ফরিদ আহমেদ : বুড়িগঙ্গা নদীতে জাল ফেললে, জাল ভর্তি হয়ে উঠে আসে এক ধরনের অদ্ভুত মাছ। আমাদের পরিচিত দেশিয় কোনো মাছ এগুলো নয়। বিদঘুটে ধরনের বিদেশি মাছ।
বুড়িগঙ্গা নদী হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত পানির নদী। এই নদীতে মাছের দেখা মেলে না বললেই চলে। বর্ষাকালে অল্প কিছু শিং মাগুর ধরা পড়ে শুধু। অথচ সেই নদীতে ছেয়ে গিয়েছে বিদেশি এই মাছ। মাছটার নাম সাকার। প্রথম আলো পত্রিকার এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের পন্টুনের পেছনের অংশ জুড়ে দেখা গেছে শত শত সাকার মাছ। দূষিত বুড়িগঙ্গায় যেখানে মাছের দেখা মিলতো না, এখন সেটা সাকারে সয়লাব হয়ে গিয়েছে।
যে নদীতে মাছ ছিলো না, সেই নদীতে অসংখ্য মাছ থাকাটাতো স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভালো একটা খবর। কিন্তু, সাকার মাছ থাকাটা কোনো ভালো খবর নয়। সাকার দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু খেয়ে মাছের বংশবিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ মাছ যে কোনো পরিবেশে বাঁচতে পারে এবং দ্রুত বংশবৃদ্ধির কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা করে। সাকারের জীবনীশক্তি অসীম বলে এর সাথে দেশিয় মাছ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এটা একটা রাক্ষুসে মাছ। যে কারণে বাংলাদেশ সরকার এই মাছটিকে এর মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই মাছ খাওয়ার জন্য যেমন চাষ করা যাবে না, একুরিয়ামে পোষাও যাবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একটা রাক্ষুসে মাছ বাংলাদেশে এলো কী করে? আশির দশকে আফ্রিকান মাগুরের চাষ হতো বাংলাদেশে। আফ্রিকান মাগুর দ্রæত বাড়ে বলে মাছ চাষিদের মধ্যে তা দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলো সেই সময়। পুকুরে চাষ করা হতো এই মাছের। কিন্তু, সাকারের মতো সেটাও রাক্ষুসে মাছ ছিলো। বাংলাদেশ যেহেতু বন্যা-প্রবণ অঞ্চল, আফ্রিকান মাগুরকে তাই সীমাবদ্ধ রাখা যায়নি পুকুর কিংবা বদ্ধ জলাশয়ে। এক পর্যায়ে গিয়ে এটা ছড়িয়ে পড়ে উন্মুক্ত সব জলাশয়েও। দেশি ছোট ছোট মাছদের গিলে খেয়ে ফেলতো আফ্রিকান মাগুর। যে কারণে এক সময় আফ্রিকান মাগুরকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ সরকার। সাকারও কি সেভাবে এসেছে?
না, সাকার মাছ খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশে আসেনি। একুরিয়ামের শখের মাছ হিসাবে আগমন ঘটেছে তার। এই মাছ যেহেতু ময়লা খায়, একুরিয়ামকে পরিষ্কার রাখার জন্য সাকারকে ব্যবহার করা হতো। সেখান থেকে কীভাবে কীভাবে এই মাছ ছাড়া পেয়ে গিয়েছে প্রকৃতিতে। আর এখন সেটা বাংলাদেশের জলজ জীব বৈচিত্র্যের উপরে হুমকি হিসাবে দেখা দিয়েছে। শুধু সাকার না, পিরানহা নামের এক ভয়ংকর রাক্ষুসে মাছও বাংলাদেশের জলজ পরিবেশে জায়গা করে নিয়েছে শখের উপজাত উপদ্রব হিসাবে।
মানুষের শখ থেকে এই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি এটাই প্রথম নয়। বাংলাদেশের নদী, পুকুর, জলাশয়, বিল-ঝিল সব জায়গাতে কচুরিপানার দৌরাত্ম্য দেখতে পাওয়া যায়। এটা এতো দ্রæত বংশ বিস্তার করে যে কচুরিপানাকে বিনাশ করা এক অতি দুঃসাধ্য কান। মোটামুটি দুই সপ্তাহে কচুরিপানা দ্বিগুণ হতে পারে। এই কচুরিপানা আমাদের দেশের উদ্ভিদ নয়। এর আদি বাসস্থান দক্ষিণ আমেরিকা। কচুরিপানার ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কেউ একজন শখ করে নিয়ে এসেছিলো সেটাকে বাংলা অঞ্চলে। ১৯২০ সালের মধ্যেই কচুরিপানা বাংলার প্রায় প্রতিটা জলাশয়ে নিজের উপস্থিতি জাহির করে সেই শখের প্রতিদান দিয়েছিলো। জলাভূমির ফসল আমন ধান আর পাট চাষ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো এক সময় কচুরিপানার অত্যাচারে। ফলে, বাংলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিলো। ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা আইন জারি করেছিলো সরকার। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সব দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপ-মুক্ত করার অঙ্গীকার ছিলো। এখন কচুরিপানার বিকল্প ব্যবহার আবিষ্কৃত হওয়ায় আগের মতো আর ভয়াবহ উপদ্রব হিসাবে এটাকে আর দেখা হয় না অবশ্য।
