমার কাছে মনে হয়, এই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জায়গা আরও বিস্তৃতি করা দরকার এবং একইসঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করবে— এটাই আমি প্রত্যাশা রাখি। গবেষণার জায়গায় আমাদের বিশ্বমানের দিক থেকে আরও দায়িত্ববোধ থাকা দরকার আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীর, যাতে বিশ্বমানের গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরও বেশি সুনাম অর্জন করতে পারে।’
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন সাদেকা হালিম মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় নারীর জন্য যোগ্য স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একমাত্র নির্বাচিত ডিন হিসেবে এখন আমি আছি। ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণী জায়গায় আরও নারীদের আসার সুযোগ আছে।’
কেবল একটি বিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখার অবকাশ নেই বলে মনে করেন একসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ও বর্তমানে গণযোগোযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. কাবেরী গায়েন। চিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়েই একটি গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল এই বাংলার নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল একটি মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিত অসাম্প্রদায়িক শ্রেণির বিকাশ, যার ঐতিহাসিক মূল্য অনিঃশেষ। জাতির উচ্চশিক্ষার আয়ত্ত্বসাধ্য দ্বার উন্মোচন করার পাশাপাশি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে সব বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও এই জাতির যা কিছু অর্জন, ভালো-মন্দ, তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।’
শুরুতেই স্বায়ত্ত্বশাসিত মুক্তবুদ্ধি চর্চার অবারিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই যাত্রা শুরু হলেও সেই মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিসর ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যেনো বা‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়’হয়ে উঠেছে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পরিবর্তন হয়ে যায়। নতুন জ্ঞান উৎপাদনের জন্য গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা এবং ক্রমহ্রাসমান মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিসর উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়েই কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেকে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার উপযোগী করে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে। তবে ৯৯ বছরেও একটি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে পারেনি ঢাবি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘বাংলাদেশের সব সরকারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর হস্তক্ষেপ করে আসছে, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার দর্শন এবং তার লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৯৯ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে— এটা পুরো বাংলাদেশের জন্য একটা নতুন আশাবাদ তৈরি করতে পারতো, যদি এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাধীন জ্ঞানচর্চা ও মতামত প্রকাশ, গবেষণা, সুষ্ঠু পরিবেশ এবং যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা থাকতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের খুব সামান্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানতম লক্ষ্য পূরণের কাজে ব্যয় করা হয়। দেশের এবং মানুষের স্বার্থে গবেষণা কাজকে অনেক সময় সরকারিভাবে বাধা দেওয়া হয়, ভৎসনা করা হয়, নিরুৎসাহিত করা হয়।’
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অনিক রায় বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে চিন্তা ও মান নিয়ে পদযাত্রা শুরু করেছিল, সাম্প্রতিক সময়ে সেটা কমে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে হওয়ার কথা সারাদেশের একটি জ্ঞানের কেন্দ্র, সেখানে আমরা দেখেছি এটা ব্যবসায়িক হাতে গেছে। এখানে যে মৌলিক গবেষণার কথা বলা হয়েছিল, সেটা তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। এই করোনার মহামারির সময় কিট, জিনম সিকোয়েন্স নিয়ে সারাদেশে মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, সেখানে আমরা দেখলাম— অনেক আলোচনার পর একটি পিসিআর ল্যাব চালু হলো, আবার টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে গেলো। ফলে এই যে গবেষণামুখী না হয়ে একেবারে ব্যবসামুখী হয়ে গেছে, যার ফলে করোনা মোকাবিলার যে গবেষণা তাতেও ঢাবি প্রস্তুত না। শুধু ঢাবি নয় বাংলাদেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই এখন একই অবস্থায় আছে। তাই আমাদের আশা থাকবে যে, ঢাবির শিক্ষার্থীরা যাতে এই বিষয়টি অনুভব করে এবং বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে যে শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা উচিত, সেটা বাস্তবায়নে চলমান আন্দোলনে অংশ নেবে এবং প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে যে গর্বের জায়গা ছিল, সেটা আমরা ফেরত নিয়ে আসতে পারবো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্তার বিকাশের লক্ষ্যে ২০ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন আগে ভাইস রয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়েছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতা। ওই বছরের ২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি. আর. কুচলার, ড. রাসবিহারী ঘোষ, নবাব সৈয়দ আলী চৌধুরী, নবাব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দচন্দ্র রায়, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি. আর্চিবল্ড, জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়, ঢাকা মাদ্রাসার (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী (আলীগড়), প্রেসিডেন্সি কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ এইচ. এইচ. আর. জেম্স্, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ. পিক এবং সংস্কৃত কলেজের (কলকাতা) অধ্যক্ষ সতীশ্চন্দ্র আচার্যকে সদস্য করে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠিত হয়।
১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০’।
ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ সরকারের পরিত্যক্ত ভবনগুলো ও ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনগুলোর সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিভাগগুলো ছিল— সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন।
প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। যেসব প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তারা হলেন— হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফ. সি. টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জি এইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউ এ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ এফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও দেশভাগের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বা পরবর্তী সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫টি কলেজ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে সব জন-আন্দোলন ও সংগ্রামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রীসহ শহীদ হয়েছেন অনেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালের আইয়ুব সরকারের জারি করা অর্ডিন্যান্স বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-১৯৭৩ জারি করেন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে এবং পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার ১৫০ জন। পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৮ জন শিক্ষক।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিচ অ্যান্ড লিবার্টি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণে উচ্চশিক্ষার সম্প্রসারণ ও অগ্রগতিতে নিবেদিত এ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে গবেষণা-কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।