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে। শখের দাম হচ্ছে লাখ টাকা। কিন্তু, এর দায় কতো লাখ বা কতো কোটি টাকা হতে পারে, সেই কথাটা কেউ আমাদের বলেনি কখনো।
টমাস অস্টিন ভাগ্যের অন্বেষণে ইংল্যান্ড ছেড়েছিলেন তরুণ বয়সে। বহু দূরের উপনিবেশ অস্ট্রেলিয়াতে বসতি গড়েছিলেন তিনি। ভাগ্য ফিরেছিলো তাঁর। মাত্র দুই দশকের মধ্যে বিশাল পরিমাণ জমিজমার মালিক হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ভিক্টোরিয়াতে ঊনত্রিশ হাজার একরের এক বিলাসী ফার্ম হাউজ ছিলো তাঁর। সেখানে রেসের ঘোড়া ছিলো, শিকারের বন্দোবস্ত ছিলো। অস্টিনের ফার্ম হাউজ ব্যাপক জনপ্রিয় অস্ট্রেলিয়ার উচ্চ সমাজে। ডিউক অব এডিনবার্গ অস্ট্রেলিয়াতে গেলেই অস্টিনের ফার্ম হাউজে বেড়াতে যেতেন অবকাশ যাপনের উদ্দেশ্যে।
দেশ থেকে বহুদিন বহুদূরে থাকলে দেশের প্রতি টান বাড়ে। অস্টিনেরও তাই হয়েছিলো। তিনি চেয়েছিলেন যে তাঁর ফার্ম হাউজটাই একটা মিনি ইংল্যান্ড হোক, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের গ্রামের একটা ছাপ যেনো সেখানে আসে। ফলে, ইংল্যান্ড থেকে কিছু পশুপাখিকে ওখানে আনা শুরু করেন তিনি। তাঁর শখ ছিলো এমন যে, তাঁর ফার্ম হাউজটাতে শিকার করে যেনো মনে হয় ইংল্যান্ডেই শিকার করা হচ্ছে। তাঁর এই শখই অস্ট্রেলিয়াতে বিপর্যয় নিয়ে এসেছিলো।
১৮৫৯ সালে অস্টিনের ভাগ্নে জাহাজে করে কিছু পশু পাখি পাঠায় মামার জন্য। সেগুলোর মধ্যে চব্বিশটা খরগোশ ছিলো। আর এই চব্বিশটা খরগোশই খরগোশের মতো বংশবৃদ্ধি করা শুরু করে। মাত্র দুই বছর পর ১৮৬১ সালেই অস্টিন গর্বভরে বলেছিলেন যে তাঁর কয়েক হাজার খরগোশ আছে। মাত্র এক দশকের মধ্যেই সেই কয়েক হাজার বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক মিলিয়নে। অস্টিনের ফার্ম ল্যান্ড ছেড়ে খরগোশ যাত্রা শুরু করে বাইরের দিকে। প্রতি বছরে আশি মাইল এলাকাতে ছড়াতে শুরু করে তা। ১৮৮০ সালের মধ্যে তা পৌঁছে যায় নিউ সাউথ ওয়েলসে, ১৮৮৬ সালের মধ্যে সাউথ অস্ট্রেলিয়া এবং কুইন্সল্যান্ডে, ১৮৯০ সালের মধ্যে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া এবং ১৯০০ সালের মধ্যে নর্দান টেরিটোরি দখল করে নেয় অস্টিনের খরগোশ বাহিনী।
১৯২০ এর দশকে অস্ট্রেলিয়াতে খরগোশের সংখ্যা দাঁড়ায় দশ বিলিয়নে। দশ বিলিয়ন খরগোশের বাহিনী কী পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়। এদের কারণে খাদ্য না পেয়ে অস্ট্রেলিয়ার অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
অস্টিনের শখের খরগোশের সমস্যাটা ১৮৮০ এর দশক থেকেই উপলব্ধি করেছে অস্ট্রেলিয়ানরা। নানাভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়েছিলো। গুলি করে মারা হয়েছে, ফাঁদে ফেলা হয়েছে, এমনকি বিষও প্রয়োগ করা হয়েছ। কিছুতেই কিছু হয়নি। সরকার খরগোশ নিয়ন্ত্রণে কতোটা মরিয়া ছিলো সেটা নিউ সাউথ ওয়েলস সরকারের একটা বিজ্ঞাপন দেখলেই বোঝা যায়। সেই বিজ্ঞাপনে বড় ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিলো খরগোশ নিয়ন্ত্রণের উপায় বাতলে দিতে পারলে। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে খরগোশের সংক্রমণ বন্ধ করতে কয়েক হাজার মাইল লম্বা বেড়াও দেওয়া হয়েছিলো। তাতেও লাভ হয় নাই। খরগোশ বেড়ার নীচের মাটি খুঁড়ে ওইপাশে চলে গিয়েছে।
শখের দায় যে সহস্র কোটি টাকা হতে পারে, সেটা নিশ্চয় আর বুঝতে বাকি নেই আমাদের।